সন্তান জন্মের এক বছর পর বাবা-মায়ের বিয়ে!
এক বছর আট দিন বয়সী হাবিবুর রহমান খান সিয়ামের মুখের ভাষা ফুটেনি। সামান্য হাঁটতে শিখেছে মাত্র। অনেক বাঁধা পেরিয়ে পৃথিবীতে এসেছে সে। সিয়াম যখন মাতৃগর্ভে তখনও তার বাবা-মায়ের বিয়ে হয়নি। অবিবাহিত নারীর পেটে সন্তান! বিষয়টি সমাজের লোকজন মেনে নিতে পারছিল না। কূল না পেয়ে আইনের দ্বারস্থ হন ১৯ বছর বয়সী মা আয়েশা আক্তার আনিশা। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে তিনি ফিরে পেলেন স্বামী ও সন্তানের স্বীকৃতি।
এক বছর ১ মাস ২৯ দিন ধরে কারাগারে বন্দী মো. স্বপন মিয়ার সঙ্গে শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে তিন লাখ টাকা দেনমোহরে সন্তান কোলে থাকা আয়েশার বিয়ে হয়েছে। আদালতের নির্দেশে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর অফিসকক্ষে ব্যতিক্রমী বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
স্বপন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ী ইউনিয়নের চিনাশুখানিয়া গ্রামের আব্দুল হকের ছেলে। আর একই গ্রামের ভ্যানচালক আব্দুল কাদিরের মেয়ে আয়েশা।
রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে আয়েশাদের বাড়িতে গিয়ে প্রথমে তাকে পাওয়া যায়নি। খুবই দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সন্তানকে কোলে নিয়ে বাড়িতে ফেরেন আয়েশা। কথা হলে তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেন, স্বামী স্বপনের হাজিরা ছিল আজ। আদালতের হাজতখানায় তার জন্য খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম।
বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেড় বছরের সম্পর্কের পর ২০১৮ সালের ৮ মার্চ আদালতে নিয়ে স্বপন তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের দেনমোহর ছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। সেই বিয়ের কোনো কাগজপত্র নেই। বিষয়টি কেউ জানতোও না। বাড়িতে না তুললেও বিভিন্ন স্থানে দেখা করে অধিকার আদায় করে নিত স্বপন। এক পর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ি। গর্ভের সন্তানের বয়স যখন আট মাস, তখন স্বপনকে এই কথা জানাই। স্বপন তখন গর্ভের সন্তানকে অস্বীকার করে। পরে জানতে পারি তার স্ত্রী ও তিন বছর বয়সী সন্তান রয়েছে।
তখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করবো। মুখে না বললেও পরিবারের সদস্যরা শারীরিক পরিবর্তনে বুঝে গেলো আমি গর্ভবতী। অনেক দেন-দরবার করেও আমাকে ও গর্ভের সন্তানকে মেনে নিচ্ছিল না স্বপন। অন্যদিকে সমাজের লোকজন আমাদের ঘরছাড়া করতে উঠে পরে লেগেছিল।
আরও পড়ুন: প্রেমের মিলন ঘটল কাশিমপুর কারাগারে
উপায় না দেখে প্রতিবেশী চাচা মোতালিবের পরামর্শে রাজাবাড়ী ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী সদস্য সুফিয়া বেগম ও গ্রামের মেম্বার কামরুজ্জামান ভূঁইয়া চানুর কাছে যাই। তাদের সহযোগিতায় ২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর শ্রীপুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা (নম্বর ৪৪) করি। পরে ১৮ ডিসেম্বর স্বপনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
স্বপন জেলে থাকা অবস্থায় ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি রাজেন্দ্রপুর মডার্ন হসপিটালে সিয়ামের জন্ম হয়। অনেক কষ্টে হতদরিদ্র বাবা হাসপাতালের বিল পরিশোধ করেছেন। ছেলে জন্মের পর মানুষের চাপ ও কটু কথা দ্বিগুণ বেড়ে যায়।
স্বপনের বড় ভাই রিপন বেপারি বার্তা২৪.কম-কে বলেন, এই ঘটনার পর স্বপনের প্রথম স্ত্রী সুচরিতা তার তিন বছরের ছেলে আলিফকে ফেলে রংপুরে বাবার বাড়ি চলে গেছে। ঘরে বউ রেখে স্বপন এ ঘটনা ঘটানোর পর আমাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্বপন গ্রেফতার হওয়ার পর তার পক্ষে জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে জামিন আবেদন করা হয়। কিন্তু আবেদন খারিজ হওয়ায় উচ্চ আদালতে স্বপনের জামিন চাওয়া হয়। পরে উচ্চ আদালত আগে বিয়ের নির্দেশ দেন। এখন বিয়ের কাগজপত্র উচ্চ আদালতে জমা দিলে স্বপনের জামিন মিলবে।
আয়েশার বাবা আব্দুল কাদির বলেন, আমার দুই মেয়ে। দিন আনি, দিন খাই। নিজের জায়গা জমি নাই। ঘরজামাই থাকি। বড় মেয়ে রত্নাকে একই গ্রামে বিয়ে দিয়েছি। আয়েশার জন্য মানুষের চাপে শেষ আশ্রয়স্থল ছাড়ার উপক্রম হয়েছিল। ভুল মানুষই করে -এই ভেবে সব মেনে নিয়েছি। আমি গরিব মানুষ। নাতি জন্মের পর খরচ বেড়ে গেছে। বাচ্চার দাদা বাড়ি থেকে কোনো সহযোগিতা করা হয়নি। আদালতের নির্দেশে বিয়ে হওয়ায় আমরা খুশি। এখন স্বামী-সন্তান নিয়ে মেয়েটি সুখে থাকলেই বাঁচি।
আয়েশার খালাত বোন সাবিনা আক্তার বার্তা২৪.কম-কে জানান, বিয়ের নির্দেশনার খবর পেয়ে আয়েশাকে নিয়ে তিনি ছাড়াও আয়েশার বাবা আব্দুল কাদির, স্বপনের বাবা আব্দুল হক, মা নূর জাহান ও স্বপনের বোন জামাই কারাগারে যান। অফিসকক্ষে বিয়ে পড়ানোর পর কারাগারের কর্মকর্তাদের তারা মিষ্টিমুখ করিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট কারাগারের জেলার বাহারুল ইসলাম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, হাজতি স্বপনের সঙ্গে মামলার বাদী আয়েশাকে বিয়ে দিতে গত ২৮ জানুয়ারি উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা পাঠানো হয়। আদেশের কপি প্রথমে যায় গাজীপুর জেলা কারাগারে। সেখান থেকে অর্ডারটি গত ১৩ ফেব্রুয়ারি কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছায়। এরপর দুই পক্ষের পরিবারের সদস্যদের খবর দিয়ে কারাগারে আনা হয়। তাদের উপস্থিতিতেই বিয়ে পড়ান স্থানীয় কাজী আশরাফুল আলম।
তিনি আরও বলেন, আদালতের সহায়তায় বাদী আয়েশা ভবিষ্যৎ জীবনের নিশ্চয়তা পেল। সমাজে এতদিন সে পরিচয় দিতে পারতো না। এখন মায়ের পাশাপাশি শিশুটিও পিতৃ পরিচয় পেল। এটি অবশ্যই একটি পজেটিভ বিষয়। চাকরি জীবনে কারাগারে বিয়ের ঘটনা খুব কমই পেয়েছি।