কল-কারখানার বর্জ্যে আবর্জনার ডাম্পিং শীতলক্ষ্যা
শীতলক্ষ্যা আর নারায়ণগঞ্জ নাম দুটি একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রাচ্যের ডান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জ শহরের ব্যবসা-বাণিজ্য এই শীতলক্ষ্যা নদীকে ঘিরেই খ্যাতি লাভ করেছে। এখনও এই নদীকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে লক্ষাধিক মানুষ। কিন্তু দূষণ, আবর্জনা আর দখলের কবলে পড়ে শীতলক্ষ্যা নদী মুমূর্ষু রোগীতে পরিণত হয়েছে। পুরো শহরের প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি করা এই নদী এখন আবর্জনার ডাম্পিং জোন।
খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উৎপত্তি হওয়া এই শীতলক্ষ্যায় নেই পূর্বের মতো প্রবল স্রোত। নদীর দুপাশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা। এ সকল প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য শোধনাগারের (ইটিপি) মাধ্যমে নিষ্কাশন করার কথা থাকলেও বেশিরভাগ কারখানায় তা মানা হচ্ছে না। জেলা পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩০০টি প্রতিষ্ঠানে ইটিপি রয়েছে। কিন্তু ইটিপি পরিচালনায় কারখানা মালিকদের অনীহা প্রবল। ফলে সুযোগ পেলেই পরিশোধন ছাড়াই বর্জ্য বিভিন্ন খাল-নালা থেকে সোজা মিশছে শীতলক্ষ্যায়।
সরজমিনে দেখা যায়, নদী পাড়ে দাঁড়ালে বিশুদ্ধ বাতাসের বদলে ভেসে আসছে উৎকট গন্ধ। বর্ষায় নদীর পানি কিছুটা পরিষ্কার হলেও শীতে ধারণ করে কুচকুচে কালো রঙে। শহরসহ শহরতলীর অধিকাংশ ড্রেন ও ক্যানেলের শেষ গন্তব্য শীতলক্ষ্যায়। এসব ড্রেন ও ক্যানেল দিয়ে বর্জ্য সোজা মিশে যাচ্ছে নদীর সঙ্গে। এছাড়া নদীর পাড়ে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আড়তের আবর্জনার স্তূপ। নারায়ণগঞ্জের সেন্ট্রাল ঘাট সংলগ্ন ওয়াকওয়ের সন্নিকটে গেলেই দেখা যায় শীতলক্ষ্যা দূষণের এমন ভয়াবহ চিত্র। একদিকে দূষিত হচ্ছে নদী অন্যদিকে নদীর দুইপাশ ডকইয়ার্ডসহ বিভিন্ন স্থাপনায় দখল হয়ে ক্রমশই সরু হচ্ছে নদী।
শীতলক্ষ্যা পূর্ব পাড়ের বন্দর উপজেলার বাসিন্দা সামিউল ইসলাম বলেন, ছোট বেলায় এই শীতলক্ষ্যায় গোসল করতাম নিয়মিত। আর এখন এই পানি পায়ে লাগলেও পা চুলকায়। প্রায় ২৫ বছর ধরে চাকুরির সুবাদে নদী পার হই প্রতিদিন। আর দিনে দিনে শীতলক্ষ্যা যেন প্রতিদিনই আরও নোংরা হচ্ছে। কয়েকবছর পূর্বের চিত্র আর এখনকার চিত্র মেলাতে অনেক কষ্ট হয়।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, নদী রক্ষার আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে শীতলক্ষ্যা তার যৌবন হারাচ্ছে। অথচ এই শীতলক্ষ্যাই ব্যবসা-বাণিজ্যসহ পুরো নারায়ণগঞ্জকে দেশের ধনী জেলা তৈরিতে অবদান রেখেছে। আর মানুষ অকৃতজ্ঞের মতো নদীকে গলা টিপে মেরে ফেলছে।
সম্প্রতি গত ৭ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে নদী রক্ষা কমিটির আয়োজিত এক সভায় নৌ পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের নদীগুলো বাঁচাতে সকলের সহযোগীতা প্রয়োজন। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় তদারকি ও কর্মকর্তাদের সুদৃষ্টিই পারে নদী গুলোকে দূষণমুক্ত ভাবে প্রবাহমান রাখতে। ইতোমধ্যে নদীগুলোর ব্যাপারে সরকার টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটি নদী রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। কোথাও নদী দখলের খবর পেলে এই কমিটিকে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার নদী বাঁচাতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ অধিদফতরের পরিদর্শক মইনুল হক বলেন, শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ও কেমিকেলের পানিই শীতলক্ষ্যা দূষণের মূল কারণ। নারায়ণগঞ্জের সকল শিল্প-কারখানায় ইটিপি নেই। যে সকল প্রতিষ্ঠানে রয়েছে তারাও ব্যবহার করেনা। এ সকল প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের জন্য আমাদের জনবল খুবই কম। এছাড়াও মোবাইল কোর্টের জন্য আমাদের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট নেই। ঢাকা থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আসলে তখন ভ্রাম্যমাণ আদালতে অভিযান পরিচালনা হয়। একটি সংস্থার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের এই সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধান করা এক প্রকার অসম্ভব। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে শীতলক্ষ্যা সহ দেশের সকল নদীই পারে তার সত্যিকারের রূপ ফিরে পেতে।