চুয়াডাঙ্গায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় চিহ্নিত রাজাকারদের নাম
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের যদুপুর গ্রামের আব্দুল জলিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গ্রামে রাজাকারের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। তার সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ওপর চালিয়েছে নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন। পরবর্তীতে বিজয়ের আগ মুহূর্তে গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণীর কাছে অস্ত্র জমা নিয়ে নিজেকে আত্মসমর্পণ করেন রাজাকার আব্দুল জলিল। চিহ্নিত রাজাকার হবার পরও স্বাধীনতার কয়েক বছর পর রাজাকার থেকে আব্দুল জলিল নিজেকে বানিয়ে ফেলেন মুক্তিযোদ্ধা। ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে মুক্তিবার্তায় নাম লেখান তিনি। শুধু তাই নয় সরকারের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন তিনি। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বসতঘরও পেয়েছেন রাজাকার আব্দুল জলিল।
চুয়াডাঙ্গার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার নথিপত্রে দেখা গেছে, ১৯৮৭ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা অনুয়ায়ী চুয়াডাঙ্গা জেলায় সর্বমোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১১০০ জন। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৫ সালে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫০০। এরপর ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালে তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সর্বশেষ নাম ওঠে প্রায় ১৮০০ জনের। এদের মধ্যে ১৭০০ জনের বেশি মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে সরকারি ভাতা পাচ্ছেন। বাকি যারা রয়েছেন তারাও পরবর্তীতে ভাতা পাবেন।
এদিকে নাম প্রকাশ করার না শর্তে মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের এক মুক্তিযোদ্ধা জানান, মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় যাদের নাম রয়েছে সঠিক যাচাই-বাছাই করলে তাদের অধিকাংশই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকার বলে প্রমাণ মিলবে। এসব রাজাকাররা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিজেদের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তুলেছেন।
বিজয়ের এতো বছর পরেও চুয়াডাঙ্গায় আব্দুল জলিলের মতো অনেক রাজাকারের নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় আছে বলে জানান মুক্তিযোদ্ধারা। তারা বলছে বিভিন্ন সরকারের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় রাজাকাররা নিজেদের নাম লেখান। যা পরবর্তীতে আর সংশোধন করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সময়ে জেলা মুক্তিাযোদ্ধা কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের অবহেলার কারণেই এসব রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় এসেছেন। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মতো রাজাকারও পাচ্ছেন রাষ্ট্রীয় সম্মান। তীব্র ক্ষোভ জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়ে চুয়াডাঙ্গার চিহ্নিত এসব রাজকাররা সমাজে এখন এমন অবস্থায় পৌঁছে গেছে যে তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না।
বেগমপুর ইউনিয়নের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গনি। মুক্তিযুদ্ধের উইং কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বহু বছর নিজের বুকে জমানো ক্ষোভ আর কষ্টের কথা বার্তা২৪.কমের কাছে তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণী। তিনি বলেন, দেশ স্বাধীন করেও আজ মানবেতর জীবনযাপন করছি। চাটাইয়ের বেড়া আর ভাঙা টিনের বাড়িতেই জীবনের শেষ বয়সে কষ্টে দিন কাঁটছে তার। অন্যদিকে তারই হাতে অস্ত্র জমা দেয়া পাশ্ববর্তী যদুপুর গ্রামের চিহ্নিত রাজাকার আব্দুল জলিল পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ঘর।
একই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ বলেন, চিহ্নিত রাজাকাররা যখন বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিয়ে বক্তব্য রাখেন তখন নিজের কাছে মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ কেন করেছি আমরা। মুক্তিযোদ্ধার ভাতা তুলতে ব্যাংকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমিও যাচ্ছি আবার সেই মুক্তিযুদ্ধে বিপক্ষে কাজ করা রাজাকারও যাচ্ছে আমার সঙ্গে। এর থেকে লজ্জার আর কী হতে পারে!
চুয়াডাঙ্গা জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার আবু হোসেন জানান, চুয়াডাঙ্গায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যেসব রাজাকার সরাসরি যুদ্ধ করেছে তারা হলো রাজাকার জাহিদ, সলেহ্, মালেক, জলিল ও দই কাশেম। এসব চিহ্নিত রাজাকারসহ ২৫ থেকে ৩০ জন রাজাকার ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছেন। সরকারিভাবে তারা রাষ্ট্রীয় সম্মানও পাচ্ছেন।
সাবেক সদর থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আশু বাঙ্গালী বলেন, ২০১৪ সালে মন্ত্রাণালয় থেকে আমার কাছে রাজাকারদের তালিকা চেয়ে একটি চিঠি দিয়েছিল। রাজাকারদের তালিকা করতে গিয়ে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা স্বাধীনতা বিরোধী ছিল তারা আজ সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে এমন জায়গায় অবস্থান করছে যে তাদের নাম রাজাকারের তালিকায় লেখা দুরূহ ব্যাপার। তবুও সবকিছু কাঁটিয়ে ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে রাজাকারের নাম পাঠানো হয়েছিল।
রাজাকার থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধায় নাম ওঠানো অভিযুক্ত আব্দুল জলিলের বাসায় গিয়ে চোখে পড়ে বাড়ির সামনে টাঙানো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ছবি। আব্দুল জলিলের কাছে যুদ্ধের সময় তিনি কত নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন ও তার সহযোদ্ধাদের নাম জানতে চাওয়া হলে তিনি সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারেননি। প্রশ্নের একপর্যায়ে রাজাকার আব্দুল জলিল নিজের বক্তব্যেই স্বীকার করলেন ১৯৭১ সালে রাজাকার হিসেবে পাকহানাদার বাহিনীর হয়ে কাজ করছেন। পরে দেশ বিজয়ের আগে গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা উইং কমান্ডার ওসমান গণির হাতে ধরা পড়েন এবং তার হতেই অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। পরে নিজের অবস্থা বেগতিক দেখে ঘর থেকে বের করে আনেন বীর মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদপত্র এবং গেজেট।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার জানান, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গর্বের সন্তান। বীর সন্তানদের তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বা রাজাকারের কোনো ঠাঁই নেই। যদি থাকে তাহলে তাদের নাম বাদ দেওয়ার সকল প্রকার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২০২০ সালে বিজয়ের ৫০ বছর রজতজয়ন্তী পালিত করবে বাংলাদেশ। তার আগেই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় যেসব ভুয়া আর রাজাকারদের ঠাঁই হয়েছে তাদের নাম বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে কলঙ্কমুক্ত করবে সরকার এমনটাই দাবি মুক্তিযোদ্ধাদের।