শিল্পী মুর্তজা বশীরের মহাপ্রস্থান

  • শিমুল সালাহ্উদ্দিন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

শিল্পী মুর্তজা বশীর

শিল্পী মুর্তজা বশীর

চলে গেলেন বরেণ্য শিল্পী মুর্তজা বশীর। আমাদের শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বরেণ্য এই শিল্পী শুধুমাত্র নিজের সৃজন অন্বেষণ আটকে রাখেননি ছবি আঁকায়। শিল্পের নানা শাখায় নিমগ্ন করেছেন নিজেকে। লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাস ও কবিতা। নিজের লেখা কবিতাগ্রন্থ ‘টাটকা রক্তের ক্ষীণরেখা’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন নিজেই। ছোটগল্প ‘কাচের পাখির গান’ (১৯৬৯), উপন্যাস ‘আলট্রামেরীন’ (১৯৭৯), কবিতা ‘ত্রসরেণু’ (১৯৭৬), ‘তোমাকেই শুধু’ (১৯৭৯), ‘এসো ফিরে অনসূয়া’ (১৯৮৫), বিবিধ বিষয়ে নির্বাচিত লেখা ‘মুর্তজা বশীর : মূর্ত ও বিমূর্ত’ (২০০১), গবেষণা গ্রন্থ ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ’ (২০০৪), গল্পগ্রন্থ ‘মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যে, অমিতাক্ষর’ (২০০৮) এবং ‘গল্পসমগ্র’ (২০০৮) প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি গবেষণা প্রবন্ধ উপমহাদেশের বিভিন্ন জার্নালে ছাপা হয়, যা তাকে একজন নিবিড় গবেষক হিসেবে স্বীকৃতি ও খ্যাতি দিয়েছে। ছবি আঁকার পাশাপাশি তার সাহিত্যকর্মও সমান কৃতিত্বের দাবি রাখে। ১৯৫৪ সালে গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস থেকে চিত্রকলা ও ড্রইং নিয়ে প্রথম বিভাগে পাস করেন। ১৯৫৬-৫৭ সালে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে চিত্রকলা এবং ১৯৫৭-৫৮-তে ফ্রেসকো নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। ফ্লোরেন্সের গ্যালারি লা পারমানেন্তেতে ১৯৫৮ সালে তাঁর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। দেশে ও বিদেশে তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনীর সংখ্যা ২০টি। তাঁর ম্যুরাল চিত্রের সংখ্যা ৭টি। ১৯৭৩ সালের আগস্টে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং সেখান থেকে অবসরগ্রহণ করেন।

১৯৬৩ থেকে ১৯৬৪, প্রায় আড়াই বছর চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে জড়িত থেকে কোনো ছবি আঁকেননি তিনি। হুমায়ুন কবীরের উপন্যাস ‘নদী ও নারী’র চিত্রনাট্য লিখতে গিয়ে অনেক পরিবর্তন করে যখন দিল্লিতে তাঁর কাছে পাঠানো হয়েছিল তখন দ্বিধা থেকে যায়, তিনি অনুমতি দেবেন কি-না। শুধু অনুমতি নয়, হুমায়ুন কবীর চিত্রনাট্যের প্রশংসাও করেছিলেন। পরিচালক জহির রায়হানের জন্যও চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন। কিন্তু চলচ্চিত্র শিল্প থেকে তিনি সম্পর্ক ছিন্ন করে আবার ছবি আঁকায় যুক্ত হলেন। কখনো থেমে থাকেননি বাংলাদেশের শিল্প ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্পী।

বিজ্ঞাপন

ইংরেজি সাহিত্য পড়তে শুরু করেছিলেন ষাটের দশকে, সেই সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যও। একবার তো স্প্যানিশ কবি গার্সিয়া লোরকার কবিতার চরণকে অবলম্বন করে এঁকেছিলেন ছবি। বিচিত্র জীবনের মুর্তজা বশীর টেনে নিয়ে যায় আমাদের। তাঁর সামগ্রিক জীবনটি আমাদের অনুভূতিকে অধিকার করে ফেলে। আমরা আক্রান্ত হতে থাকি। কিন্তু তিনি সৃষ্টি করেন নতুন কোনো বিষয়ের অমর সব চিত্রকর্ম। এভাবে ভ্রমণশীল মুর্তজা বশীর এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়কে এঁকে বিমোহিত করে রাখেন আমাদের। নিরন্তর তিনি নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে থেকেছেন প্রবহমান এবং ব্যতিক্রমী। বছর পাঁচেক ধরেই ভুগছিলেন লাংসের সমস্যায়। লোকসান্নিধ্যে যেতে পারেন না মানুষের নিঃশ্বাসনিঃসৃত কার্বন ডাই অক্সাইড ক্ষতিকর বলে। সর্বক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে নিঃশ্বাস নিতে হতো। করোনা কেড়ে নিল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রথম দিকের শিক্ষার্থী, বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের বড় শিল্পী মুর্তজা বশীরকে।

বরেণ্য এই শিল্পীর মৃত্যুর খবর জাতীয় শোক দিবসেও আরো এক ভারী শোকের ছায়া নামিয়ে আনে শিল্পানুরাগীদের মধ্যে। বরেণ্য শিল্পী, শিল্পানুরাগী ও শিল্পীর কাছের মানুষদের সাথে কথা বলেছেন বার্তা২৪ এর স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট শিমুল সালাহ্উদ্দিন।

বিজ্ঞাপন

রফিকুন নবী
শিল্পী

শিল্পী মুর্তজা বশীর আমাদের শ্রেষ্ঠতম শিল্পীদের অন্যতম। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি শিল্পে নিমগ্ন ছিলেন। একটা কথা না বললেই নয়, পঞ্চাশ দশকের শুরুতে যখন নতুন আর্টকলেজ, সেকেন্ড ব্যাচের ছাত্র তিনি। উনি তাদের একজন যাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের শিল্পকলা দাঁড়িয়েছে, আজকের অবস্থানে এসেছে। উনি, রশিদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, কাইয়ুম চৌধুরী, পুরা ব্যাচটাই ছিল ব্যাপক মেধাবী একটা ব্যাচ। সেই সময়ে তাঁরা ভর্তি হয়েছিলেন চারুকলায় যখন আর্থিক-সামাজিক কোনো নিরাপত্তা ছিল না শিল্পচর্চায়।

আমার ভাবলে অবাক লাগে, সেই সময়ে উনি ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে হয়ে, নানা জায়গায় দ্বার খোলা থাকার পরও শিল্পকলায়ই এসেছেন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জেনেও। এটা বিরাট সাহসের কাজ। আর উনি বেশি কাজ করেছেন বিমূর্ত শিল্পকলা নিয়ে। উনার শিল্পকর্ম আমাদের শিল্পভুবনে অসামান্য সংযোজন, পৃথিবীর শিল্পভুবনেও আমি মনে করি উনার মতো ভালো কাজ খুব কম আছে। একজন সমাজসচেতন, দেশ সচেতন ও একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন তিনি।

শিল্পী রফিকুন নবী

পঞ্চাশ দশকে যখন তিনি ছাত্র, তখন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে উনার সক্রিয় ভূমিকা ছিল, উনি মিছিলের সম্মুখ সারিতে ছিলেন, বরকত গুলিবিদ্ধ হবার পর উনিই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলেন। বরকতের রক্তাক্ত জামা তার হাতে ছিল। উনার এই অকুতোভয় ব্যাপার আমাদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে ছিল। পঞ্চাশ দশকে উনার এই উদাহরণ শিল্পীদের পরবর্তী নানা আন্দোলেন উদ্বুদ্ধ করেছে। সেইটা কিন্তু বশীর ভাই ও অন্যান্য যারা ছিলেন তাদের কাছে পাওয়া। উনি শিল্পকলার শিক্ষা দিয়েছেন, প্রশাসন চালিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। উনি এটাও শিখিয়েছেন শিল্পীদের প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে রয়েছে। এইসব শিক্ষা কিন্তু বশীর ভাইরা আমাদের আদর্শিকভাবে শিখিয়েছেন। উনাদের ভূমিকাকে আমরা আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছি। উনি একাধারে চিত্রকর, লেখক। একটা পারিবারিক ব্যাপার ছিল ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে হিসেবে, তার সাথেও ছিল অনেক অনেক গুণ, মুদ্রাসংগ্রহ, টেরাকোটা এসব নিয়ে উনার কাজ অসামান্য। এবং সেসব নিয়ে নিয়ে উনার লেখালেখি, গবেষণা, দারুণ ইতিহাস রচনার ব্যাপার। বশীর ভাইয়ের যে বশীর ভাই হয়ে ওঠা, ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উনারা, শিল্পী সাহিত্যিক সংগীতশিল্পী রাজনীতিবিদ সবাই একসাথে ওঠাবসা করতেন। হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, আলতাফ মাহমুদ এই যে সবার মিথস্ক্রিয়া এসব থেকেই ত আমরা শিক্ষা নিয়েছি। স্বাধীন রাষ্ট্রে বড় শিল্পী হিসেবে উনাকে আমাদের আরো অনেক সম্মান দেওয়া দরকার ছিল, সেইটা হয়তো আমরা পারি নাই। উনি লেখাপড়া করেছেন দেশের বাইরে, দেশে এসে সেই আলোতে আমাদের দেশের শিল্পীদের আলোকিত করেছেন। আধুনিক চিত্রকলা চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। উনার মৃত্যুতে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। উনার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা রইল।


সমরজিৎ রায় চৌধুরী
শিল্পী

শিল্পী হিসেবে তিনি অসামান্য ছিলেন। সবার কাছেই সমাদর পেয়েছেন। যারা শিল্পটা বোঝেন। মানুষ হিসেবেও কখনো কোনো খারাপ কিছু শুনিনি আমি। আমার সঙ্গেও খুব ভালো হৃদ্যতা ছিল। কাজের কথা কি বলব, সবাই জানে যে উনি একজন খুবই উঁচুদরের শিল্পী। আমার সিনিয়র ছিলেন চারুকলায়, প্রায় পাঁচ-ছয় বছরের সিনিয়র ছিলেন। উনি কাইয়ুম ভাইয়ের (শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী) ক্লাসমেট ছিলেন।

শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী

উনি একজন অসামান্য শিল্পবোদ্ধা ছিলেন, যেমন বুঝতেন, তেমন বলতেও পারতেন। উনার কর্ম দিয়েই সবাই উনাকে মনে রাখবে, উনার কাজ অত্যন্ত ভালো মাপের। এই বয়সেও উনি যে অসাধারণ বক্তব্য দিতেন, তা ভাবা যায় না। প্রচুর ভালো লেখা আছে উনার। উনি কাজকর্ম নিয়েই থাকতেন সবসময়, এবং বেশ ভালো কাজ করতেন। এইটাতে কোনো সন্দেহ নাই তিনি আমাদের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের একজন। মানুষ তাকে তাঁর কাজ দিয়েই চিরদিন মনে রাখবে।


মনিরুল ইসলাম
শিল্পী

আমার খুবই শ্রদ্ধার মানুষ ছিলেন মুর্তজা বশীর। আমাদের খুব আর্গুমেন্ট হতো। উনার একটা বিরাট গুণ ছিল হি ক্যান টক অন আর্ট এন্ড অলসো আর্ট অফ টকিং। দুইটা দুই জিনিস। সুন্দরভাবে গুছায়া কথা বলা আর্ট অফ টকিং। এবং এনাদার থিং, উনার কন্টেমপোরারি আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন এন্ড থিংকিং দুর্দান্ত ছিল।

হি ওয়াজ অলয়েজ আপডেটেড উইথ মডার্ন আর্ট। উনাদের জেনারেশন আমাদের শিল্পকলায় ইমপোর্টার অফ এবস্ট্রাক্ট আর্ট। হি ইজ আ লিজেন্ড পারসন। অনেক দিন ধরে অসুস্থ থাকার পরও আমাদের কাছে উনি বিরাট প্রেরণার মানুষ ছিলেন। হি ইজ আ ভেরি কারেজিয়াস পেইন্টার, বলতে হবে যে মডার্ন অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের পায়োনিয়ার একজন তিনি, এর মধ্যে কিবরিয়াও আছে, শফিউদ্দিন সাহেব আছেন। উনার কাজের মধ্যে আমার দেখা, ওয়াল সিরিজ, ওহ হোয়াট এন এক্সিবিশন। তখন কোনো গ্যালারি ছিল না, এক্সিবিশন হয়েছিল প্রেস ক্লাবে। আমরা ঐ এক্সিবিশন বারবার দেখতাম ঘুরে। একমাত্র পেইন্টার কোনোদিন কম্প্রোমাইজ করেন নাই। অভ্যাসের বাইরে যাওয়াটা শিল্পীর জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। বারবার নতুন কিছু করেছেন তিনি। তার বৈচিত্র ঈর্ষা করার মতো। অ্যাজ এন আর্টিস্ট তিনি অডিয়েন্সের সাথে কোনো কম্প্রোমাইজ করেন নাই।

শিল্পী মুর্তজা বশীরের সাথে শিল্পী মনিরুল ইসলাম

একটা টাইমে শিল্পী কন্ডিশনড হন ক্রিটিক, আর্টলাভার, গ্যালারির সাথে—এসবকে তিনি উনার কাজ দিয়া সবসময় বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিছেন। হ্যাবিটের বাইরে তিনি সবসময় গেছেন, মুর্তজা বশীর ইজ ভেরি পাওয়ারফুল ইন্টেলেকচুয়াল অফ ক্রিয়েটিভ প্রসেস। লিখেছেন, কবিতা, গদ্য কতকিছু। জেনেটিকালিও উনার বেসমেন্ট খুব স্ট্রং ছিল। তার এই চলে যাওয়া আমাদের জন্য বিরাট ক্ষতি। উনি একটা বড় ইন্সপিরেশন ছিলেন আমাদের।


নিসার হোসেন
শিল্পী, ডিন, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পের যে চর্চা আজ বিশ্বের মূল শিল্পধারার সমান্তরালে চলছে সেটার সূচনা হিসেবে আমরা ধরি ১৯৪৮ সালকে যখন ঢাকায় একটি আর্ট স্কুল স্থাপিত হয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের উদ্যোগে। তাঁকে সহায়তা করেছিলেন কামরুল হাসান, শফিউদ্দীন আহমেদ প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীরা। মুর্তজা বশীর ১৯৪৯ সালে চারুকলার এই আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং উত্তীর্ণ হন ১৯৫৪ সালে। এই সময়টাতে তার সঙ্গে ও তার আগে পরে যারা এই স্কুল পড়াশোনা করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই আমাদের দেশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী এবং আধুনিক শিল্পের বিকাশে সবাই রেখেছেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সবসময়ই তাঁর ছাত্রদের খুব অনুপ্রাণিত করতেন সমকালীন বিশ্বের শিল্পধারা সম্পর্কে জানার জন্য, ইউরোপ আমেরিকায় যাবার জন্য। আমরা দেখেছি হামিদুর রহমান আর্ট স্কুলের ছাত্র থাকার সময়ই ফ্রান্সে গিয়েছিলেন পড়াশোনার জন্য, আমিনুল ইসলাম ১৯৫৪ সালে আর্ট স্কুল থেকে পাশ করেই ইটালিতে চলে গিয়েছিলেন এবং আমীরুল ইসলামের একজন ভক্ত ছিলেন মুর্তজা বশীর। তাঁরা দুজনেই খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন আমৃত্যু।

আধুনিক শিল্পের অগ্রগতিতে মুর্তজা বশীরের যে অবদান তার পেছনে আমিনুল ইসলামের বেশ বড় ভূমিকা এবং অনুপ্রেরণা ছিল। আমরা দেখি যে আমিনুল ইসলাম ইটালিতে যে প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছিলেন, মুর্তজা বশীরও সেই একই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন এবং তিনিও আমিনুল ইসলামের মতো ম্যুরাল এবং পেইন্টিং—এ দুটো বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন সেখানে। একটা বিষয় আমাদের খেয়াল রাখতে হবে এখানে যে, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, রচিত চৌধুরী এঁরা প্রত্যেকেই খুব আলোকিত পরিবার থেকে এসেছেন এবং প্রত্যেকেই শিল্পচর্চার পাশাপাশি জ্ঞানচর্চা করতেন। এই বিষয়টি আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ আধুনিক শিল্পের চর্চার জন্য যে শিল্পীর নিজের আধুনিক হয়ে উঠবার প্রয়োজন আছে, মন মানসিকতা সবদিক থেকে আলোকিত মানুষ হবার প্রয়োজন আছে এটা তাঁরা গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন ও চর্চা করতেন। এবং আমরা জানি যে এঁরা সবাই ছিলেন আলোকিত মানুষ, মুর্তজা বশীর ছিলেন তাঁদের এই প্রজন্মের মধ্যে সর্বশেষ যিনি প্রয়াত হলেন। এর মাধ্যমে বলা যায় একটি যুগের সমাপ্তি ঘটল।

শিল্পী নিসার হোসেন

মুর্তজা বশীর কিন্তু শুধু ছবিই আঁকেননি, তিনি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অসংখ্য ম্যুরাল তৈরি করেছেন এবং তাঁর গবেষণার পরিধি ছিল খুবই বিস্তৃত। সুলতানি আমলের মুদ্রা নিয়ে তাঁর খুব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা আছে যা এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রদেরকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে পড়তে বলা হয়।

মুর্তজা বশীর পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, কবিতাও লিখেছেন এমনকি চলচ্চিত্রের সাথেও তাঁর যোগ ছিল। একজন জ্ঞানী মানুষের যেমন সবদিকেই জ্ঞান বিকাশের তাড়না থাকে মুর্তজা বশীর ছিলেন ঠিক সেরকম, সবদিকেই তাঁর আগ্রহ ছিল। সত্যি কথা বলতে গেলে তাঁর মতো এরকম সব বিষয়ে দক্ষতা নিয়ে কাজ করার মতো শিল্পী আমরা আর কাউকে পাইনি। এটা ছিল ওনার একটি বিরাট অর্জন। তাঁর এই বিস্তৃত কর্মপরিধির জন্য তাঁর অস্তিত্ব সবার কাছে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি একজন অসাধারণ শিক্ষকও ছিলেন এবং আমরা যে-ই তাঁর কাছে যেতাম, এই শিক্ষকসুলভ আচরণ পেতাম, অনেককিছু শিখতে পারতাম। আমরা খুব গর্বিত যে আমাদের এই চারুকলা থেকেই তিনি অধ্যয়ন করে গেছেন এবং তিনি নিজেও খুব গর্বের সাথে এটা বলতেন যে তিনি জয়নুল আবেদিনের ছাত্র ছিলেন, ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউটের ছাত্র ছিলেন। আমরা এটা ভাবতে পেরে তৃপ্ত যে তাঁর জীবিত অবস্থায়ই আমরা তাঁকে জয়নুল সম্মাননা দিয়ে সম্মানিত করতে পেরেছি। তাঁর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত এবং তাঁর পরিবার ও স্বজনদের প্রতি আমরা গভীরভাবে সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।


গৌতম চক্রবর্তী
শিল্পী ও স্বত্বাধিকারী, গ্যালারি কায়া

প্রথমত তিনি অনেক বড় মাপের শিল্পী এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। দেশবিভাগের পরে যে মানুষগুলি এই অঞ্চলে একত্রিত হলেন, মুর্তজা বশীর, আমিনুল ইসলাম, কবি শামসুর রাহমান, খান আতাউর রহমান, জহির রায়হান—এনারা একেকটা দিকপাল যার যার কাজের জায়গায়, এরা কিন্তু প্রতিদিন না হলেও অলটারনেট ডে তে আড্ডা মারতেন, গল্প করতেন। যতটুকু আমি আমার আবাল্য দেখে এসেছি, যেহেতু আমার বাবা উনাদের বন্ধু ছিলেন, সেখানে কিন্তু চিত্রকলা, সাহিত্য, আপনার রাজনীতি দর্শন প্রত্যেকটা শাখাই উচ্চারিত হতো। এজন্যই মুর্তজা বশীর প্রথমদিকে কিন্তু ফিল্মে যুক্ত হয়েছিলেন, চিত্রনাট্য লিখেছেন, সেটে ডিরেকশন দিয়েছেন।

তারপর দেখেন তার কত দিক, তিনি হাবশী সুলতানদের ওপর গবেষণা করেছেন, উনি পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরের ট্যারাকোটা, প্রাচীন মুদ্রা নিয়ে গবেষণা করেছেন। উনি অ্যাভিড কালেক্টর ছিলেন স্ট্যাম্পের, অ্যাভিড কালেক্টর ছিলেন মুদ্রার। উনার যে বিখ্যাত লিনোকাট, ব্লাডি টুয়েন্টি ফার্স্ট, সেই মিছিলে কিন্তু উনি ছিলেন, এমন না যে বারান্দা থেকে দেখে উনি সেটা করেছেন, ঐ গুলি কিন্তু উনার বুকেও লাগতে পারত। তার মানে এই মানুষগুলো কিন্তু যা চেয়েছেন তা মনে প্রাণে চেয়েছেন। এবং সেই জিনিসগুলোকে তাঁরা কবিতায়, চিত্রকলায় তুলে এনেছেন।

শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী

বশীর চাচা কিন্তু প্রাউডলি বলতেন, গৌতম দেখো আমি কিন্তু না দেখে ছবি আঁকতে পারি না। আমার কিন্তু দেখে ছবি আঁকতে হয়। উনি বলেছেন, জানো আমার যে এপিটাফ সিরিজটা, সবকিন্তু আমি পাথর দেখে দেখে করেছি এবং সব পাথরগুলি আমার কাছে আছে। উনি যখন ওয়াল সিরিজ করলেন, তিনি প্রত্যেকটা ওয়াল দেখেছেন, তারপর তিনি এঁকেছেন। ফলে জীবনের সাথে উনাদের ঘনিষ্ঠতাটা অনেক বেশি ছিল। যা মুর্তজা বশীরের চিত্রকলায়ও ট্রান্সলেটেড হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে জীবনের একেবারে মৌল অভিজ্ঞতার নির্যাসকেই তাঁরা কাজে তুলে আনতে পেরেছেন।

শিল্পাচার্যের মন্বন্তরের ছবিগুলি যদি দেখেন, এসব কিন্তু চোখ দিয়ে দেখা ছবি, কান দিয়ে শুনে আঁকা ছবি নয়, ফলে আমি মুর্তজা বশীরকে আমাদের দেশের অনেক বড় শিল্পী মনে করি। এবং মনে করি এই মানুষগুলোকে নিয়ে এবং সার্বিক শিল্পকলা নিয়ে আরো অনেক বড় ধরনের কাজ করার সুযোগ আছে, এবং সেই পরিসর পেলে সেটা আমি হই বা অন্য কেউ হোক করবেই একদিন না একদিন। বড় করে আমরা মুর্তজা বশীরকে নিয়ে কাজ করতে পারব এবং সেটা খুব বড় গর্বের বিষয় হবে বাংলাদেশের জন্য। আমাদের গ্যালারি কায়ারও কিছু বড় পরিকল্পনা আছে বশীর চাচার কাজ নিয়ে।


আনিসুজ্জামান সোহেল
শিল্পী

মুর্তজা বশীরের মতো বড় শিল্পীকে আমরা কতটা মূল্যায়ন করতে পেরেছি তা নিয়ে একজন শিল্পী হিসেবে আমার আসলে কিঞ্চিত আক্ষেপ আছে, ক্ষোভও। আমি উনাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করি, উনার কাজের ক্ষেত্র বিস্মৃত, বারবার নিজেকে পাল্টেছেন। আমিনুল ইসলাম ইয়াং আর্টিস্ট এওয়ার্ডটা আমার জীবনের মোড় পাল্টে দিয়েছিল। ঐ পুরস্কারের বিচারক ছিলেন মুর্তজা বশীর। আমার কাজ এতই পছন্দ করেছিলেন যে, অনুষ্ঠানের শেষে উনি আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, দমটা ধরে রেখো। এটা আমার জন্য যে কত বড় অনুপ্রেরণা ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

শিল্পী মুর্তজা বশীরের সাথে শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল

উনাকে হারিয়ে পুরো শিল্পীসমাজই অভিভাবকশূন্য হয়েছি। উনার কাজের মধ্য দিয়েই উনি আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। যখন তিনি স্বাধীনতা পদক পেলেন, তা উনার পাওয়ার কথা অন্তত তিরিশ বছর আগে। হুইল চেয়ারে বসে লুঙ্গি পরে তাকে পদক নিতে হয়েছে, সেটা শিল্পী হিসেবে আমার কাছে লজ্জার। শিল্পের মানুষদের মুর্তজা বশীরকে মনে না রেখে উপায় নাই, এমন কাজ তিনি করে গেছেন।


প্রিমা নাজিয়া আন্দালীব
দৃশ্যশিল্পী

‘কেমন আছো? আমি প্রতিদিন ছবি আঁকছি। আসবার সময় নতুন কয়েনগুলো নিয়ে এসো, খুশি হব। Eagerly waiting for the date!’ দৃশ্যমান ছবি এবং কথামালার এমনই রসবৈচিত্র-মূর্ততায় প্রকাশিত সদা-উদ্ভাসি আমার মায়েস্ত্রো, বরেণ্য মুর্তজা বশীর। ‘বরেণ্য’ শব্দতে তাঁর ঘোর আপত্তি।

আমাকে বলতেন, ‘প্রিমা, এই পথ বড় পিচ্ছিল, অহমিকাময়, সাবধানে হেঁটো, মনে রেখো প্রাপ্তিই বড় নয়’। আর তাই বোধ হয় আমার ‘প্রিমাডোনা’ বইয়ের নামকরণের সাথে তিনি জুড়ে দিয়েছিলেন ‘An Infinite journey’। অফুরন্ত সৃষ্টিশীল চঞ্চল প্রাণশক্তির আধার মুর্তজা বশীর, খণ্ড খণ্ড রেখায় বিশাল ভূ-খণ্ড সৃষ্টিতে যার অবিচল, অনবরত অধ্যবসায়। এহেন শিল্পীর জীবনও হার মেনে যায়।

শিল্পী মুর্তজা বশীরের সাথে শিল্পী প্রীমা নাজিয়া আন্দালিব

তিনি আমায় শিখিয়েছেন সদা জাগ্রত, পিপাসিত শিল্পী হতে। শিল্পীত জীবন চর্চা সম্ভব, ধারণও হয়তো করা যায়, কিন্তু শিল্পীত জীবন ছাপিয়ে যায় সদা বিচিত্র, একাগ্র, নিমগ্ন মুর্তজা বশীর। আমার কাছে দুষ্টুমি করে কালো রঙের ব্যবহার শিখতে চাইতেন, প্রাণময় আইভরি ব্ল্যাক, আর আমাকে শেখাতেন, একই রঙের যেন পুর্নব্যবহার না ঘটে। কারণ, স্বীয় রঙের মাঝেই তার বৈচিত্র নিহিত। এ যেন, সীমার মাঝে অসীম তুমি, বাজাও আপন সুর, আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ, তাই এতো মধুর।’ আমার প্রতি অনুভবে আপনি থাকবেন, মায়েস্ত্রো।


নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
কবি ও চিত্রশিল্পী

মুর্তজা বশীরকে আমি চিনি ছোটবেলা থেকে। যখন থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে চিনি তখন থেকে। অবশ্য আমি চারুকলায় ভর্তি হওয়ার কয়েকবছর আগে তিনি অবসরে চলে যান, তাই তাকে ডিপার্টমেন্টে পাইনি।

মুর্তজা বশীর ছিলেন দেশের বলতে গেলে শেষ তীব্র, সাহসী ও অ্যাক্টিভিস্ট পেইন্টার। তাকে আমার মনে হতো আলট্রামেরিন আকাশে এক সুতীব্র শাদা চিল উড়ে বেড়াচ্ছে তীব্র নীলের সঙ্গে শাদা মেঘের মতো এক দুরন্ত বৈপরীত্য তৈরি করে।

তার আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস দীর্ঘ। একটুখানি বলি, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম-সহ দেশের বড় বড় সব আন্দোলনের সঙ্গে তিনি ছিলেন। তিনি জেল খেটেছেন তার ১৮ বছর বয়সে। এটা তার ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে ঘটনা। তখন ময়মনসিংহে এবং পশ্চিমবঙ্গের কাকদ্বীপে আন্দোলন চলছে। স্যারের জবানিতে অনেকটা এই রকম ছিল, ‘সেই আন্দোলনের জন্যে পোস্টারগুলো আমি এঁকেছিলাম। পোস্টার সব লাগিয়ে শেষটা যখন লাগাতে যাই, ওটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। আমি বোকা ছিলাম কারণ যে-পোস্টার পুলিশ ছিঁড়ে ফেলবে আমি ওটাকে জোড়া লাগাতে গেলাম। জোড়া লাগাতে গিয়ে ধরা পড়লাম।’

কবি ও শিল্পী নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

তিনি পার্টির নির্দেশেই আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তার মানে এই নয় যে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত মেনে নিতে পারেননি। অনেকও তাইই মনে করতেন। স্যার আমাকে বলেছিলেন যে তার বাবা বিষয়টা শুরুতে মেনেনা নিলেও পরে মেনে নিয়েছিলেন। আর্টের বইপত্রও কিনে দিয়েছিলেন, করাচিতে তার প্রদর্শনীতেও গিয়েছিলেন। স্যার বলেছিলেন শিল্পীর জীবনে অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই। তিনি সচ্ছল পিতার সন্তান হয়েও বাবার কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিতেন না। অভিজ্ঞতা ও পেট চালানোর জন্য একবার তিনি ভিক্ষাও করেছিলেন, সম্ভবত করাচিতে গিয়ে। স্যার প্রথম আলাপে আমাকে বলেছিলেন, ‘ আমাকে কয়েক ঘণ্টা পর পর অক্সিজেন নিতে হয় ঠিক। কিন্তু ডাক্তার বলেছে, আমার ফুসফুস ৩০ বছরের যুবকের মতো পরিস্কার।’ তার সঙ্গে সকাল ১১ টা থেকে কোনো কোনো দিন বিকেল পর্যন্তও কথা হয়েছে। কয়েক ঘন্টা পর পর তাকে অক্সিজেন নিতে হতো, তখন তার খাটের সামনে চেয়ারে আমি বসতাম। আর তিনি শুয়ে শুয়ে অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে অল্প কথা বলতেন। তিনি একই গল্পই আমাকে প্রায়দিন বলতেন। তার জীবনের কথা, শহীদুল্লাহর কথা। আমার তার কথা শুনতে ভালো লাগতো। অল্পদিনই দেখা হয়েছে আমাদের। কিন্তু কেন জানি না আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। হয়ত তার কথা আমি বুঝতে পারতাম, এটাও একটা কারণ। স্যারের সাক্ষাৎকার নেয়ার কথা ভাবিনি কখনো। তার পাশে দাঁড়িয়ে ছবিও তুলিনি। তিনি একদিন অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, ‘সবাই আমার সঙ্গে ছবি তুলতে চায়, তুমি কখনো চাও নাই কেন?’ আমি বললাম, ‘স্যার সকলের সব ধরনের সাহস আর যোগ্যতা থাকে না। আমারও নাই। আমার হীনমন্যতা হয় বিখ্যাত কারো পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে। নিজেকে তার ভৃত্য বলে মনে হয়।’ শুনে তিনি হেসেছিলেন। কিছু বলেননি। দেখতাম তিনি ফোনে লোকজনের সঙ্গে রেগে যাচ্ছেন। কিন্তু আমার সঙ্গে একদিনও রেগে কথা বলেননি। একবার দেশের প্রখ্যাত এক অনুবাদক ও কবির উপর ভয়ানক রেগে গেলেন, বাপান্ত করলেন ফোনেই, আর বললেন ‘খবরদার আমাকে আর কখনোই বশীরভাই বলে ডাকবা না, তুমি আমার বাপের অমূল্য বই ছিঁড়ে ফেলেছো...মনে হচ্ছে আমার গায়ের চামড়া ছিঁড়ে ফেলেছো...। শহীদুল্লাহ্ তার কাছে এতটাই প্রিয় ছিলো। ঘটনা হলো শহীদুল্লাহ্র দুর্লভএকটা স্মারকগ্রন্থ ফটোকপি করতে নিয়ে গিয়ে বাঁধাই খুলে ফেলেছিলেন তিনি, সেটা বাঁধাই না করেই ফেরত দিয়েছিলেন। বইটা আমি নিজ হাতে নিখুঁত একটা বাইন্ডিং করে দিয়েছিলাম।

তিনি মৃত স্ত্রীর অনেক ছবি এঁকেছিলেন, তার সেইসব আঁকা প্রতিকৃতি নিয়ে একটা প্রদর্শনী করেছিলেন। সেই প্রদর্শনীর নিমন্ত্রণপত্র আমাকে নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু নানা কারণে আমার আর যাওয়া হয়নি সেই প্রদর্শনীতে। বশীর স্যার আমাকে বলেছেন তিনি অভিজ্ঞতার জন্যে অনেক কিছুই করেছেন। কারণ শিল্পীর জীবনে অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই। তিনি সচ্ছল, বিখ্যাত পিতার সন্তান হয়েও বাবার কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিতেন না। অভিজ্ঞতা ও পেট চালানোর জন্য একবার তিনি ভিক্ষাও করেছিলেন।

বশীর স্যারের মনিপুরি পাড়ার বাসায় আমাকে প্রথম নিয়ে গিয়েছিলেন হাসনাত ভাই মানে চাকরিসূত্রে আমার বস কালি ও কলমের সম্পাদক আবুল হাসনাত মানে কবি মাহমুদ আল জামান। বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে বশীর স্যারের আত্মজীবনী আমরা বের করেছিলাম। তারপর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র চিঠিপত্র, বশীর স্যারের আত্মজৈবনিক দুটো বক্তৃতার একটা বই, তার শান্তি-নিকেতনের দিনলিপির দুটো খাতা থেকে একটা বই করার প্রক্রিয়া চলছিল। সেই সূত্রে দায়িত্বটা পড়েছিল আমার ওপর।

কী করেন নাই বশীর স্যার? ছবি এঁকেছেন, ভাস্কর্য করেছেন, কবিতা লিখেছেন, গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, লিখেছেন সিনেমার চিত্রনাট্য। পিকাসো ৯১ বছর বেঁচেছিলেন। বশীর স্যার চেয়েছিলেন তার চেয়ে এক বছর বেশি বাঁচতে। আর কয়েকটা বছর বেঁচে থাকলেই স্যারের হয়ে যেত ৯২ বছর।