চানাচুর বিক্রেতা হেলিম যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সবার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় গল্প কাহিনী ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’। গল্পের সেই বংশীবাদকের মতো লাল রংয়ের রহস্যময় পোশাক পরে গাজীপুরে হেলিম নামে একজনকে দেখা গেল। তবে তিনি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো শিশুদের নিয়ে উধাও হতে নয়; মজাদার চানাচুর বিক্রি করতে এই শহরে এসেছেন।
বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাত পৌনে ১১টার দিকে গাজীপুর নগরীর বরুদার ঢাল এলাকায় বিশ্বখ্যাত সেই গল্পের মতই এক ‘বাঁশিওয়ালা’র দেখা মেলে।
যার হাতে টিনের সরু লম্বা বাঁশি, পরনে লাল রঙের পোশাক, কাঁধে ঝুলানো গামছায় বাঁধা টুকরি আর পায়ে ঘুঘুর। সবাইকে আকৃষ্ট করতেই তার এই সাজসজ্জা।
৩০ বছর বয়সী এই যুবকের নাম আব্দুল হেলিম। বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার বাঘাসুরা গ্রামে। সেই ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’র রূপে বিভিন্ন শহর ঘুরে চানাচুর বিক্রি করাই তার পেশা।
তার বাবার নাম আব্দুল কাদির। পরিবারের পাঁচ বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। অভাব অনটনে তৃতীয় শ্রেণির পর আর পড়ার সুযোগ পাননি। সংসারের হাল ধরতে ২০০১ সালে পরিবার ছেড়ে কিশোর বয়সেই চলে আসেন গাজীপুরে। শুরু করেন চিড়ার মোয়া, মুড়ির মোয়া ও চিপস বিক্রি। এতে খুব বেশি আয় হতো না। এরপর চাচাতো ভাই কামাল মিয়ার হাত ধরে ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’ সেজে চানাচুর বিক্রি শুরু করেন। লাভের বড় অংশ কামাল নিয়ে যেতো। এরপর নিজেই ২০০ টাকা পুঁজি খাটিয়ে আলাদা ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে পুঁজির পরিমাণ ৮০০ টাকা। স্বল্প বিনিয়োগের লাভেই ঘুরছে সংসারের চাকা।
দিনে ১২-১৫শ টাকার চানাচুর বিক্রি করতে পারেন। এর অর্ধেক লাভ থাকে। বর্তমানে তার মাসিক খরচ ১২ হাজার টাকার বেশি। চার বছর আগে সাবু আক্তারকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেছেন। বিয়ের আগে বাবা-মাকে মাসিক তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ দিতেন। স্ত্রী সাবু তিন বছর বয়সী ছেলে জিসান মিয়া ও নয় মাস বয়সী মেয়ে জান্নাতকে নিয়ে গ্রামেই বসবাস করেন। তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে গাজীপুর নগরীর আউটপাড়া নায়েবের বাড়ি এলাকায় ভাড়া থাকেন। আয় কমে খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন আর বাবা-মাকে সাহায্য করতে পারেন না হেলিম।
তিনি বলেন, ভালো লাগে এই ব্যবসা করতে। লাল পোশাকে মানুষ বেশি আকৃষ্ট হয়। প্যাঁ-পুঁ বাঁশি বাজিয়ে হেঁটে চলি শহরে উপশহরে। প্রথম প্রথম বাচ্চারা দেখলে ভয়ই পেত। এখন তারা আনন্দ পায়। সব জায়গায় ফেরি করতে যাই না। চেনা পরিচিত এলাকায় বেশি যাই। এখন বাচ্চারাও দূর থেকে দেখলেই ছুটে আসে চানাচুর খেতে।
তার মতো একই বেশে গাজীপুরের মাওনা, বরমী, রাজেন্দ্রপুর, বাঘের বাজার, হোতাপাড়া, নাওজোড়, কড্ডা, কোনাবাড়ী, হাড়িনাল, বরুদা, জোড়পুকুর, রাজবাড়ী, শিববাড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় ৩০ জন ফেরি করে চানাচুর বিক্রি করেন। যারা একই দলের। তবে তাদের দলের কোনও নাম নেই। হেলিমের সঙ্গে একই কক্ষে তাদের দলের চারজন থাকেন। অন্যরা নিজেদের সুবিধামত শহরের বিভিন্ন জায়গায় বাস করেন।
হেলিমের টুকরির ভেতরে থাকে মুড়ি, চিড়া ভাজা ও চিকন চানাচুর। ক্রেতারা খেতে চাইলে লাল প্লাস্টিকের গ্লাসে এসব ঢুকিয়ে সঙ্গে ধনিয়া পাতা, কাঁচা মরিচ, শসা, গাজর, টমেটো ও পেঁয়াজ দেন। এরপর দারুচিনি, এলাচ, লং, গোলমরিচ, জিরা, পাঁচফোড়ন, জর্তির খাল, জয়ফল, আদা ও রসুন দিয়ে তৈরি এক ধরনের সুস্বাদু মসলা গ্লাসে ভরে সরিষার তেল ও হালকা টেস্টিং সল্ট দিয়ে ঝাঁকিয়ে মেশানোর পর কাগজের ঠোঙ্গাতে তা পরিবেশন করেন।
বিশেষ মসলা দিয়ে তৈরি এই চানাচুরে অস্বাস্থ্যকর কিছুই নেই দাবি করে হেলিম বলেন, সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত খুব যত্ন করে নিজ হাতে এসব প্রস্তুত করি। এরপর বিকেল ৩টার দিকে বের হয়ে রাত ১১-১২টা পর্যন্ত বাইরে থাকি। কখনও কখনও এরও আগে বিক্রি শেষ হয়ে যায়।
তার লক্ষ্যের বিষয়ে প্রশ্ন করতেই আক্ষেপ করে বলেন, অভাব অনটনের সংসারের হাল ধরতে নিজে পড়ালেখা করতে পারিনি। কিন্তু ছেলে-মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই।
নিজেকে সফল মনে করা এই ব্যক্তি আরও বলেন, সুখি হতে খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। বেকারত্ব গুছিয়ে স্বাবলম্বী হতেও খুব বেশি পুঁজির দরকার নেই। লক্ষ্য ঠিক রেখে কাজটা চালিয়ে গেলেই থেমে থাকতে হয় না।
চানাচুর ক্রেতা আব্দুস ছামাদ বলেন, হেলিমের বানানো চানাচুর স্বাস্থ্যকর কি-না জানি না। তাকে দেখলেই চানাচুর কিনে খাই। তবে সত্যিই তার চানাচুর অনেক মজাদার। যেই বেশে সে ঘুরে বেড়ায়, তা দেখে সবাই আকৃষ্ট হবে। তার ব্যবসার পলিসিটা দারুণ। প্রতিদিনই সে মোট পুঁজির চেয়ে বেশি লাভ নিয়ে বাসায় ফেরে।