মৃত্যুনীল নদের আখ্যান, পর্ব- ২



তাশরিক-ই-হাবিব (অনূদিত)
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সাতিপি ইয়ামোসের সঙ্গে আলাপ করছিল।  তার গলা এমনই উচ্চকণ্ঠের যে তা খুব কমই বৈচিত্র্যপূর্ণ মনে হয়।

“তুমি অবশ্যই নিজেকে জাহির করবে, যা আমি স্পষ্ট বলছি। তুমি নিজেকে গুটিয়ে রাখলে কখনোই কেউ তোমাকে গুরুত্ব দেবে না। তোমার বাবা বলেন যে এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে এবং কেন তুমি সেসব করোনি? এবং তুমি তাতেই জো হুজুর জো হুজুর করো! তুমি কিছুই না ভেবে তার কথায় সায় দাও আর ওপরওয়ালাই জানেন, সেসব করা আদতে অসম্ভব! তোমার বাবা তোমাকে বাচ্চা, দায়িত্বজ্ঞানহীন বালকের মতোই ভেবে তেমন আচরণ করেন। যেন তুমি আইপির বয়সী!”

ইয়ামোস শান্তভাবে বলে:

“আমার বাবা আমাকে অন্তত আইপির মতো একইভাবে দেখেন না!”

“না, আসলেই তেমন।” সাতিপি নতুন বিষ প্রয়োগে এবার উদ্যমী হলো, “তিনি ঐ বখাটে ছোকরার ব্যাপারে তালকানা। দিনের পর দিন আইপির  বাড় বেড়েই চলেছে। সে যেখানে যেমন খুশি চড়ে বেড়ায় এবং কাজে সাহায্য করে না এবং এমন ভান করে যে তাকে যে কাজ করতে বলা হয়, তা তার জন্য খুবই পরিশ্রমের! ব্যাপারটা অপমানজনক!  এসবই ঘটছে কারণ সে জানে যে তোমার বাবা তাকে লাই দেবে এবং তার পক্ষে থাকবে। তোমার ও সোবেকের এ ব্যাপারে শক্ত হওয়া উচিত।”

ইয়ামোসে ঘাড় বেঁকায়।

“কোনটা ভালো?”

“তোমার জ্বালায় আমি পাগল হয়ে যাবো, ইয়ামোস - তা-ই তো তুমি চাও! তুমি একটা ভীতুর ডিম! তোমার সাহস বলে কিছু নেই। তুমি মেয়েদের মতো মেনিমুখো। তোমার বাবা যা বলেন তাতেই তুমি সঙ্গে সঙ্গে নাচো!”

“আমি সবসময়ই বাবার অনুগত।”

“ঠিক তাই, সেকারণেই তিনি সেই সুযোগ নেন। তুমি মেনিমুখো হয়ে সব দায় হজম কর আর যেসবের দায় তোমার নয়, সেসব বোঝাও বয়ে বেড়াও। তোমারও কথা বলা উচিত এবং সোবেক তাকে যেভাবে জবাব দেয়, সেভাবেই জবাবও দেয়া উচিত। সোবেক কাউকে ভয় পায় না।”

“তা ঠিক। তবে মনে রেখ সাতিপি, বাবা আমাকে বিশ্বাস করেন, সোবেককে নয়। বাবা তার ওপর ভরসা করতে পারেন না। সবকিছুর ব্যাপারে  চূড়ান্ত মত আমি দেই, সোবেক নয়।”

“এবং সেকারণেই এ জমিদারিতে তুমি অংশীদার হিসেবে থাকতেই পারো! যখন তোমার বাবা জমিদারির বাইরে থাকেন, তখন তুমি তার প্রতিনিধিত্ব কর। এমনকি তখন পৌরোহিত্যের দায়ও তোমার ওপর বর্তায়। সবকিছুর ভার তোমার ঘাড়ে চাপে অথচ তোমার কোনো স্বীকৃত কর্তৃত্বই নেই। পুরো ব্যাপারটার বন্দোবস্ত ঠিকঠাক হওয়া দরকার। তুমি এখন মধ্যবয়সী সংসারী মানুষ। এটা মেনে নেয়া যায় না যে তোমার সঙ্গে বাচ্চাসুলভ আচরণ করা হবে।

ইয়ামোসে সন্দিহানভাবে বলে:

“আমার বাবা নিজেই বৈষয়িক তদারকি পছন্দ করেন।”

“ঠিক তাই। এ ব্যাপারটা তাকে আনন্দ দেয় যে এ বাড়ির সবকিছুই তার ওপর নির্ভরশীল থাকুক - এবং এভাবেই প্রতিটি মুহূর্ত কাটুক! এর ফলে ব্যাপারটা খারাপের দিকে যাচ্ছে। তিনি এবার বাড়ি এলে তুমি তাকে অবশ্যই শক্তভাবে চেপে ধরবে আর তাকে অবশ্যই স্পষ্টভাবে জানাবে যে তুমি জমিদারির অংশিদারিত্ব চাও, যার বন্দোবস্ত লিখিতভাবে সম্পন্ন হবে।”

“তিনি শুনবেন না।”

“তুমি তাকে শুনতে বাধ্য করবে। ওফ, আমি যদি মরদ হতাম! তোমার জায়গায় আমি থাকলে দেখিয়ে দিতাম কত ধানে কত চাল! কখনোবা আমার মনে হয়, আমি একটি মহিলাকে বিয়ে করেছি।”

ইয়ামোসে জ্বলে ওঠে।

“আমি দেখব কী করা যায় - আমি সম্ভবত এ ব্যাপারে বাবার সঙ্গে কথা বলব - তাকে জিজ্ঞেস করব -”

“তুমি জিজ্ঞেস করবে না - তুমি অবশ্যই দাবি জানাবে! সবকিছুর পর, তার চাবুক তোমার হাতেই রয়েছে। এখানে তুমি ছাড়া অন্য কেউ নেই, যার কাছে সে এ জমিদারির তদারকির দায়িত্ব চাপাতে পারে। সোবেক এখনো যথেষ্ট অবাধ্য, তোমার বাবা তাকে বিশ্বাস করেন না, আর আইপি বয়সে খুব কাঁচা।”

“সেজন্যই হোরিকে রাখা হয়েছে।”

“হোরি এ পরিবারের কেউ নয়। তোমার বাবা তার বিবেচনায় ভরসা করেন কিন্তু তাই বলে নিজের কর্তৃত্ব তার হাতে তুলে দেবেন না। কিন্তু আমি দেখছি যে তুমি নিতান্তই মেনিমুখো আর সস্তা। তোমার শিরায় রক্ত  নয়, যেন দুধ বইছে!  তুমি আমার বা আমাদের বাচ্চাদের কথা ভাবো না। তোমার বাবা মারা যাবার আগ পর্যন্ত আমরা কি প্রাপ্যটুকু বুঝে পাব না!

ইয়ামোস ভারী গলায় বলে:

“তুমি আমাকে তাচ্ছিল্য করছ, তাই না সাতিপি?”

“তুমি আমাকে রাগাচ্ছ।”

“শোনো, আমি তোমাকে বলেছি যে বাবা বাড়ি এলে আমি তাকে এসব ব্যাপারে জানাব। প্রতিজ্ঞা করছি।”

সাতিপি দম চেপে ধরে বলে ওঠে :

“হ্যা- কিন্তু তুমি কীভাবে বলবে? মরদের মতো, নাকি ইঁদুরের মতো?”

২.

কাইট তার ছোট বাচ্চা আঙ্কের সঙ্গে খেলছিল। বাচ্চাটি সবে হাঁটতে শুরু করেছে এবং কাইট তাকে হাসিমুখে তানানানা করতে করতে উৎসাহ দিচ্ছিল। কাইট বাচ্চাটির সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে সামনের হাতটি বাড়িয়ে রেখেছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না অনিশ্চিতভাবে পা বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বাচ্চাটি তার মায়ের বাহুতে ধরা দিচ্ছিল।

কাইট পুরো ব্যাপারটি সোবেককে দেখাতে চাইছিল, কিন্তু অচিরেই সে বুঝে উঠল যে সে এদিকে মনোযোগী নয় বরং কপাল কুঁচকে বসে ছিল।

“আহ সোবেক, তুমি দেখছ না। সোনামণি, তুমি তোমার বাবাকে বলে দাও যে সে দুষ্টুমি করছে তোমার কা-কারখানা না দেখে।”

সোবেক  বিরক্তভরা কণ্ঠে খেঁকিয়ে ওঠে:

“আমি অন্য কিছু ব্যাপারে ভাবছি, সেসব নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে।”

কাইট তার গোড়ালির হিল পেছনে ফেরায়,  তার ঘাড়ের ওপর ফেলে রাখা মসৃণ চুলগুলো সোজা করে। বাচ্চাটির আঙুলগুলো তাকে ধরে রেখেছিল।

“কেন? কোথাও কি ঝামেলা হয়েছে?”

কাইটের কথাতেও মনোযোগ ছিল না। প্রশ্নটা যেন দায়সারাভাবে করা হয়েছে।

সোবেক রেগে গিয়ে বলে:

“সমস্যা এটাই যে আমাকে বিশ্বাস করা হয় না। আমার বাবা একজন বৃদ্ধ, তার চিন্তা ভাবনা একেবারেই সেকেলে ধরনের, এবং জমিদারির প্রতিটি ব্যাপারে তার খবরদারি করা চাই - তিনি আমার ভরসায় কিছুই ছেড়ে দিতে চান না।”

কাইট তার মাথা নামিয়ে অস্পষ্টভাবে প্রতিবাদ করে-

“আসলেই, এটা খুব খারাপ ব্যাপার।”

ইয়ামোস যদি আরেকটু সাহসী হত আর আমাকে সমর্থন করত তবে বাবাকে বাগে আনা তেমন কঠিন হত না। কিন্তু সে আসলে ভীতুর ডিম। বাবা চিঠিতে তাকে যেসব নির্দেশ দেন, সে সবই ঘাড় গুঁজে পালন করে।”

কাইট বাচ্চার গলায় থাকা জপমালা ঝাঁকাতে  ঝাঁকাতে বলে :

“আসলেই, ঠিক বলেছ।”

কাঠের ব্যাপারে আমি অবশ্যই আমার বিবেচনা বাবাকে জানাব তিনি বাড়ি এলে। এটা ঢের ভালো হয়েছে তেলের বদলে শনবাবদ দাম গ্রহণ করায়।”

“আমি নিশ্চিত, তুমি ঠিক কাজই করেছ।”

“কিন্তু  বাবা তার গৎবাধা পথের বাইরের যে কোনো ব্যাপারেই বাধা দেন। তিনি হম্বিতম্বি করবেন, আমি তোমাকে তেলের দামে এ ব্যবসা করতে বলেছিলাম। আমি জমিদারিতে না থাকলে সবকিছুই ভুলভাবে করা হয়। তুমি একটি বোকা বালক, যে কিছুই করতে জানো না। আমার বয়স কত, সে ব্যাপারে তিনি কী মনে করেন? তিনি বোঝেন না যে আমি আমার কালের পূর্ণাঙ্গ একজন মানুষ এবং তিনি বিগত হচ্ছেন! তার নির্দেশ এবং তার দৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিক এমন যে কোনো লেনদেনের মানে হলো আমরা ব্যবসায় উন্নতি করতে পারি না অথচ আমরা তা করছি। ধনী হতে হলে কিছু ঝুঁকি তো নিতেই হবে! আমার দূরদৃষ্টি ও সাহস আছে, বাবার কোনোটিই নেই।”

বাচ্চার ওপর চোখ রেখে কাইট ধীরগলায় বলে :

“তুমি খুব বেপরোয়া ও চালাক, সোবেক।”

“কিন্তু তিনি যদি বাড়ি সংক্রান্ত কিছু সত্য ব্যাপারে এখন জানতেন এবং তাতে দোষ খুঁজে বের করে আমাকে নাকাল করতেন, তবে বেশ হত! আমাকে যদি নিজের মতো করে চলার সুযোগ দেয়া না হয়, আমি এসবে থাকব না। বরং চলে যাব।”

কাইট বাচ্চাটির দিকে হাত বাড়ায়, তার দিকে মাথা ঘুরিয়ে পাকড়াও করার ভঙ্গিতে বলে-

“চলে যাবে? কোথায় যাবে তুমি?”

“যে কোনো জায়গায়!  এটা মেনে নেয়া আমার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার যে একজন উচ্ছৃঙ্খল, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ আমাকে কোনোভাবেই নিজের মতো কাজ করার সুযোগ দিচ্ছেন না। তাহলে আমি কী করব?”

“না, কাইট কৌশলী ভঙ্গিতে বলে “আমি বলছি সোবেক, না।”

সোবেক স্ত্রীর দিকে তাকায়, কাইটের কণ্ঠস্বর খেয়াল করে তার উপস্থিতি বুঝতে পারে।  সে তার স্ত্রীর প্রতি এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে কোনো ব্যাপারে আলাপের ক্ষেত্রে কাইট যে মানুষ হিসেবে নিজস্ব অস্তিত্ব বহন করে, তারও যে নিজস্ব চিন্তা করার সামর্র্থ্য আছে, তা সে ভুলেই বসেছিল।

“তুমি কী বলতে চাও, কাইট?”

“আমি এটাই চাই যে তুমি বোকামি করবে না। পুরো জমিদারির মালিকানা তোমার বাবার নামে - জমি, সেচব্যবস্থা, গবাদি পশু, কাঠ, শনের খেত - সব। তোমার বাবার মৃত্যুর পর এসবই তোমাদের হবে তোমার আর ইয়ামোসের আর আমাদের বাচ্চাদের। তুমি তোমার বাবার সঙ্গে ঝগড়া করলে এবং চলে গেলে তখন তিনি তোমার ভাই ইয়ামোসে ও আইপির মাঝে তা ভাগ করে দিতে পারেন। তাছাড়া তিনি আইপিকে অত্যধিক ভালোবাসেন। আইপি তা জানে বলেই কাজে লাগানোর ধান্দা করে। তুমি আইপির হাতের খেলনা হবে না। এটা তাকে খুব ভালো সুবিধা দেবে, যদি তুমি ইমহোটেপের সঙ্গে ঝগড়া করে চলে যাও। আমাদের অবশ্যই বাচ্চাদের দিকটা নিয়ে ভাবতে হবে।”

সোবেক তার দিকে তাকায়, তারপর বিস্ময়ের হাসি হাসে।

“একজন নারীকে আগেভাগে কখনোই বোঝা যায় না। আমি আগে টের পাইনি, কাইট, যে তুমি এত বুদ্ধিমতি।”

কাইট আন্তরিকভাবে বলে:

“তোমার বাবার সঙ্গে ঝগড়া কর না। তার কথার জবাব মুখে মুখে দিও না। আর কটাদিন সবুর কর।”

“তুমি বোধহয় ঠিকই বলছ, কিন্তু এই অবস্থা কয়েক বছর যাবত চলতে পারে। বাবা চাইলে আমাদেরকে তার জমিদারীতে অংশীদার করে নিতে পারে।”

কাইট মাথা নেড়ে বলে

“তিনি তা করবেন না। কারণ তিনি একথা বলতে ভালোবাসেন যে আমরা তার ঘাড়ে চেপে খাই, তার ওপর ভর করে বেঁচে আছি, তিনি না থাকলে আমাদের বাঁচবার জো নেই।”

 সোবেক কৌতূহলভরে তাকে দেখে।

“তুমি আমার বাবাকে তেমন পছন্দ কর না, কাইট।”

সে প্রসঙ্গে কথা বলার বদলে কাইট বাচ্চার প্রতি মনোযোগ দেয়।

“এসো, সোনামণি, - দেখ, এই যে তোমার পুতুল।”

সোবেক তার বাঁকানো কালো চুলের দিতে তাকায়। তারপর খানিকটা বিভ্রান্ত মুখে সে ফিরে যায়।

৩.

এশা তার নাতি আইপিকে ডেকে পাঠিয়েছে। সেই সুদর্শন কিশোর যৌবনে পদার্পণ করছে, চেহারাতে অসন্তোষের ভাব প্রবল। পাশে দাঁড়ানো তরুণকে বৃদ্ধা বেশ তীক্ষ্ম কণ্ঠে শাসাচ্ছিলেন। তার চোখজোড়া ম্লান আর ইদানীং তেমন ভালোভাবে দেখতে না পেলেও এখন সেগুলো যেন জ্বলছিল.

“আমার কানে এসব কী আসছে?” তোমার হাজারটা বায়না, এটা করবে না, ওটা করবে না! তুমি গবাদি পশুর দেখাশোনা করতে চাও, ভালো কথা। কিন্তু তুমি ইয়ামোসের সঙ্গে যেতে চাও না, খেতের কাজের তদারকিও করবে না, এ কেমন কথা? তোমার মতো একটা বাচ্চা ছেলে যখন এসব বায়না করে, তার ফল  কী হয়, জানো?”

আইপি অদ্ভুতভাবে বলে :

“আমি কচি খোকা নই। আমি বড় হচ্ছি, তবে কেন আমাকে ছেলেমানুষ ভাবা হবে? আমাকে কাজের হুকুম দেয়া হবে আর নিজের মতো করে কাজ জন্য কোনো  ভাতাও আলাদাভাবে পাব না! ইয়ামোস আমাকে সবসময় কাজের হুকুম দেয়! সে কি ভাবে?”

“সে তোমার বড় ভাই আর তোমার বাবা জমিদারিতে না থাকলে এর দায়িত্ব ইয়ামোসের ওপর অর্পিত।”

“ইয়ামোস নির্বোধ - ধীরগতির নির্বোধ। আমি তারচেয়ে ঢের চালাক। সোবেকও বোকা কারণ সে খুব ফুটানি মারে যে ভারী বুদ্ধিমান!  বাবা চিঠি লিখে জানিয়েছেন যে আমি আমার পছন্দসই কাজ করতে পারব।”

“ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়” বিরক্তিসহ এশা বলে।

“আর আমি যদি আরো বেশি খাবার ও পানি না পাই আরি তিনি যদি শোনেন যে আমি অসন্তুষ্ট  এবং  কেউ আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি, তিনি ক্ষিপ্ত হবেন।”

কথা বলার সময় সে চতুর, বাঁকানো হাসি হাসে।

“তুমি অকালে পেকেছ”, এশা সজোরে বলে। “ ইমহোটেপকে ব্যাপারটা জানাতে হয়।”

“না.  দাদী, তুমি তাকে এসব বলবে না।”

তার হাসি বদলে যায়। কিছুটা দুঃখভারাক্রান্তভাবে সে অনর্থকই বলে :

“এ বাড়িতে শুধু তোমার আর আমার মাথায় খানিকটা ঘিলু আছে।”

 “তোমার বিদ্বেষ!”

“আমার বাবা তোমার ওপর ভরসা করেন - তিনি জানেন, তুমি বিচক্ষণ।”

“তা হতে পারে - আসলে ব্যাপারটা ঠিক তেমন -  কিন্তু আমি তোমার কাছ থেকে এসব শুনতে চাই না।”

আইপি হাসে।

“তুমি আমার পক্ষে থাকলে ভালো হত, দাদী।”

“এই পক্ষাপক্ষির মানে কী?”

“বড় দুই ভাই খুবই বিরক্তিকর। তুমি তা জানো না? অবশ্যই জানো। হেনেট তোমাকে সবকিছু বলে।  সাতিপি যেভাবে আর যতভাবে সম্ভব দিনরাত ঘ্যানঘ্যান করে ইয়ামোসের হাড় মাংস জ্বালিয়ে খায়। আর এদিকে সোবেক গাধামি করেছে কাঠ কেনার ব্যাপারে  আর বাবা বাড়ি এসে তা জানলে ভয়ানক ক্ষেপে যাবে। তুমি দেখো দাদী, দুয়েক বছরের মধ্যেই আমি বাবার জমিদারির অংশীদার হয়ে যাব আর তারপর আমি যেভাবে চাইব, বাবা সবকিছু সেভাবেই করবে।”

“তুমি, পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য হয়ে এভাবে ভাবছ?”

“ বয়স নিয়ে ভাবার দরকার কী! বাবার হাতে পুরো জমিদারির ক্ষমতা আছে আর আমি জানি, তাকে কীভাবে বাগে আসতে হবে!”

“এসব ধান্দাবাজি ছাড়ো!”

আইপি নরম গলায় বলে:

“দাদী, তুমি তো বোকা নও! তুমি বেশ ভালোই জানো, বাবা ওপরে যতই হম্বিতম্বি করুক, ভেতরে ভেতরে খুবই দুর্বল মানুষ!”

আইপি হঠাৎ কথা বলা বন্ধ করে। সে খেয়াল করে, দাদী মাথা তুলে তার কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে চেয়ে আছে। সে নিজের মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পায়, হেনেট তার ঠিক পেছনেই চুপিসারে এসে দাঁড়িয়েছে।

“তার মানে ইমহোটেপ একজন দুর্বল মানুষ”- হেনেট তার মৃদু ঘ্যাঙানো সুরে বলে, “তিনি মোটেই খুশি হবেন না, আমার মনে হয়, তুমি এই কথা বলেছ জেনে।”

আইপি অকারণে দ্রুত হেসে পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করে।

”কিন্তু তুমি তাকে বলবে না, হেনেট। ... এখন বলো তো আমাকে ... প্রতিজ্ঞা করছ, প্রিয় হেনেট ...”

হেনেট এশার দিকে পিছলে যায়। সে তার গলা মৃদু চড়ায়।

“অবশ্যই, আমি কখনো চাই না কোনো ঝামেলা পাকাক ... তুমি তা জানো, আমি তোমাদের সবার কথাই ঘাড়গুঁজে মেনে চলি। আমি কখনোই কোনোকিছু বারবার করি না, যদি না মনে হয় যে এটা আমার কাজ”

“আমি দাদীকে খোঁচাচ্ছিলাম, ব্যাপারটা ¯্রফে এটুকুই!” আইপি বলে। আমি বাবাকে বলব। তিনি নিশ্চয়ই বুঝবেন যে আমি মোটেই  গুরুত্বসহযোগে ব্যাপারটা সম্পর্কে বলিনি।

সে তীক্ষè দৃষ্টিতে হেনেটের দিকে চেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে চলে যায়।

 হেনেট তার দিকে চেয়ে এশাকে বলে-

“দারুণ একটা ছেলে - মরদ হয়ে উঠছে। আর কেমন টাস টাস করে কথাগুলো বলে গেল!”

এশা সতর্কভাবে বলে:

“সে বিপজ্জনকভাবে কথা বলে। তার মাথায় যেসব ছাইপাস ঘুরছে, সেসব আমার মোটেই পছন্দ নয়। আমার ছেলে আস্কারা দিয়ে তাকে মাথায় তুলেছে।”

“কে-ই বা তেমনটি করবে না! এমন নজরকাড়া, সুঠাম ছেলে।”

“ সুদর্শন হতে হলে মনটাও তেমন হতে হয়!” তীক্ষ্ম কণ্ঠে এশা বলে।

খানিকটা সময় চুপ করে ধীর গলায় এশা বলে:

“হেনেট - আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে।”

“ কেন, এশা? কেন তুমি এত ভাবছ? যা হোক, কর্তা দ্রুতই বাড়ি ফিরবেন এবং সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে।”

“তাই নাকি? আমার বিশ্বাস হয় না!”

খানিকটা সময় চুপ থেকে সে আবার বলে:

“আমার নাতি ইয়ামোস বাড়িতে আছে?”

“আমি খানিক আগে তাকে বারান্দার দিকে আসতে দেখেছি।”

“ যাও, তাকে গিয়ে বল, আমি তার সঙ্গে কথা বলব।”

হেনেট চলে যায়।  সে বারান্দায় এসে ইয়ামোসকে দেখে তাকে এশার খবর জানায়।

ইয়ামোস তখনই দাদীর ঘরে আসে।

এশা হঠাৎ বলে:

“ইয়ামোস, খুব দ্রুতই ইমহোটেপ এখানে আসবে।”

ইয়ামোসের শান্ত মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

“তাহলে তো বেশ ভালো হয়।”

“সবকিছুই তার পক্ষে আছে? বিষয়গুলোর বন্দোবস্ত করা হয়েছে?”

আমার বাবা যেভাবে বলেছেন,  আমার সাধ্যমতো সেভাবেই সবকিছু করা হয়েছে।

“আইপির ব্যাপার কী?”

ইয়ামোস দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

“বাবা একেবারেই অসচেতন, যা আইপি খুব ভালোই জানে। এটা তার জন্য শুভ কিছু বয়ে আনবে না।”

“তুমি অবশ্যই এ ব্যাপারে ইমহোটেপকে স্পষ্ট করবে।”

ইয়ামোস সন্দিহান হয়ে ওঠে।

এশা দৃঢ়ভাবে বলে ওঠে:

“আমি তোমার পাশেই আছি।”

“ কখনো কখনো”, ইয়ামোস দীর্ঘশ্বাস জড়ানো গলায় বলে, “চারপাশে বাধা ছাড়া আর কিছুই যেন দেখা যায় না। কিন্তু বাবা আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন করণীয় সম্পর্কে। তিনি যা যা করতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন, তার অনুপস্থিতিতে সেসব করা কঠিন - কারণ আমার হাতে কোনো কর্তৃত্বই নেই, যদিও তার প্রতিনিধি হিসেবেই শুধু আমি আছি।”

এশা ধীরে বলে:

“তুমি ভালো ছেলে - বিনয়ী ও সজ্জন। তুমি দায়িত্ববান স্বামীও; তুমি সেই প্রবাদটি আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছ - একজন পুরুষের অবশ্যই তার স্ত্রীকে ভালোবেসে সংসার রচনা করা উচিত, যেন সে সেই নারীর সান্নিধ্য উপভোগ করতে পারে এবং ভরণপোষণ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বন্দোবস্ত করতে পারে এবং যতদিন তারা বেঁচে থাকে, যেন একে অন্যের মন জয় করে  চলতে পারে। কিন্তু এ কথার আরেকটা অর্থও আছে - তাকে সংসার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে নাক গলানোর সুযোগ না দেয়া। আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম, আমার নাতি, তবে আমি অবশ্যই এ ব্যাপারে ভাবতাম।

ইয়ামোসে তার দিতে তাকায় গভীর দৃষ্টিতে, তারপর সেখান থেকে চলে যায়।

আরও পড়ুন: মৃত্যুনীল নদের আখ্যান, পর্ব- ১

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;