শিল্পী মুর্তজা বশীরের মহাপ্রস্থান



শিমুল সালাহ্উদ্দিন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
শিল্পী মুর্তজা বশীর

শিল্পী মুর্তজা বশীর

  • Font increase
  • Font Decrease

চলে গেলেন বরেণ্য শিল্পী মুর্তজা বশীর। আমাদের শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বরেণ্য এই শিল্পী শুধুমাত্র নিজের সৃজন অন্বেষণ আটকে রাখেননি ছবি আঁকায়। শিল্পের নানা শাখায় নিমগ্ন করেছেন নিজেকে। লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাস ও কবিতা। নিজের লেখা কবিতাগ্রন্থ ‘টাটকা রক্তের ক্ষীণরেখা’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন নিজেই। ছোটগল্প ‘কাচের পাখির গান’ (১৯৬৯), উপন্যাস ‘আলট্রামেরীন’ (১৯৭৯), কবিতা ‘ত্রসরেণু’ (১৯৭৬), ‘তোমাকেই শুধু’ (১৯৭৯), ‘এসো ফিরে অনসূয়া’ (১৯৮৫), বিবিধ বিষয়ে নির্বাচিত লেখা ‘মুর্তজা বশীর : মূর্ত ও বিমূর্ত’ (২০০১), গবেষণা গ্রন্থ ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ’ (২০০৪), গল্পগ্রন্থ ‘মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যে, অমিতাক্ষর’ (২০০৮) এবং ‘গল্পসমগ্র’ (২০০৮) প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি গবেষণা প্রবন্ধ উপমহাদেশের বিভিন্ন জার্নালে ছাপা হয়, যা তাকে একজন নিবিড় গবেষক হিসেবে স্বীকৃতি ও খ্যাতি দিয়েছে। ছবি আঁকার পাশাপাশি তার সাহিত্যকর্মও সমান কৃতিত্বের দাবি রাখে। ১৯৫৪ সালে গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস থেকে চিত্রকলা ও ড্রইং নিয়ে প্রথম বিভাগে পাস করেন। ১৯৫৬-৫৭ সালে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে চিত্রকলা এবং ১৯৫৭-৫৮-তে ফ্রেসকো নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। ফ্লোরেন্সের গ্যালারি লা পারমানেন্তেতে ১৯৫৮ সালে তাঁর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। দেশে ও বিদেশে তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনীর সংখ্যা ২০টি। তাঁর ম্যুরাল চিত্রের সংখ্যা ৭টি। ১৯৭৩ সালের আগস্টে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং সেখান থেকে অবসরগ্রহণ করেন।

১৯৬৩ থেকে ১৯৬৪, প্রায় আড়াই বছর চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে জড়িত থেকে কোনো ছবি আঁকেননি তিনি। হুমায়ুন কবীরের উপন্যাস ‘নদী ও নারী’র চিত্রনাট্য লিখতে গিয়ে অনেক পরিবর্তন করে যখন দিল্লিতে তাঁর কাছে পাঠানো হয়েছিল তখন দ্বিধা থেকে যায়, তিনি অনুমতি দেবেন কি-না। শুধু অনুমতি নয়, হুমায়ুন কবীর চিত্রনাট্যের প্রশংসাও করেছিলেন। পরিচালক জহির রায়হানের জন্যও চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন। কিন্তু চলচ্চিত্র শিল্প থেকে তিনি সম্পর্ক ছিন্ন করে আবার ছবি আঁকায় যুক্ত হলেন। কখনো থেমে থাকেননি বাংলাদেশের শিল্প ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্পী।

ইংরেজি সাহিত্য পড়তে শুরু করেছিলেন ষাটের দশকে, সেই সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যও। একবার তো স্প্যানিশ কবি গার্সিয়া লোরকার কবিতার চরণকে অবলম্বন করে এঁকেছিলেন ছবি। বিচিত্র জীবনের মুর্তজা বশীর টেনে নিয়ে যায় আমাদের। তাঁর সামগ্রিক জীবনটি আমাদের অনুভূতিকে অধিকার করে ফেলে। আমরা আক্রান্ত হতে থাকি। কিন্তু তিনি সৃষ্টি করেন নতুন কোনো বিষয়ের অমর সব চিত্রকর্ম। এভাবে ভ্রমণশীল মুর্তজা বশীর এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়কে এঁকে বিমোহিত করে রাখেন আমাদের। নিরন্তর তিনি নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে থেকেছেন প্রবহমান এবং ব্যতিক্রমী। বছর পাঁচেক ধরেই ভুগছিলেন লাংসের সমস্যায়। লোকসান্নিধ্যে যেতে পারেন না মানুষের নিঃশ্বাসনিঃসৃত কার্বন ডাই অক্সাইড ক্ষতিকর বলে। সর্বক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে নিঃশ্বাস নিতে হতো। করোনা কেড়ে নিল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রথম দিকের শিক্ষার্থী, বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের বড় শিল্পী মুর্তজা বশীরকে।

বরেণ্য এই শিল্পীর মৃত্যুর খবর জাতীয় শোক দিবসেও আরো এক ভারী শোকের ছায়া নামিয়ে আনে শিল্পানুরাগীদের মধ্যে। বরেণ্য শিল্পী, শিল্পানুরাগী ও শিল্পীর কাছের মানুষদের সাথে কথা বলেছেন বার্তা২৪ এর স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট শিমুল সালাহ্উদ্দিন।


রফিকুন নবী
শিল্পী

শিল্পী মুর্তজা বশীর আমাদের শ্রেষ্ঠতম শিল্পীদের অন্যতম। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি শিল্পে নিমগ্ন ছিলেন। একটা কথা না বললেই নয়, পঞ্চাশ দশকের শুরুতে যখন নতুন আর্টকলেজ, সেকেন্ড ব্যাচের ছাত্র তিনি। উনি তাদের একজন যাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের শিল্পকলা দাঁড়িয়েছে, আজকের অবস্থানে এসেছে। উনি, রশিদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, কাইয়ুম চৌধুরী, পুরা ব্যাচটাই ছিল ব্যাপক মেধাবী একটা ব্যাচ। সেই সময়ে তাঁরা ভর্তি হয়েছিলেন চারুকলায় যখন আর্থিক-সামাজিক কোনো নিরাপত্তা ছিল না শিল্পচর্চায়।

আমার ভাবলে অবাক লাগে, সেই সময়ে উনি ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে হয়ে, নানা জায়গায় দ্বার খোলা থাকার পরও শিল্পকলায়ই এসেছেন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জেনেও। এটা বিরাট সাহসের কাজ। আর উনি বেশি কাজ করেছেন বিমূর্ত শিল্পকলা নিয়ে। উনার শিল্পকর্ম আমাদের শিল্পভুবনে অসামান্য সংযোজন, পৃথিবীর শিল্পভুবনেও আমি মনে করি উনার মতো ভালো কাজ খুব কম আছে। একজন সমাজসচেতন, দেশ সচেতন ও একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন তিনি।

শিল্পী রফিকুন নবী

পঞ্চাশ দশকে যখন তিনি ছাত্র, তখন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে উনার সক্রিয় ভূমিকা ছিল, উনি মিছিলের সম্মুখ সারিতে ছিলেন, বরকত গুলিবিদ্ধ হবার পর উনিই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলেন। বরকতের রক্তাক্ত জামা তার হাতে ছিল। উনার এই অকুতোভয় ব্যাপার আমাদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে ছিল। পঞ্চাশ দশকে উনার এই উদাহরণ শিল্পীদের পরবর্তী নানা আন্দোলেন উদ্বুদ্ধ করেছে। সেইটা কিন্তু বশীর ভাই ও অন্যান্য যারা ছিলেন তাদের কাছে পাওয়া। উনি শিল্পকলার শিক্ষা দিয়েছেন, প্রশাসন চালিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। উনি এটাও শিখিয়েছেন শিল্পীদের প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে রয়েছে। এইসব শিক্ষা কিন্তু বশীর ভাইরা আমাদের আদর্শিকভাবে শিখিয়েছেন। উনাদের ভূমিকাকে আমরা আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছি। উনি একাধারে চিত্রকর, লেখক। একটা পারিবারিক ব্যাপার ছিল ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে হিসেবে, তার সাথেও ছিল অনেক অনেক গুণ, মুদ্রাসংগ্রহ, টেরাকোটা এসব নিয়ে উনার কাজ অসামান্য। এবং সেসব নিয়ে নিয়ে উনার লেখালেখি, গবেষণা, দারুণ ইতিহাস রচনার ব্যাপার। বশীর ভাইয়ের যে বশীর ভাই হয়ে ওঠা, ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উনারা, শিল্পী সাহিত্যিক সংগীতশিল্পী রাজনীতিবিদ সবাই একসাথে ওঠাবসা করতেন। হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, আলতাফ মাহমুদ এই যে সবার মিথস্ক্রিয়া এসব থেকেই ত আমরা শিক্ষা নিয়েছি। স্বাধীন রাষ্ট্রে বড় শিল্পী হিসেবে উনাকে আমাদের আরো অনেক সম্মান দেওয়া দরকার ছিল, সেইটা হয়তো আমরা পারি নাই। উনি লেখাপড়া করেছেন দেশের বাইরে, দেশে এসে সেই আলোতে আমাদের দেশের শিল্পীদের আলোকিত করেছেন। আধুনিক চিত্রকলা চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। উনার মৃত্যুতে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। উনার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা রইল।


সমরজিৎ রায় চৌধুরী
শিল্পী

শিল্পী হিসেবে তিনি অসামান্য ছিলেন। সবার কাছেই সমাদর পেয়েছেন। যারা শিল্পটা বোঝেন। মানুষ হিসেবেও কখনো কোনো খারাপ কিছু শুনিনি আমি। আমার সঙ্গেও খুব ভালো হৃদ্যতা ছিল। কাজের কথা কি বলব, সবাই জানে যে উনি একজন খুবই উঁচুদরের শিল্পী। আমার সিনিয়র ছিলেন চারুকলায়, প্রায় পাঁচ-ছয় বছরের সিনিয়র ছিলেন। উনি কাইয়ুম ভাইয়ের (শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী) ক্লাসমেট ছিলেন।

শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী

উনি একজন অসামান্য শিল্পবোদ্ধা ছিলেন, যেমন বুঝতেন, তেমন বলতেও পারতেন। উনার কর্ম দিয়েই সবাই উনাকে মনে রাখবে, উনার কাজ অত্যন্ত ভালো মাপের। এই বয়সেও উনি যে অসাধারণ বক্তব্য দিতেন, তা ভাবা যায় না। প্রচুর ভালো লেখা আছে উনার। উনি কাজকর্ম নিয়েই থাকতেন সবসময়, এবং বেশ ভালো কাজ করতেন। এইটাতে কোনো সন্দেহ নাই তিনি আমাদের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের একজন। মানুষ তাকে তাঁর কাজ দিয়েই চিরদিন মনে রাখবে।


মনিরুল ইসলাম
শিল্পী

আমার খুবই শ্রদ্ধার মানুষ ছিলেন মুর্তজা বশীর। আমাদের খুব আর্গুমেন্ট হতো। উনার একটা বিরাট গুণ ছিল হি ক্যান টক অন আর্ট এন্ড অলসো আর্ট অফ টকিং। দুইটা দুই জিনিস। সুন্দরভাবে গুছায়া কথা বলা আর্ট অফ টকিং। এবং এনাদার থিং, উনার কন্টেমপোরারি আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন এন্ড থিংকিং দুর্দান্ত ছিল।

হি ওয়াজ অলয়েজ আপডেটেড উইথ মডার্ন আর্ট। উনাদের জেনারেশন আমাদের শিল্পকলায় ইমপোর্টার অফ এবস্ট্রাক্ট আর্ট। হি ইজ আ লিজেন্ড পারসন। অনেক দিন ধরে অসুস্থ থাকার পরও আমাদের কাছে উনি বিরাট প্রেরণার মানুষ ছিলেন। হি ইজ আ ভেরি কারেজিয়াস পেইন্টার, বলতে হবে যে মডার্ন অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের পায়োনিয়ার একজন তিনি, এর মধ্যে কিবরিয়াও আছে, শফিউদ্দিন সাহেব আছেন। উনার কাজের মধ্যে আমার দেখা, ওয়াল সিরিজ, ওহ হোয়াট এন এক্সিবিশন। তখন কোনো গ্যালারি ছিল না, এক্সিবিশন হয়েছিল প্রেস ক্লাবে। আমরা ঐ এক্সিবিশন বারবার দেখতাম ঘুরে। একমাত্র পেইন্টার কোনোদিন কম্প্রোমাইজ করেন নাই। অভ্যাসের বাইরে যাওয়াটা শিল্পীর জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। বারবার নতুন কিছু করেছেন তিনি। তার বৈচিত্র ঈর্ষা করার মতো। অ্যাজ এন আর্টিস্ট তিনি অডিয়েন্সের সাথে কোনো কম্প্রোমাইজ করেন নাই।

শিল্পী মুর্তজা বশীরের সাথে শিল্পী মনিরুল ইসলাম

একটা টাইমে শিল্পী কন্ডিশনড হন ক্রিটিক, আর্টলাভার, গ্যালারির সাথে—এসবকে তিনি উনার কাজ দিয়া সবসময় বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিছেন। হ্যাবিটের বাইরে তিনি সবসময় গেছেন, মুর্তজা বশীর ইজ ভেরি পাওয়ারফুল ইন্টেলেকচুয়াল অফ ক্রিয়েটিভ প্রসেস। লিখেছেন, কবিতা, গদ্য কতকিছু। জেনেটিকালিও উনার বেসমেন্ট খুব স্ট্রং ছিল। তার এই চলে যাওয়া আমাদের জন্য বিরাট ক্ষতি। উনি একটা বড় ইন্সপিরেশন ছিলেন আমাদের।


নিসার হোসেন
শিল্পী, ডিন, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পের যে চর্চা আজ বিশ্বের মূল শিল্পধারার সমান্তরালে চলছে সেটার সূচনা হিসেবে আমরা ধরি ১৯৪৮ সালকে যখন ঢাকায় একটি আর্ট স্কুল স্থাপিত হয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের উদ্যোগে। তাঁকে সহায়তা করেছিলেন কামরুল হাসান, শফিউদ্দীন আহমেদ প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীরা। মুর্তজা বশীর ১৯৪৯ সালে চারুকলার এই আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং উত্তীর্ণ হন ১৯৫৪ সালে। এই সময়টাতে তার সঙ্গে ও তার আগে পরে যারা এই স্কুল পড়াশোনা করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই আমাদের দেশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী এবং আধুনিক শিল্পের বিকাশে সবাই রেখেছেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সবসময়ই তাঁর ছাত্রদের খুব অনুপ্রাণিত করতেন সমকালীন বিশ্বের শিল্পধারা সম্পর্কে জানার জন্য, ইউরোপ আমেরিকায় যাবার জন্য। আমরা দেখেছি হামিদুর রহমান আর্ট স্কুলের ছাত্র থাকার সময়ই ফ্রান্সে গিয়েছিলেন পড়াশোনার জন্য, আমিনুল ইসলাম ১৯৫৪ সালে আর্ট স্কুল থেকে পাশ করেই ইটালিতে চলে গিয়েছিলেন এবং আমীরুল ইসলামের একজন ভক্ত ছিলেন মুর্তজা বশীর। তাঁরা দুজনেই খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন আমৃত্যু।

আধুনিক শিল্পের অগ্রগতিতে মুর্তজা বশীরের যে অবদান তার পেছনে আমিনুল ইসলামের বেশ বড় ভূমিকা এবং অনুপ্রেরণা ছিল। আমরা দেখি যে আমিনুল ইসলাম ইটালিতে যে প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছিলেন, মুর্তজা বশীরও সেই একই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন এবং তিনিও আমিনুল ইসলামের মতো ম্যুরাল এবং পেইন্টিং—এ দুটো বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন সেখানে। একটা বিষয় আমাদের খেয়াল রাখতে হবে এখানে যে, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, রচিত চৌধুরী এঁরা প্রত্যেকেই খুব আলোকিত পরিবার থেকে এসেছেন এবং প্রত্যেকেই শিল্পচর্চার পাশাপাশি জ্ঞানচর্চা করতেন। এই বিষয়টি আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ আধুনিক শিল্পের চর্চার জন্য যে শিল্পীর নিজের আধুনিক হয়ে উঠবার প্রয়োজন আছে, মন মানসিকতা সবদিক থেকে আলোকিত মানুষ হবার প্রয়োজন আছে এটা তাঁরা গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন ও চর্চা করতেন। এবং আমরা জানি যে এঁরা সবাই ছিলেন আলোকিত মানুষ, মুর্তজা বশীর ছিলেন তাঁদের এই প্রজন্মের মধ্যে সর্বশেষ যিনি প্রয়াত হলেন। এর মাধ্যমে বলা যায় একটি যুগের সমাপ্তি ঘটল।

শিল্পী নিসার হোসেন

মুর্তজা বশীর কিন্তু শুধু ছবিই আঁকেননি, তিনি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অসংখ্য ম্যুরাল তৈরি করেছেন এবং তাঁর গবেষণার পরিধি ছিল খুবই বিস্তৃত। সুলতানি আমলের মুদ্রা নিয়ে তাঁর খুব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা আছে যা এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রদেরকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে পড়তে বলা হয়।

মুর্তজা বশীর পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, কবিতাও লিখেছেন এমনকি চলচ্চিত্রের সাথেও তাঁর যোগ ছিল। একজন জ্ঞানী মানুষের যেমন সবদিকেই জ্ঞান বিকাশের তাড়না থাকে মুর্তজা বশীর ছিলেন ঠিক সেরকম, সবদিকেই তাঁর আগ্রহ ছিল। সত্যি কথা বলতে গেলে তাঁর মতো এরকম সব বিষয়ে দক্ষতা নিয়ে কাজ করার মতো শিল্পী আমরা আর কাউকে পাইনি। এটা ছিল ওনার একটি বিরাট অর্জন। তাঁর এই বিস্তৃত কর্মপরিধির জন্য তাঁর অস্তিত্ব সবার কাছে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি একজন অসাধারণ শিক্ষকও ছিলেন এবং আমরা যে-ই তাঁর কাছে যেতাম, এই শিক্ষকসুলভ আচরণ পেতাম, অনেককিছু শিখতে পারতাম। আমরা খুব গর্বিত যে আমাদের এই চারুকলা থেকেই তিনি অধ্যয়ন করে গেছেন এবং তিনি নিজেও খুব গর্বের সাথে এটা বলতেন যে তিনি জয়নুল আবেদিনের ছাত্র ছিলেন, ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউটের ছাত্র ছিলেন। আমরা এটা ভাবতে পেরে তৃপ্ত যে তাঁর জীবিত অবস্থায়ই আমরা তাঁকে জয়নুল সম্মাননা দিয়ে সম্মানিত করতে পেরেছি। তাঁর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত এবং তাঁর পরিবার ও স্বজনদের প্রতি আমরা গভীরভাবে সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।


গৌতম চক্রবর্তী
শিল্পী ও স্বত্বাধিকারী, গ্যালারি কায়া

প্রথমত তিনি অনেক বড় মাপের শিল্পী এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। দেশবিভাগের পরে যে মানুষগুলি এই অঞ্চলে একত্রিত হলেন, মুর্তজা বশীর, আমিনুল ইসলাম, কবি শামসুর রাহমান, খান আতাউর রহমান, জহির রায়হান—এনারা একেকটা দিকপাল যার যার কাজের জায়গায়, এরা কিন্তু প্রতিদিন না হলেও অলটারনেট ডে তে আড্ডা মারতেন, গল্প করতেন। যতটুকু আমি আমার আবাল্য দেখে এসেছি, যেহেতু আমার বাবা উনাদের বন্ধু ছিলেন, সেখানে কিন্তু চিত্রকলা, সাহিত্য, আপনার রাজনীতি দর্শন প্রত্যেকটা শাখাই উচ্চারিত হতো। এজন্যই মুর্তজা বশীর প্রথমদিকে কিন্তু ফিল্মে যুক্ত হয়েছিলেন, চিত্রনাট্য লিখেছেন, সেটে ডিরেকশন দিয়েছেন।

তারপর দেখেন তার কত দিক, তিনি হাবশী সুলতানদের ওপর গবেষণা করেছেন, উনি পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরের ট্যারাকোটা, প্রাচীন মুদ্রা নিয়ে গবেষণা করেছেন। উনি অ্যাভিড কালেক্টর ছিলেন স্ট্যাম্পের, অ্যাভিড কালেক্টর ছিলেন মুদ্রার। উনার যে বিখ্যাত লিনোকাট, ব্লাডি টুয়েন্টি ফার্স্ট, সেই মিছিলে কিন্তু উনি ছিলেন, এমন না যে বারান্দা থেকে দেখে উনি সেটা করেছেন, ঐ গুলি কিন্তু উনার বুকেও লাগতে পারত। তার মানে এই মানুষগুলো কিন্তু যা চেয়েছেন তা মনে প্রাণে চেয়েছেন। এবং সেই জিনিসগুলোকে তাঁরা কবিতায়, চিত্রকলায় তুলে এনেছেন।

শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী

বশীর চাচা কিন্তু প্রাউডলি বলতেন, গৌতম দেখো আমি কিন্তু না দেখে ছবি আঁকতে পারি না। আমার কিন্তু দেখে ছবি আঁকতে হয়। উনি বলেছেন, জানো আমার যে এপিটাফ সিরিজটা, সবকিন্তু আমি পাথর দেখে দেখে করেছি এবং সব পাথরগুলি আমার কাছে আছে। উনি যখন ওয়াল সিরিজ করলেন, তিনি প্রত্যেকটা ওয়াল দেখেছেন, তারপর তিনি এঁকেছেন। ফলে জীবনের সাথে উনাদের ঘনিষ্ঠতাটা অনেক বেশি ছিল। যা মুর্তজা বশীরের চিত্রকলায়ও ট্রান্সলেটেড হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে জীবনের একেবারে মৌল অভিজ্ঞতার নির্যাসকেই তাঁরা কাজে তুলে আনতে পেরেছেন।

শিল্পাচার্যের মন্বন্তরের ছবিগুলি যদি দেখেন, এসব কিন্তু চোখ দিয়ে দেখা ছবি, কান দিয়ে শুনে আঁকা ছবি নয়, ফলে আমি মুর্তজা বশীরকে আমাদের দেশের অনেক বড় শিল্পী মনে করি। এবং মনে করি এই মানুষগুলোকে নিয়ে এবং সার্বিক শিল্পকলা নিয়ে আরো অনেক বড় ধরনের কাজ করার সুযোগ আছে, এবং সেই পরিসর পেলে সেটা আমি হই বা অন্য কেউ হোক করবেই একদিন না একদিন। বড় করে আমরা মুর্তজা বশীরকে নিয়ে কাজ করতে পারব এবং সেটা খুব বড় গর্বের বিষয় হবে বাংলাদেশের জন্য। আমাদের গ্যালারি কায়ারও কিছু বড় পরিকল্পনা আছে বশীর চাচার কাজ নিয়ে।


আনিসুজ্জামান সোহেল
শিল্পী

মুর্তজা বশীরের মতো বড় শিল্পীকে আমরা কতটা মূল্যায়ন করতে পেরেছি তা নিয়ে একজন শিল্পী হিসেবে আমার আসলে কিঞ্চিত আক্ষেপ আছে, ক্ষোভও। আমি উনাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করি, উনার কাজের ক্ষেত্র বিস্মৃত, বারবার নিজেকে পাল্টেছেন। আমিনুল ইসলাম ইয়াং আর্টিস্ট এওয়ার্ডটা আমার জীবনের মোড় পাল্টে দিয়েছিল। ঐ পুরস্কারের বিচারক ছিলেন মুর্তজা বশীর। আমার কাজ এতই পছন্দ করেছিলেন যে, অনুষ্ঠানের শেষে উনি আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, দমটা ধরে রেখো। এটা আমার জন্য যে কত বড় অনুপ্রেরণা ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

শিল্পী মুর্তজা বশীরের সাথে শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল

উনাকে হারিয়ে পুরো শিল্পীসমাজই অভিভাবকশূন্য হয়েছি। উনার কাজের মধ্য দিয়েই উনি আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। যখন তিনি স্বাধীনতা পদক পেলেন, তা উনার পাওয়ার কথা অন্তত তিরিশ বছর আগে। হুইল চেয়ারে বসে লুঙ্গি পরে তাকে পদক নিতে হয়েছে, সেটা শিল্পী হিসেবে আমার কাছে লজ্জার। শিল্পের মানুষদের মুর্তজা বশীরকে মনে না রেখে উপায় নাই, এমন কাজ তিনি করে গেছেন।


প্রিমা নাজিয়া আন্দালীব
দৃশ্যশিল্পী

‘কেমন আছো? আমি প্রতিদিন ছবি আঁকছি। আসবার সময় নতুন কয়েনগুলো নিয়ে এসো, খুশি হব। Eagerly waiting for the date!’ দৃশ্যমান ছবি এবং কথামালার এমনই রসবৈচিত্র-মূর্ততায় প্রকাশিত সদা-উদ্ভাসি আমার মায়েস্ত্রো, বরেণ্য মুর্তজা বশীর। ‘বরেণ্য’ শব্দতে তাঁর ঘোর আপত্তি।

আমাকে বলতেন, ‘প্রিমা, এই পথ বড় পিচ্ছিল, অহমিকাময়, সাবধানে হেঁটো, মনে রেখো প্রাপ্তিই বড় নয়’। আর তাই বোধ হয় আমার ‘প্রিমাডোনা’ বইয়ের নামকরণের সাথে তিনি জুড়ে দিয়েছিলেন ‘An Infinite journey’। অফুরন্ত সৃষ্টিশীল চঞ্চল প্রাণশক্তির আধার মুর্তজা বশীর, খণ্ড খণ্ড রেখায় বিশাল ভূ-খণ্ড সৃষ্টিতে যার অবিচল, অনবরত অধ্যবসায়। এহেন শিল্পীর জীবনও হার মেনে যায়।

শিল্পী মুর্তজা বশীরের সাথে শিল্পী প্রীমা নাজিয়া আন্দালিব

তিনি আমায় শিখিয়েছেন সদা জাগ্রত, পিপাসিত শিল্পী হতে। শিল্পীত জীবন চর্চা সম্ভব, ধারণও হয়তো করা যায়, কিন্তু শিল্পীত জীবন ছাপিয়ে যায় সদা বিচিত্র, একাগ্র, নিমগ্ন মুর্তজা বশীর। আমার কাছে দুষ্টুমি করে কালো রঙের ব্যবহার শিখতে চাইতেন, প্রাণময় আইভরি ব্ল্যাক, আর আমাকে শেখাতেন, একই রঙের যেন পুর্নব্যবহার না ঘটে। কারণ, স্বীয় রঙের মাঝেই তার বৈচিত্র নিহিত। এ যেন, সীমার মাঝে অসীম তুমি, বাজাও আপন সুর, আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ, তাই এতো মধুর।’ আমার প্রতি অনুভবে আপনি থাকবেন, মায়েস্ত্রো।


নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
কবি ও চিত্রশিল্পী

মুর্তজা বশীরকে আমি চিনি ছোটবেলা থেকে। যখন থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে চিনি তখন থেকে। অবশ্য আমি চারুকলায় ভর্তি হওয়ার কয়েকবছর আগে তিনি অবসরে চলে যান, তাই তাকে ডিপার্টমেন্টে পাইনি।

মুর্তজা বশীর ছিলেন দেশের বলতে গেলে শেষ তীব্র, সাহসী ও অ্যাক্টিভিস্ট পেইন্টার। তাকে আমার মনে হতো আলট্রামেরিন আকাশে এক সুতীব্র শাদা চিল উড়ে বেড়াচ্ছে তীব্র নীলের সঙ্গে শাদা মেঘের মতো এক দুরন্ত বৈপরীত্য তৈরি করে।

তার আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস দীর্ঘ। একটুখানি বলি, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম-সহ দেশের বড় বড় সব আন্দোলনের সঙ্গে তিনি ছিলেন। তিনি জেল খেটেছেন তার ১৮ বছর বয়সে। এটা তার ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে ঘটনা। তখন ময়মনসিংহে এবং পশ্চিমবঙ্গের কাকদ্বীপে আন্দোলন চলছে। স্যারের জবানিতে অনেকটা এই রকম ছিল, ‘সেই আন্দোলনের জন্যে পোস্টারগুলো আমি এঁকেছিলাম। পোস্টার সব লাগিয়ে শেষটা যখন লাগাতে যাই, ওটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। আমি বোকা ছিলাম কারণ যে-পোস্টার পুলিশ ছিঁড়ে ফেলবে আমি ওটাকে জোড়া লাগাতে গেলাম। জোড়া লাগাতে গিয়ে ধরা পড়লাম।’

কবি ও শিল্পী নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

তিনি পার্টির নির্দেশেই আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তার মানে এই নয় যে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত মেনে নিতে পারেননি। অনেকও তাইই মনে করতেন। স্যার আমাকে বলেছিলেন যে তার বাবা বিষয়টা শুরুতে মেনেনা নিলেও পরে মেনে নিয়েছিলেন। আর্টের বইপত্রও কিনে দিয়েছিলেন, করাচিতে তার প্রদর্শনীতেও গিয়েছিলেন। স্যার বলেছিলেন শিল্পীর জীবনে অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই। তিনি সচ্ছল পিতার সন্তান হয়েও বাবার কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিতেন না। অভিজ্ঞতা ও পেট চালানোর জন্য একবার তিনি ভিক্ষাও করেছিলেন, সম্ভবত করাচিতে গিয়ে। স্যার প্রথম আলাপে আমাকে বলেছিলেন, ‘ আমাকে কয়েক ঘণ্টা পর পর অক্সিজেন নিতে হয় ঠিক। কিন্তু ডাক্তার বলেছে, আমার ফুসফুস ৩০ বছরের যুবকের মতো পরিস্কার।’ তার সঙ্গে সকাল ১১ টা থেকে কোনো কোনো দিন বিকেল পর্যন্তও কথা হয়েছে। কয়েক ঘন্টা পর পর তাকে অক্সিজেন নিতে হতো, তখন তার খাটের সামনে চেয়ারে আমি বসতাম। আর তিনি শুয়ে শুয়ে অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে অল্প কথা বলতেন। তিনি একই গল্পই আমাকে প্রায়দিন বলতেন। তার জীবনের কথা, শহীদুল্লাহর কথা। আমার তার কথা শুনতে ভালো লাগতো। অল্পদিনই দেখা হয়েছে আমাদের। কিন্তু কেন জানি না আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। হয়ত তার কথা আমি বুঝতে পারতাম, এটাও একটা কারণ। স্যারের সাক্ষাৎকার নেয়ার কথা ভাবিনি কখনো। তার পাশে দাঁড়িয়ে ছবিও তুলিনি। তিনি একদিন অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, ‘সবাই আমার সঙ্গে ছবি তুলতে চায়, তুমি কখনো চাও নাই কেন?’ আমি বললাম, ‘স্যার সকলের সব ধরনের সাহস আর যোগ্যতা থাকে না। আমারও নাই। আমার হীনমন্যতা হয় বিখ্যাত কারো পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে। নিজেকে তার ভৃত্য বলে মনে হয়।’ শুনে তিনি হেসেছিলেন। কিছু বলেননি। দেখতাম তিনি ফোনে লোকজনের সঙ্গে রেগে যাচ্ছেন। কিন্তু আমার সঙ্গে একদিনও রেগে কথা বলেননি। একবার দেশের প্রখ্যাত এক অনুবাদক ও কবির উপর ভয়ানক রেগে গেলেন, বাপান্ত করলেন ফোনেই, আর বললেন ‘খবরদার আমাকে আর কখনোই বশীরভাই বলে ডাকবা না, তুমি আমার বাপের অমূল্য বই ছিঁড়ে ফেলেছো...মনে হচ্ছে আমার গায়ের চামড়া ছিঁড়ে ফেলেছো...। শহীদুল্লাহ্ তার কাছে এতটাই প্রিয় ছিলো। ঘটনা হলো শহীদুল্লাহ্র দুর্লভএকটা স্মারকগ্রন্থ ফটোকপি করতে নিয়ে গিয়ে বাঁধাই খুলে ফেলেছিলেন তিনি, সেটা বাঁধাই না করেই ফেরত দিয়েছিলেন। বইটা আমি নিজ হাতে নিখুঁত একটা বাইন্ডিং করে দিয়েছিলাম।

তিনি মৃত স্ত্রীর অনেক ছবি এঁকেছিলেন, তার সেইসব আঁকা প্রতিকৃতি নিয়ে একটা প্রদর্শনী করেছিলেন। সেই প্রদর্শনীর নিমন্ত্রণপত্র আমাকে নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু নানা কারণে আমার আর যাওয়া হয়নি সেই প্রদর্শনীতে। বশীর স্যার আমাকে বলেছেন তিনি অভিজ্ঞতার জন্যে অনেক কিছুই করেছেন। কারণ শিল্পীর জীবনে অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই। তিনি সচ্ছল, বিখ্যাত পিতার সন্তান হয়েও বাবার কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিতেন না। অভিজ্ঞতা ও পেট চালানোর জন্য একবার তিনি ভিক্ষাও করেছিলেন।

বশীর স্যারের মনিপুরি পাড়ার বাসায় আমাকে প্রথম নিয়ে গিয়েছিলেন হাসনাত ভাই মানে চাকরিসূত্রে আমার বস কালি ও কলমের সম্পাদক আবুল হাসনাত মানে কবি মাহমুদ আল জামান। বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে বশীর স্যারের আত্মজীবনী আমরা বের করেছিলাম। তারপর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র চিঠিপত্র, বশীর স্যারের আত্মজৈবনিক দুটো বক্তৃতার একটা বই, তার শান্তি-নিকেতনের দিনলিপির দুটো খাতা থেকে একটা বই করার প্রক্রিয়া চলছিল। সেই সূত্রে দায়িত্বটা পড়েছিল আমার ওপর।

কী করেন নাই বশীর স্যার? ছবি এঁকেছেন, ভাস্কর্য করেছেন, কবিতা লিখেছেন, গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, লিখেছেন সিনেমার চিত্রনাট্য। পিকাসো ৯১ বছর বেঁচেছিলেন। বশীর স্যার চেয়েছিলেন তার চেয়ে এক বছর বেশি বাঁচতে। আর কয়েকটা বছর বেঁচে থাকলেই স্যারের হয়ে যেত ৯২ বছর।

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;