দারা ও আওরঙ্গজেব: অভিন্ন শৈশব, বিপরীত চরিত্র
আওরঙ্গজেব আর দারাশিকোহ, চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই ভাইয়ের অভিন্ন শৈশবকালে ভাগ্যের শুরুটা ছিল একই রকম। পিতা শাহজাহানের বিদ্রোহী মনোভাবের দায় মেটাতে হয়েছিল তার দুই বালক পুত্রকে। যদিও শাহজাহান স্ত্রী বেগম মমতাজ মহল, সন্তান ও পরিবারের প্রতি সর্বদা অনুরক্ত ছিলেন। কখনো তিনি তার সুখে-দুঃখে তাদের থেকে পৃথক হননি। কোনো অভিযানে, ভ্রমণে, প্রদেশ পরিদর্শনে কিংবা পিতা সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ফলস্বরূপ দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানার বিশাল অরণ্যের মধ্য দিয়ে বাংলায় পলায়নের সময়ও শাহজাহান স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারকে সঙ্গে রাখেন। ফলে শাহজাহানের সন্তানদের মধ্যে আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য থেকে ফিরতি যাত্রায় দোহাদ নামক স্থানে এবং অপর পুত্র মুরাদ দক্ষিণ বিহারের রোহতাস দূর্গে অবস্থানকালে জন্মগ্রহণ করেন। দারার জন্মও আজমীরের তারাগড় দূর্গে।
ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী, পিতা সম্রাট জাহাঙ্গীরের (৩১ আগস্ট ১৫৬৯-২৮ অক্টোবর ১৬২৭) রাজত্বের শেষ দিকের কয়েক বছর শাহজাহান বিদ্রোহী মনোভাবের জন্য ভয়ানক দুর্যোগের মধ্যে মুঘল বাহিনীর তাড়া খেয়ে উদভ্রান্তের মতো এখানে সেখানে পালিয়ে দিন কাটান। মতপার্থক্য ও বিরোধিতার জেরে শাহজাহান সমস্ত পদ, জায়গীর থেকে বঞ্চিত হন। এমনকি, পিতার বিরুদ্ধে বার বার বিদ্রোহ করেও শাহজাহান ব্যর্থ হন। ফলে তাকে মুঘল বাহিনীর ধাওয়ায় তেলেঙ্গানা, উড়িষ্যা ও বাংলা থেকে জৌনপুর পর্যন্ত বিপদসঙ্কুল, অরণ্য পথ পালিয়ে পালিয়ে দিনাতিপাত করতে হয়, যদিও সেই বিরূপ পরিস্থিতিতেও স্ত্রী, সন্তান, পরিজন তার সঙ্গেই ছিলেন।
শেষ পর্যন্ত শাহজাহান পিতা সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে আত্মসমর্পণ ও নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পিতা তাকে পুনরায় সাদরে গ্রহণ করে সরকারি পদে বহাল করেন। তবে শর্ত থাকে যে, শাহজাহানের পুত্রদ্বয় দারাশিকোহ (দারা) ও আওরঙ্গজেবকে জামিন হিসেবে আগ্রা দূর্গে রাখতে হবে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আদেশে শাহজাহান তাই করতে বাধ্য হন। এটি ছিল ১৬২২ সালের ঘটনা। তখন দারার বয়স মাত্র সাত আর আওরঙ্গজেব আরো ছোট।
সম্রাট জাহাঙ্গীর মৃত্যুবরণ করলে শাহজাহান আগ্রায় মুঘল সিংহাসনে আরোহণ করেন। তারপর তার দুই পুত্রকে নানা আসফ খান আগ্রায় পিতার কাছে নিয়ে আসন। আগ্রায় তখন এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। আপত্য স্নেহে পিতা পুত্রদের অভ্যর্থনা করেন এবং অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান মাতা দীর্ঘবছর পর পুত্রদ্বয়কে কাছে পেয়ে অশ্রুসজল নেত্রে বুকে জড়িয়ে ধরেন। পুত্রদের অদর্শনে বহুদিনের সঞ্চিত মায়া ও আবেগ উজাড় করে দেন সম্রাট শাহজাহান ও সম্রাজ্ঞী মমতাজ।
কিন্তু তখন কে জানতো, একই রক্ত ও ঐতিহ্যের অধিকারী দুইভাই আলাদা ধরণের দুইজন মানুষে রূপান্তরিত হবেন? দুঃসময়ে একসঙ্গে থাকা দুই ভাই পরবর্তী জীবনে দুই বিপরীত মেরুর মানুষে পরিণত হবেন? একজন হবেন রাজনীতিতে অপটু, চিন্তায় উদার, কবি, দার্শনিক ও কল্পনাপ্রবণ। অন্যজন দুধর্র্র্ষ যোদ্ধা, তীক্ষ্ণ রাজনীতিক, কঠোর শাসক ও গোড়া ধর্মনিষ্ঠ। এমনকি, মুঘল ক্ষমতা দখলের জন্য হবেন পরস্পরের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী এবং একজন প্রাণ হারাবেন অপরজনের বাহিনীর হাতে?
মুঘল রাজনীতিতে নিকটজনকে হত্যা করার কাহিনী বিরল নয়। হুমায়ুনের হাতে নিহত হন ভাই কামরান। আকবর প্রতিদ্বন্দ্বী ভাই আদম খানকে বিনা বিচারে স্বহস্তে হত্যা করেন। জাহাঙ্গীরের প্রতিদ্বন্দ্বী পুত্র খসরুকে বিনা বিচারে চক্ষু উৎপাটন করা হয় এবং পরে খুররম (শাহজাহান) খসরুকে হত্যা করেই ক্ষমতাসীন হন। কিন্তু আওরঙ্গজেবও তার সিংহাসন লাভের পথে পর তিন ভাইকে চরমভাবে দমন করেই সফল হন। তবে তিনি স্বহস্তে নয়, বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদ- দেন দারাশিকোহকে, শাস্তি দেন মুরাদকে এং সেনাহিনীর তীব্র আক্রমণে শাহ শুজাকে আরাকানে পাঠিয়ে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেন।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন বাবর (১৪ ফেব্রুয়ারি ১৪৮৩-২৬ ডিসেম্বর ১৫৩০) থেকে শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর (২৪ অক্টোবর ১৭৭৫-৭ নভেম্বর ১৮৬২) পর্যন্ত সুদীর্ঘ তিন শতাধিক বছরের মুঘল শাসনকালে সম্রাট না হয়েও দারাশিকোহ সমানভাবে আলোচিত এবং উল্লেখযোগ্য। তবে সেটা রাজনৈতিক কারণের পাশাপাতিার নিজের সুকুমার ও শৈল্পিক-বুদ্ধিবৃত্তিক বৈশিষ্ট্যের জন্য। ঐতিহাসিক লেনপুল যেমন বলেছেন, ‘তিনি হয়তো হতে পারতেন এজন কবি ও শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। তিনি কখনোই হতে পারতেন না ভারতের সম্রাট।’
মন্তব্যটি চরম সত্য এজন্য যে, দারাকে সম্রাট শাহজাহান উত্তরাধিকার মনোনীত করলেও তা প্রতিষ্ঠিত রাখা দারার পক্ষে সম্ভব হয় নি। সুবিধাজনক অবস্থান, পিতার আনুকূল্য ও বিশাল বাহিনী থাকার পরেও ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব ও গৃহযুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয় ও মৃত্যু ঘটে তার। তারপরেও দারাশিকোহ মুঘল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে মহামতি মুঘল সম্রাট আকবরের (১৫ অক্টোবর ১৫৪২-২৭ অক্টোবর ১৬০৫) সমন্বয়বাদী ধর্মমত পুনঃপ্রতিষ্ঠাকারী ও একজন দার্শনিক, চিন্তক হিসেবে আলাচিত। এবং এই মর্মে তিনি মূল্যায়িত হন যে, ‘যিনি হতে পারতেন মুঘল সম্রাট’।
অনেকগুলো ‘যদি’ দারাশিকোহর ভাগ্য ও ইতিহাসের সঙ্গে একাকার হয়ে আছে। ‘যদি’ তিনি মুঘল সম্রাট হতেন, তাহলে ভারতে সাম্প্রদায়িকতা থাকতো না, হয়ত ভারত ভাগও হতো না, এমন মন্তব্য অনেকেই করেছেন। কিন্তু ‘যদি’ ও সম্ভাব্যতা দিয়ে ইতিহাস রচনা করা অসম্ভব। ইতিহাস যা বা যেমন হয়েছে, তারই বিশ্লেষণ। এতে দারাশিকোহকে একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ রূপে পাওয়া যায়। পাওয়া যায় মুঘল ইতিহাসের ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে। যদিও আওরঙ্গজেব ছাড়া সম্রাট শাহজাহানের অপর তিন পুত্র, দারা, শুজা, মুরাদ, সকলেই ট্র্যাজিডির শিকার। তবুও সম্রাট হতে না পারার জন্য দারা ব্যর্থ বিবেচিত হলেও নিজের দার্শনিক চিন্তা, নন্দনকলা ও সুকুমার বৃত্তির জন্য আলোচিত। মুঘল সম্রাটদের দীর্ঘ তালিকায়, বাবর থেকে বাহাদুর শাহ জাফর পর্যন্ত একমাত্র দারাশিকোহ সম্রাট না হয়েও ইতিহাসের পাতায় সম-মর্যাদায় আলোচিত।
আরও পড়ুন: দারাশিকোহ: যিনি হতে পারতেন মুঘল সম্রাট