হাকালুকি হাওরে বেড়েছে অতিথি পাখির উপস্থিতি

  • এম ইদ্রিস আলী, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, মৌলভীবাজার
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

হাকালুকি হাওরে পাখিদের অভয়াশ্রম, ছবি: ইনাম আল হক ও পল থমসন

হাকালুকি হাওরে পাখিদের অভয়াশ্রম, ছবি: ইনাম আল হক ও পল থমসন

গত বছরের তুলনায় এবছর অতিথি পাখির সংখ্যা বেড়েছে এশিয়ার অন্যতম এবং দেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকিতে। শীত মৌসুমে পাখিদের অভয়াশ্রম খ্যাত এই হাওরে বিগত বছর উদ্বেগজনক হারে কম ছিলো পাখির উপস্থিতি। যদিও এর আগের পাঁচ বছর পাখির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েছিলো। এবছর পাখির সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে দেখা মিলেছে হুমকির মুখে থাকা কিছু ভিন্ন প্রজাতির পাখি।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দেশের বারো মাসই এই হাওরের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্ষাকালে হাওরে যেমন পানির আধিক্যেতা মাছের অবাধ বিচরণে সাহায্য করে। তেমনি শীত মৌসুমে খোলা আকাশের নিচে অতিথি পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে এই হাওরের খ্যাতি রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

শীত মৌসুমে প্রতি বছর নানান প্রজাতির অতিথি পাখির কলকাকলিতে হাকালুকি হাওরে প্রাণচঞ্চলতা ফিরে আসে। শুষ্ক এই মৌসুমে হাকালুকির চারিদিকে শূন্যতা গুচিয়ে পাখির কিচিরমিচির শব্দে ভরে উঠে চারপাশ। আর তাদের মন মাতানো উতাল-পাতাল উড়ন্ত ঢেউয়ের সৌন্দর্য দেখতে ভিড় করেন দেশ-বিদেশের পর্যটক ও প্রকৃতি প্রেমীরা।

এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম হাকালুকি হাওরের মৌলভীবাজার অংশে গত বছরের চেয়ে এবছর পাখির সংখ্যা বেড়েছে। হুমকির মুখে আছে এমন কিছু প্রজাতির পাখিরও সন্ধান পাওয়া গেছে এবছর। তার মধ্যে মহাবিপন্ন বেয়ারের ভূতিহাঁস, সংকটাপন্ন পাতি ভূতিহাঁস এবং প্রায়-সংকটাপন্ন মরচেরং ভূতিহাঁস, ফুলুরি হাঁস, কালামাথা কাস্তেচরা, উত্তুরে টিটি, উদয়ী গয়ার অন্যতম।

বিজ্ঞাপন
 হাকালুকির শূন্যতা গুচিয়ে পাখির কিচিরমিচির শব্দে ভরে উঠে চারপাশ, ছবি: ইনাম আল হক ও পল থমসন

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) বাংলাদেশের উদ্যোগে দুই দিনের পাখিশুমারি শেষে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

গত মঙ্গলবার ও বুধবার (২৮ ও ২৯ জানুয়ারি) পাখি শুমারিতে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরে ৫৩ প্রজাতির ৪০ হাজার ১২৬টি জলচর পাখি পাওয়া গেছে। এ দুই দিন হাওরের ৪০টি বিলে জলচর পাখিশুমারি করা হয়। বুধবার রাতে শুমারির ফল প্রকাশ করা হয়।

শুমারিতে অংশ নেন পাখি বিশেষজ্ঞ ড. পল থমসন, ইনাম আল হক এবং পাখি শুমারি নিয়ে কাজ করা ওমর শাহাদাত, শাহেদ ফেরদৌস, শফিকুর রহমান ও তারেক অণু।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর পাখির সংখ্যা ২০১৯ সালের চেয়ে সামান্য বেশি। তবে ২০১৮ ও ২০১৭ সালের চেয়ে কম। ২০১৯ সালে হাকালুকিতে ৩৭ হাজার ৯৩১টি পাখির দেখা মেলে। এর আগে ২০১৮ সালে ৪৫ হাজার ১০০টি এবং ২০১৭ সালে ৫৮ হাজার ২৮১টি পাখির দেখা মেলে পাখি শুমারিতে।

এবারে হাকালুকির ৪০টি বিলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাঁচ হাজার ৪৩০টি পাখি পাওয়া গেছে চৌকিয়া বিলে। এরপর পাঁচ হাজার ১৪৭টি পাখি পাওয়া গেছে চ্যাতলা বিলে। এ ছাড়া ফুটবিলে চার হাজার ৯৮৩টি ও বালিয়াজুরি বিলে তিন হাজার ৩০৫টি পাখি পাওয়া গেছে।

এদিকে হাওড়খালে বিষটোপ দিয়ে মারা যাওয়া পাখিও পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সহ-সভাপতি তারেক অণু। তিনি জানান, দুই দিনব্যাপী হাকালুকি হাওরের ৪০টি বিলে পাখিশুমারি চলে। বিলগুলো হলো- হাওয়াবন্যা, কালাপানি, রঞ্চি, দুধাই, গড়কুড়ি, চৌকিয়া, উজান-তরুল, ফুট, হিংগাউজুড়ি, নাগাঁও, লরিবাঈ, তল্লার বিল, কাংলি, কুড়ি, চেনাউড়া, পিংলা, পরোটি, আগদের বিল, চেতলা, নামা-তরুল, নাগাঁও-ধুলিয়া, মাইছলা-ডাক, চন্দর, মালাম, ফুয়ালা, পলোভাঙা, হাওড় খাল, কইরকণা, মোয়াইজুড়ি, জল্লা, কুকুরডুবি, বালিজুড়ি, বালিকুড়ি, মাইছলা, গড়শিকোণা, চোলা, পদ্মা, কাটুয়া, তেকোণা, মেদা, বায়া, গজুয়া, হারামডিঙা ও গোয়ালজুড়।

হুমকির মুখে আছে এমন কিছু প্রজাতির পাখিরও সন্ধান পাওয়া গেছে এবছর, ছবি: ইনাম আল হক ও পল থমসন

অণু বলেন, হাকালুকি হাওরের চৌকিয়া বিল, গৌড়কুরী বিল, নাগুয়া বিল, ফুটবিল ও চাতলা বিলে গিয়ে দেখা যায়, পরিযায়ি পাখিগুলো মনের রঙ মিশিয়ে এলোপাতারি উড়ছে। প্রাণ চঞ্চলতায় ভরপুর যেন আশেপাশের জলাশয়গুলো। চারিদিকে পাখিদের কলকাকলিতে পরিবেশ ছিলো মনোরম। কোথাও পাখিরা দলবেঁধে ডুব সাঁতারে খেলা করছে।

বাংলাদেশ বার্ডক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা জলচর পাখি জরিপের জাতীয় সমন্বয়ক ও পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বলেন, প্রতি বছরই প্রচুর অতিথি পাখি হাকালুকি হাওরে বিচরণ করে।

আশাজাগানিয়া তথ্য হচ্ছে, এবছর বিপন্ন ও সংকটাপন্ন ছয় প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে। এর মধ্যে বিশ্বে মহাবিপন্ন পাখির একটি হলো বেয়ারের ভূঁতিহাঁস। ধারণা করা হচ্ছে, সারা বিশ্বে একশ’ থেকে দেড়শটি ভূতিহাঁসের অস্থিত্ব রয়েছে। যা দেশের একমাত্র হাকালুকিতে এই পাখির দেখা মিলেছে। এই পাখি দেশে আর কোথাও দেখা যায় না।

ইনাম আল হক বলেন, শীত মৌসুমে উত্তরের তুন্দ্রা অঞ্চল বরফাচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ায় বেয়ারের ভূঁতিহাঁস হাকালুকি হাওরসহ বিভিন্ন দেশে চলে আসে। কিন্তু বিষটোপসহ পাখি শিকারিদের বিভিন্ন নিধনযজ্ঞের কারণে অন্যান্য পাখির মতো ভূঁতিহাঁস হুমকির সম্মুখীন। এদের নিরাপদ আবাস ও বিচরণের ব্যবস্থার মাধ্যমে এই পাখি সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। এই হাওরের ফুট বিলে প্রথমবারের মত ৩টি মেটে রাজহাঁসের দেখা মেলে। এগুলো মূলত সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে বিচরণ করে।

তবে খুবই উদ্বেগজনক বিষয়টি হচ্ছে, হাকালুকি হাওরটি অরক্ষিত থাকায় অবাধে শিকারিরা পাখি শিকার করছে। যা শুমারির সময় হাওরে বিষটোপে মারা যাওয়া অতিথি পাখি পাওয়া যায় এবং বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করছেন অনেকে সেটাও দেখা যায়।

আবারো হাকালুকি হাওরকে পরিকল্পনার আওতায় এনে অতিথি পাখির অভয়াশ্রম ঘোষণার দাবী জানান তিনি।