রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে ডাকাতদলের সশস্ত্র তৎপরতা
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে বেশকিছু ডাকাতদের সংঘবদ্ধ গ্রুপ (দল)। চিহ্নিত ডাকাত আব্দুল হাকিমের অনুসারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছে এসব দলের। মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় দিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন স্থানীয়রা। পাশাপাশি সাধারণ রোহিঙ্গারাও রয়েছে এসব ডাকাতদের হুমকি-ধামকিতে।
ক্যাম্পের একাধিক সূত্র বলছে, টেকনাফের শালবাগান, নয়াপাড়া, লেদা, পালংখালী, থ্যংখালীসহ বিভিন্ন ক্যাম্প ভিত্তিক স্বশস্ত্র রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তদের তৎপরতা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্যাম্পে নিয়োজিত ব্লক মাঝি ও কতিপয় ভলান্টিয়াররা এসব ডাকাতদের সোর্স হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। যার ফলে প্রশাসনের অভিযানের খবর দ্রুত পেয়ে যায় ডাকাত দল। এছাড়াও প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় বাণিজ্যে সাধারণ রোহিঙ্গারা অতিষ্ঠ হওয়ার পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশে-পাশের পাহাড়ে অবস্থানরত ডাকাত জকির গ্রুপ, ছৈয়দ হোছন ওরফে পুতিয়া গ্রুপ, খাইরুল আমিন গ্রুপ, সালমান শাহ গ্রুপ, মোঃ শফি গ্রুপ, আনোয়ার গ্রুপ, নুর হোছন গ্রুপ, মোঃ ইসলাম ধইল্যা গ্রুপ, নুরুল ইসলাম ওরফে নুর সালাম গ্রুপের সদস্যদের স্বশস্ত্র মহড়া চলমান। এসব ডাকাত গ্রুপের লিডাররা শীর্ষ ডাকাত সরদার আব্দুল হাকিম ওরফে হাকিম ডাকাতের নির্দেশ মেনে চলে। হাকিম ডাকাতের তৎপরতায় এসব গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্রটি আরও জানায়, স্বশস্ত্র গ্রুপ পাহাড় থেকে নেমে ক্যাম্পে এসে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ অস্ত্র বেচা-বিক্রি, ভাড়াটে খুনি, অপহরণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্যের পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্রের মহড়া দিয়ে যাচ্ছে। বলতে গেলে রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছে এই ডাকাত চক্র ও তাদের সহযোগীরা। এসব ডাকাতদের হাতে হামলার শিকার হয়েছে আইশৃঙ্খলাবাহিনীর একাধিক সদস্যও।
রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের মধ্যে এখন সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জকির বাহিনী। মূলত মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সশস্ত্র জকির বাহিনী। এই বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছে নয়াপাড়া রেজিস্ট্রার ক্যাম্পের সি ব্লকের হাজী আঃ আমিনের ছেলে জকির (২৮)। অত্যাধুনিক দেশি-বিদেশি ২০টিরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত এই বাহিনীতে আরো অন্তত ৩০ জন সদস্য রয়েছে। এ বাহিনীর হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ২ র্যাব সদস্য। আহত হয়েছেন আরো অন্তত ১২ র্যাব সদস্য। জকির বাহিনীর গুলিতে আহতের তালিকায় রয়েছে অর্ধশত রোহিঙ্গাও।
গত ৩০ ডিসেম্বর টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরের পাশে জকিরের নেতৃত্বে তার বাহিনীর সদস্যরা র্যাব সদস্যদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এ সময় কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর সিপিসি-২ হোয়াইক্যং ক্যাম্পের সদস্য সৈনিক ইমরান ও কর্পোরাল শাহাব উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়। বিদেশি অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে র্যাবের ওপর এ হামলা চালানো হয়। দুই র্যাব সদস্যকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে একাধিক অপারেশন করেও শরীর থেকে এখনো গুলি বের করা সম্ভব হয়নি।
কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর সিপিসি-২ হোয়াইক্যং ক্যাম্পের ইনচার্জ (এএসপি) শাহ আলম বার্তা২৪.কমকে জানিয়েছেন, গত ৩০ ডিসেম্বর গোপন তথ্যে’র ভিত্তিতে শীর্ষ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান জকিরকে ধরতে অভিযান চালানো হয়। ঐ সময় জকির ও তার বাহিনীর সদস্যরা র্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে দুই র্যাব সদস্য গুলিবিদ্ধ হন।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি টেকনাফের নয়াপাড়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হামলা করে জকির বাহিনী। জকির ও তার বাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গা শিবিরে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় । এই সময় শিশুসহ ১৫ রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ হয়।
গত মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) ভোরে টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবিরে অভিযানে গেলে আবারও র্যাবকে টার্গেট করে হামলা করে জকির বাহিনী। এতে অন্তত ১২ জন র্যাব সদস্য আহত হয়। র্যাবের গুলিতে মারা যায় জকির বাহিনীর সদস্য ইলিয়াছ ডাকাত। সে টেকনাফের-২৬ নম্বর ক্যাম্পের ডি-ব্লকের বাসিন্দা। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে একটি বন্দুক, একটি ওয়ানশুটার গান ও চারটি তাজা কার্তুজ উদ্ধার করা হয়।
কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক উইন কমান্ডার আজিম আহমেদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, জকির বাহিনী এখন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সশস্ত্র। তাদের হাতে একাধিক অত্যাধুনিক বিদেশি অস্ত্র আছে। তারা মূলত ইয়াবা পাচার, ক্যাম্পের অভ্যন্তরে চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুনসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজে জড়িত। এই বাহিনীকে ধরতে র্যাবের অভিযান অব্যাহত আছে। যে কোন ভাবেই এই বাহিনীর প্রধান জকিরসহ বাহিনীর সবাইকে ধরতে র্যাব অভিযান শুরু করেছে।
এদিকে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসেন বার্তা ২৪.কমকে বলেন, শুধু ডাকাত নয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। মাঝে-মধ্যে এসব ডাকাত দলের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। দুর্গম এলাকায় অবস্থান করার ফলে তাদের আটকে দীর্ঘ সময় লাগছে। তবে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে।