হতাশা নিয়েই স্বপ্ন দেখাচ্ছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী জাকারিয়া

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নীলফামারী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ব্রেইল পদ্ধতিতে ছাত্রদের পড়াচ্ছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী জাকারিয়া, ছবি: বার্তা২৪.কম

ব্রেইল পদ্ধতিতে ছাত্রদের পড়াচ্ছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী জাকারিয়া, ছবি: বার্তা২৪.কম

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী জাকারিয়া হোসাইন (৩১)। তিনি নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাখুলি গ্রামের মৃত মকবুল হোসেনের ছেলে। নিজে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েও সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন জেলার আরও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের। ব্রেইল পদ্ধতিতে পাঠদান করাচ্ছেন নয় শিক্ষার্থীকে। শুধু শিক্ষক হিসেবে নয় পরীক্ষক হিসেবেও একমাত্র তিনি।

সমাজ সেবা অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম’এ অস্থায়ী ভিত্তিতে হাউস প্যারেন্টস কাম শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জাকারিয়া। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানে নয়জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ানো হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের একমাত্র ভরসা জাকারিয়ার হাত ধরে নিজেদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে এখানকার শিক্ষার্থীরা।

বিজ্ঞাপন

নয়জনের মধ্যে পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে দুইজন, নীলফামারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে দুইজন, কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে দুই জন এবং বাকি তিন জনকে সমাজ সেবার এই কেন্দ্রে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ানো হচ্ছে।

সমাজসেবা অধিদফতর সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম

নীলফামারী সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত জলঢাকা উপজেলার বালাগ্রাম ইউনিয়নের চাওড়াডাঙ্গি গ্রামের এরশাদ আলীর ছেলে মোহাম্মদ মাসুম বলেন, ‘আমি চোখে দেখি না ঠিকই। কিন্তু আমার মনের চোখতো বন্ধ নেই। দশজনের মতো আমি চলাফেরা করতে না পারলেও আমি স্বপ্ন দেখছি ভালো মানুষ হওয়ার এবং পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটি চাকরি করার। নিশ্চয় আমি সফল হব।’

বিজ্ঞাপন

কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ডিমলা উপজেলার নাউতারা ইউনিয়নের বাবলা রহমান বলেন, ‘আমি হতাশ নই। আমার মা বুলবুলি বেগম, বাবা শাহান উদ্দিন ও খালা মোহনা বেগম দু’চোখ দিয়ে দেখতে পারেন না। কিন্তু তাদের সংসার তো চলছে। আমিও পিছিয়ে থাকছি না। আমি যেখানে থাকি, আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় সহযোগিতা পাচ্ছি। নিশ্চই পড়াশোনা শেষ করে আমি ভালো কিছু করতে পারব। স্যার জাকারিয়া আমাদের পরিবারের মতো ভালোবাসা দিয়ে পড়াশোনা করাচ্ছেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমে চারজনের পদ থাকলেও মাত্র একজন নৈশ প্রহরী ছাড়া স্থায়ী আর কেউ নেই এখানে।
সমাজ সেবা অধিদফতরের শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন রিসোর্স টিচার পদে অতিরিক্ত রয়েছেন এখানে। বাকি দুজনের মধ্যে জাকারিয়া হোসাইন হাউস প্যারেন্টস কাম টিচার ও তাহেরা বেগমকে বাবুর্চি হিসেবে শিল্প উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ‘নীলসাগর গ্রুপ’ মাসিক সম্মানী দিয়ে পরিচালনা করছে।

জাকারিয়া হোসেন বলেন, ‘যখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি তখন ক্রিকেট খেলতে গিয়ে চোখে বলের আঘাত লাগে। ২০০৫ সালে আমি জিপিএ ৩.৩৩ নিয়ে দাখিল পাস করি। ২০০৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাতে আমার দুটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। তখন থেকে আর পৃথিবীর আলো দেখতে পারিনি। ২০১০ সালে লালমনিরহাট সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ ৩.৭০ নিয়ে একই কলেজ থেকে ২০১৩ সালে প্রথম শ্রেণীতে ডিগ্রি (বিএসএস) এবং পরবর্তীতে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে ২০১৫ সালে জিপিএ ৩.২৮ নিয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সমাজ সেবা অধিদফতর নীলফামারীর তৎকালীন উপ-পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক ২০১৬ সালে আমাকে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম ও ছাত্র সংগ্রহের দায়িত্বের পাশাপাশি পড়াশোনায় সহায়তার জন্য দায়িত্ব দেন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে আমি লালমনিরহাটে ব্রেইল পদ্ধতি রপ্ত করি এবং সেটির ব্যাপকতা ঘটাই।’

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্ররা

আক্ষেপ করে জাকারিয়া বলেন, ‘আমার তো সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখানে দায়িত্বে থেকে ব্যাচেলর অব স্পেশাল এডুকেশন কোর্সটি (বিএসএড) সম্পন্ন করতে পারিনি। কয়েকটি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি কিন্তু হয়নি। অনেক হতাশা নিয়ে দিনযাপন করছি, ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছি আমি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আকুতি জানাই পিওন হলেও যেন এই মুজিব বর্ষে আমার একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেন।’

প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিসোর্স টিচার ও সমাজ সেবা অধিদফতরে প্রবেশন কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন জানান, ‘চারজনের পদ রয়েছে এখানে। কিন্তু স্থায়ীভাবে রয়েছে মাত্র একজন। যিনি নৈশ প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। হাউস প্যারেন্টস ও বাবুর্চিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নীলসাগর গ্রুপ সম্মানী দিয়ে পরিচালনা করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জাকারিয়াকে আমাদের প্রয়োজন। তার চাকরি স্থায়ী হলে প্রতিষ্ঠানটি সমৃদ্ধ হবে এবং জেলার দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা আলোকিত হতে পারবে।’

জানতে চাইলে সমাজ সেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক ইমাম হাসিন বলেন, ‘২০১৬ সাল থেকে আমাদের প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। এতদিন এটি প্রকল্প আকারে ছিল এখন রেভিনিউ (রাজস্ব) খাতে গেছে। নিয়োগ প্রক্রিয়াটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ব্যাপার। তারপরও জাকারিয়ার বিষয়টি আমরা উপরে বলে রেখেছি।’