জয়দেবপুর জংশন থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকা চাঁদা আদায়
গাজীপুরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশনের পরিমাণ ৫ দশমিক ৯৫ একর। এর মধ্যে প্রায় দুই একর জমি বেদখল। যেখানে গড়ে উঠেছে প্রায় পাঁচশ’ অবৈধ দোকানপাট। এখান থেকে বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। প্রভাবশালীদের কবল থেকে এ সম্পত্তি উদ্ধারে রেলওয়ে প্রশাসনের কোন উদ্যোগ নেই।
অভিযোগ রয়েছে, রেলওয়ে পুলিশ, জংশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা এবং অবৈধ মার্কেট কমিটির সদস্যরা চাঁদার টাকার ভাগ নেন। গত আড়াই বছরে এসব স্থাপনা উচ্ছেদে ১৫ বারের বেশি অভিযান চালিয়েও দখল ঠেকানো যাচ্ছে না।
জয়দেবপুর জংশন এলাকার অবৈধ দোকানপাট বরাদ্দ দিতে এবং প্রতিদিন চাঁদা তোলার জন্য একটি কমিটি রয়েছে। ওই কমিটির সভাপতি জংশনের চা-বিক্রতা বাচ্চু মিয়া এবং সাধারণ সম্পাদক জুতা বিক্রেতা তাজু মিয়া। এ দুজন ছাড়াও বার্তা২৪.কমের অনুসন্ধানে সোহরাব, খোকা, মামুন, লাল মিয়া, ফরিদ ও কাজলের নাম জানা গেছে। যারা স্থায়ী ও ভাসমান দোকান থেকে প্রতিদিন চাঁদা তোলেন।
রেলওয়ের জমিতে শ্রমিক লীগের দুটি কার্যালয়, কলা ও ফলের দোকান, চা-সিগারেটের দোকান, খাবার হোটেল, স্টেশনারি, কাপড়, জুতা, কসমেটিকস ও খেলনার দোকানসহ গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রেললাইনের দুই পাশে অবৈধ স্থাপনার পাশাপাশি রেললাইনের উপরে ভাসমান দোকান বসছে। প্রায় তিনশটি বড় সাইজের আর তুলনামূলক ২৫০টির মতো ছোট দোকান রয়েছে। প্রতিদিন বড় দোকানগুলো থেকে পানি ও বিদ্যুৎ বিল এবং পাহারাদারের বেতনের নাম করে খরচ বাবদ ২০০ টাকা করে চাঁদা উঠানো হচ্ছে। একই অজুহাতে ছোট দোকানগুলো থেকে ১০০-১৫০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়।
এ ছাড়াও রেললাইনের উপরে বসা ভাসমান হকারদের কাছ থেকে গড়ে প্রতিদিন ৩-৫ হাজার টাকা চাঁদা নেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯০ হাজার টাকা জংশন ও এর আশপাশ এলাকার দোকানপাট থেকে চাঁদা আদায় করা হয়। যা বছরে গিয়ে সাড়ে তিন কোটি টাকায় ঠেকছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, জয়দেবপুর জংশনে যাওয়ার জন্য নির্ধারিত গেট থাকা সত্ত্বেও কিছু অসাধু ব্যক্তি জংশনের পশ্চিম পাশের সীমানা প্রাচীর ভেঙে একটি বড় রাস্তা তৈরি করেছে। এরপর জংশনের পশ্চিম পাশে রেলওয়ের জমিতে দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিয়েছে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকার ভেদে প্রতিটি দোকান বরাদ্দের জন্য এককালীন চাঁদা দিতে হচ্ছে ১৫শ’ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এভাবে প্রায় অর্থ কোটি টাকা দোকান বরাদ্দ বাবদ নেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অবৈধ দোকানপাট খোলা থাকে। জংশনে দিনের ও রাতের চিত্র ভিন্ন। রাতে এই জংশনের আশপাশে অনৈতিক কাজও হচ্ছে। পাশাপাশি বসছে মাদকের অদৃশ্য হাট। যেখানে সহজেই গাঁজা, ইয়াবাসহ নেশাজাতীয় নানা দ্রব্য পাওয়া যায়। এর জন্য অপরাধী, মাদকসেবী ও ভবঘুরে ব্যক্তিদের ভিড় থাকে জংশনে।
এ জংশন দিয়ে দেশের উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের ৭২টি ট্রেন চলাচল করে। বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা মাথায় নিয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০ হাজার যাত্রী দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করেন। অনেকে ছিনতাইকারী ও পকেটমারদের কবলেও পড়েন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১০ জন ব্যবসায়ী চাঁদা দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, প্রতিদিন চাঁদার টাকা দিতে হয়। পানি, বিদ্যুৎ, ঝাড়ুদার ও নাইট গার্ডদের বেতনের কথা বলে চাঁদা তোলা হয়। আর দোকান চালু করতে জামানতের নামে অফেরৎযোগ্য মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়া হয়। বাচ্চু মিয়া এবং তাজু মিয়া মার্কেটের দেখভাল করেন। তারাই সবার কাছে চাঁদার ভাগ পৌঁছে দেন। এখানে এসব তদারকির জন্য একটি কমিটি রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষমতা কারও নেই। দোকান করতে হলে তাদের কথা মতোই চলতে হবে।
সরাসরি এবং ফোনে তিন দিন চেষ্টা করেও অবৈধ মার্কেট কমিটির সভাপতি বাচ্চু মিয়া এবং সাধারণ সম্পাদক তাজু মিয়ার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জয়দেবপুর জংশন ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আব্দুল মান্নান বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি দুই মাস আগে এখানে যোগদান করেছি। এখান থেকে একটি পয়সাও নিই না। আগেও বহুবার চাঁদার টাকার ভাগ নেওয়ার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। যারা আমার নামে চাঁদা তোলে তাদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জয়দেবপুর জংশনের স্টেশন মাস্টার মো. শাহজাহান বার্তা২৪.কমকে বলেন, রেলের জমি দেখাশোনা করে আমাদের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ। এই জংশনে আড়াই বছর ধরে আছি। এই সময়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে ১৫ বারের বেশি অভিযান চালানো হয়েছে।
বার বার উচ্ছেদের পরও পুনরায় কিভাবে দোকানপাট বসছে প্রশ্নে তিনি বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজনের কারণে দখলমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। তারা দোকানপাট তদারকির জন্য অফিস খুলে বসেছে।
অসহায়ত্ব প্রকাশ করে স্টেশন মাস্টার বলেন, মাত্র ৫ মাস আছে চাকরির মেয়াদ। এখন বিস্তারিত বললে দেখা যাবে তারা আমার উপর লাঠি-সোঁটা নিয়ে চড়াও হবে, মানসম্মান নষ্ট করবে।
চাঁদার ভাগ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি আরও বলেন, জংশনে ডাবল লাইনের কাজ চলমান। নতুন লাইন সচল করতে খুব শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। এবার উচ্ছেদের পর পুনরায় অবৈধ স্থাপনা বসানোর সুযোগ থাকবে না।