নওগাঁর তাজ সিনেমা হল আধুনিকায়নের দাবি
শীতের দুপুর, নায়িকা অঞ্জু ঘোষ এবং নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন অভিনীত ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবি দেখতে নওগাঁর তাজ সিনেমা হলে টিকিট কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন। দর্শকে পরিপূর্ণ হল। সালটা ১৯৯০, তারপর পেরিয়ে গেছে প্রায় তিনদশক। সেদিনের সেই জমজমাট তাজ সিনেমা হল আজ জীর্ণ। বর্তমানে হলের কর্মচারী সংখ্যা আটজন হলেও সারাদিনে দর্শক সংখ্যা তিন থেকে পাঁচ জনের বেশি হয় না।
শহরের চকবাড়িয়ার বাসিন্দা সাহেব আলী আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা যখন হাইস্কুলের ছাত্র, তখন এই হলে রূপবান, রাঙা ভাবি, অবুঝ মন, নবাব সিরাজ উদ-দৌলার মতো কত সিনেমা দেখেছি। সবই ঠিকঠাক চলছিল হঠাৎ স্যাটেলাইট টেলিভিশন এবং ভিসিআরের রমরমা ব্যবসা যেন সবকিছু ওলট-পালট করে দিল। দর্শক শূন্য হলের সামনে এসে দাঁড়ালে সে সব কথা আজও মনে পড়ে।’
তাজ সিনেমা হলের টিকিট চেকার ফনি রায় বলেন, ‘সারাদিনে সাধারণত একটির বেশি শো চলে না। তবে দুইজন দর্শক আসলেও আমরা শো চালাই। যেদিন কোনো দর্শক আসে না, সেদিন শো চলে না। শো না চললে আমাদের জীবন চলে না। তাই পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি।’
এদিকে, শহরের মুক্তির মোড়ের মুক্তি সিনেমা হল ভেঙে ফেলা হয়েছে। এছাড়া রুবীর মোড়ের ঐতিহ্যবাহী রুবী সিনেমা হলটি ভেঙে তৈরি করা হয়েছে কয়েকটি কমিউনিটি হাসপাতাল।
নওগাঁ সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মামুন, নওগাঁ সরকারি কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী মাহফুজা খাতুন, বাংলা বিভাগের ছাত্রী আয়েশা সিদ্দিকা এবং বিএমসি মহিলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী সুইটি বলেন, ‘গরমের অস্বস্তি, নিরাপত্তা হীনতা, হলের ভিতরে ধূমপান, ভাঙা চেয়ার, বিকল ফ্যান, কালো পর্দার জীর্ণ দশার হলে ছেলেমেয়েরা আর সিনেমা দেখতে পছন্দ করে না। নতুন প্রজন্ম বাড়িতে এলইডি টিভি দেখছে। দর্শক বাড়াতে হলে নিরাপত্তাসহ হলের সেবার মান উন্নয়ন বাড়াতে হবে। হল আধুনিকায়ন করতে হবে।
নওগাঁর স্থানীয় সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট ডিএম আব্দুল বারী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘এ হলটি শুধু নওগাঁতে নয় সমগ্র উত্তর বঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি হল ছিল। দুপুর ১২টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ৪টা করে শো চলতো এবং প্রত্যেক শোতে হলটি হাউজ ফুল থাকতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন দর্শকের জীবনমানের পরিবর্তন হয়েছে। তাদের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। যে মানের সিনেমা হওয়া উচিত, সময় অনুযায়ী সেটা খুবই কম হচ্ছে। দর্শক তার মনের মতো সিনেমা পাচ্ছে না। এছাড়া চারদিকে নানা প্রযুক্তির ছড়াছড়ি। মানুষ ঘরে বসে এখন সিনেমা দেখতে পাচ্ছে।’
তাজ সিনেমা হলের মালিক পরিতোষ সাহা বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘২০১০ সাল পর্যন্ত তাজ সিনেমা হল ভালোই চলছিল। এরপর ধীরে ধীরে এটা লোকসানের মুখে পড়ে। এর প্রধান কারণ দর্শকের উপস্থিতি কম। এছাড়াও সিনেমা হল চালিয়ে মালিকরা লাভবান হতে পারছেন না। শুধু লোকসান গুণতে হচ্ছে। তাই হল ভেঙে মার্কেট বা অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করছেন মালিকরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং পরিচালক সমিতি থেকে বিভিন্ন সময় আমাকে বিভিন্ন প্রকার সহায়তার জন্য আশ্বাস দিয়েছেন। তাদের সেই আশ্বাসে এবং সরকারিভাবে সারাদেশে ৩৬টি সিনেমা হলকে আধুনিকায়ন করা হবে বলে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাজ সিনেমা হলের নাম সেই তালিকায় প্রথম দিকে আছে। এখন আমরা, সরকার ও প্রযোজক সমিতির দিকে তাকিয়ে থেকে দিনের পর দিন লোকসান দিয়ে হলটি চালু রেখেছি।’
নওগাঁ জেলা প্রশাসক মো. হারুন অর রশিদ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘এক সময় সিনেমা হল ছিল মানুষের চিত্তবিনোদনের প্রধান ঠিকানা। প্রযুক্তি এবং আধুনিকতার সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা এখন মিলছে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। বিনোদনের সুযোগ সুবিধা এখন অবারিত এবং হাতের মুঠোয় হওয়ায় দর্শক এখন হল বিমুখ। তবে হলগুলোর আধুনিকায়নসহ সেবার মান উন্নয়ন করা হলে দর্শক হল মুখী হবে বলে আমার বিশ্বাস।’