২১ বছরেও সম্পন্ন হয়নি উদীচী হত্যা মামলার বিচারকাজ
যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে দেশে প্রথম জঙ্গি হামলা হয়। উদীচী ট্র্যাজেডির ২১ বছরেও মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হয়নি।
১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ গভীর রাতে যশোর টাউন হল মাঠে উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দুটি শক্তিশালী বোমা হামলা হয়। হামলায় ১০ জন নিহত হন।
হামলার পর রক্তাক্ত মানুষের ভিড়ে পড়েছিল নাহিদের দেহটিও। চিকিৎসায় বেঁচে উঠলেও কেটে ফেলতে হয় তার দুটি পা। হামলাকারীদের সুষ্ঠু বিচার দেখার স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে পঙ্গু নাহিদের কাছে। টগবগে সেই তরুণ যুবকের চুলে পাক ধরেছে।
সেই বোমা বিস্ফোরণের নিজের ডান পা হারান সংস্কৃতিকর্মী সুকান্ত দাস। লিখতে পারেন না ডান হাতে, ডান কানে শুনতেও পারেন না। বাম হাতেই লেখা, বাম হাতেই খাওয়া—এমন প্রতিকূলতার মাঝেই অর্জন করেছেন উচ্চতর ডিগ্রি। তারপরও বোমা হামলায় জড়িতদের শনাক্ত করতে না পারায় বুকভরা যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। একুশ বছরেও বিচার হয়নি, মরার আগে অন্তত ঘাতকদের বিচার দেখে যেতে চান তিনি।
শুধু সুকান্ত দাস কিংবা নাহিদ নয়, সেদিনের ট্রাজেডিতে নিহতের পরিবার, আহত ও সংস্কৃতিকর্মীদের দাবি— ঘাতকদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।
উদীচী ট্র্যাজেডিতে নিহত হন নূর ইসলাম, নাজমুল হুদা তপন, সন্ধ্যা রানী ঘোষ, ইলিয়াস মুন্সী, শাহ আলম বাবুল, বাবুল সূত্রধর, শাহ আলম, বুলু, রতন রায় ও রামকৃষ্ণ। আহত হন আড়াই শতাধিক মানুষ।
উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলা মামলা প্রসঙ্গে যশোর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এম ইদ্রিস আলী বার্তা ২৪.কমকে বলেন, উদীচী হত্যা মামলাটি উচ্চ আদালতে আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। আপিল শুনানি নিষ্পত্তি হলেই নিম্ন আদালতে বিচারকাজ শুরু করা যাবে। আমি নতুন দায়িত্ব পেয়েছি। দ্রুত বিচার শুরুর ব্যাপারে আমি তৎপর হব।
জানা যায়, ১৯৯৯ সালে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলার ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়। প্রথমে কোতয়ালী পুলিশ মামলার তদন্ত শুরু করলেও পরবর্তীতে তা সিআইডির ওপর ন্যস্ত হয়। তদন্ত শেষে ওই বছরের ১৪ ডিসেম্বর বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামসহ ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। পরবর্তীতে চার্জ গঠনের সময় উচ্চ আদালতে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তরিকুল ইসলামকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। চাঞ্চল্যকর এ মামলা আদালতে গড়ানোর ৭ বছর পর ২০০৬ সালের ৩০ মে মামলার রায় দেন আদালত। রায়ে সব আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। মামলার এমন রায়ে যশোরসহ সারাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বিস্মিত হন।
এদিকে, দেশের আলোচিত জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান আটক হওয়ার পর পুলিশের কাছে প্রদত্ত জবানবন্দিতে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার কথা স্বীকার করেন। তার জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে উদীচী হত্যা মামলার পুনঃতদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মুফতি হান্নানের উদীচী হত্যাযজ্ঞ সংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর জবানবন্দির পর উদীচী হত্যা মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয় সরকার।
এই মামলার রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে আবেদন করা হয়। পরবর্তীতে এই হত্যা মামলায় মুফতি হান্নানকে যশোরে এনে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। ২০১০ সালের ৮ জুন ওই আপিল আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
বিচারপতি সিদ্দিকুর রহমান মিয়া ও কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে শুনানির পর আসামিদের বক্তব্য জানতে চেয়ে বিচারিক বেঞ্চ নোটিশ জারির আদেশ দেন। হাইকোর্ট থেকে জারিকৃত এ সংক্রান্ত নথিপত্র ২০১০ সালের ২৬ জুলাই যশোরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এসে পৌঁছায়।
এরপর উচ্চ আদালতের নির্দেশে খালাস পাওয়া আসামিরা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন। সিআইডির ত্রুটিপূর্ণ চার্জশিটের কারণে ২০০৬ সালের ৩০ মে আদালত থেকে খালাস পেয়ে যায় এই মামলার সব আসামি। পরে সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। কিন্তু এরপর মামলাটির আপিল শুনানি আর হয়নি। আটকে আছে আইনের বেড়াজালে। বিচারের এই দীর্ঘ বিড়ম্বনায় ক্ষুব্ধ যশোরের মানুষ এখন দ্রুত এ মামলার কার্যক্রম চালু করার দাবি জানান।
যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠন চাঁদেরহাটের সভাপতি ও জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহ-সভাপতি ফারাজী আহমেদ সাঈদ বুলবুল বার্তা২৪.কমকে বলেন, মামলাটি পুনঃতদন্তের দাবি করছি। তদন্তের দায়িত্ব পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) দেওয়া হোক। অনেক ক্লুলেস মামলার রহস্য উদঘাটনে সফল হয়েছে পিবিআই।
এদিকে চাঞ্চল্যকর উদীচী বোমা হামলা ট্রাজেডির ২১ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। কিন্তু দীর্ঘ এ সময়েও বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের মূল ঘাতকদের। বর্তমান সরকার নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞের ঘটনার পুনঃতদন্তের কাজ শুরু করলেও থমকে গেছে সেটাও। সেদিনের নারকীয় হামলায় নিহত উদীচীকর্মী তপনের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বাড়িটিও দখলের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ সবাই।