ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-১৫
[পঞ্চদশ কিস্তি]
কদিন ধরেই ম্যারি ভাবছেন জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। সামনের দিনগুলোর নানা পরিকল্পনাও তার ভাবনার জগতকে স্পর্শ করছে বার বার। এসব চিন্তা-ভাবনায় ক্যাভিনের প্রসঙ্গও বার বার চলে আসছে। এখন যদি ক্যাভিন অকস্মাৎ দেখা করতে আসে, তাহলে কেমন হবে?
ম্যারি হিসাব করে দেখেন ক্যাভিনের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ও অসাক্ষাতের সময়কাল আঠারো বছর অতিক্রম করেছে। ক্যাভিন কিছুদিন আগেই পঞ্চাশে পা দিয়েছে। ম্যারিও অর্ধশতাব্দীর চৌকাঠের দিকে গুটিগুটি এগোচ্ছেন। ম্যারির সঙ্গে ক্যাভিনের বয়সের দূরত্ব তিন বছরের বেশি নয়। প্রথম তারুণ্যের সম্পর্ক, আবেগ ও উচ্ছ্বাসের দিনগুলো পেরিয়ে দুজনেই এখন পরিণত ও অভিজ্ঞ। তবু বয়সের অভিঘাত এখনও দু’জনকে তেমন কাবু করতে পারেনি। ক্যাভিন তেজি ঘোড়ার মতো দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ম্যারি চরম নিঃসঙ্গতাকে বুকে চেপেও সচল।
আসলে দু’জনেই কর্মজীবনের বিপুল ব্যস্ততায় নিজেদের অতিসচল রাখতে বাধ্য হয়েছেন। ম্যারির ক্ষেত্রে পরিবারের দাবি, চারপাশের লোকজন এবং পরিচিতদের প্রয়োজনীয়তা, সর্বোপরি বেঁচে থাকার অত্যন্ত কেজো চাহিদাগুলো মিটিয়ে অতি অল্প সময়ই অবশিষ্ট থাকে, যাকে লোকে বলে অবসর। ক্যাভিন চলে যাওয়ার পর অফুরন্ত সময় ম্যারি পেলেও অখণ্ড ও ভারমুক্ত অবসর পায় নি। এমন অবসর, যাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিশ্চিন্তে চলে যাওয়া যায় প্রকৃতির কাছে বা কোনো অজানা জনপদে।
ম্যারির ক্ষেত্রে একাকীত্বের একটা অভিঘাত ছিল। আঘাত সামলানোর জন্য সময় দরকার ছিল তার। টমাসকে লালন-পালনের দায় ছিল। নতুন করে ক্যারিয়ার গড়ার চাপ ছিল। এসবের মধ্যে অবসর পাওয়া হয় নি ম্যারির। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বড় আকারে আর্ট ভিলেজ তৈরির আগে তিনি অবসর বের করে কোথাও কিছুদিন ঘুরে আসবেন।
নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে ম্যারি বাগানে গিয়ে আনমনে পায়চারি করছিলেন, নিজেরও তা খেয়াল নেই। চমকে উঠলেন পেছন থেকে পল্লবীর গলা শুনে,
“সুপ্রভাত!”
পল্লবীর দিকে ফিরে হাসলেন ম্যারি।
“কখন এলে তুমি?”
“এই তো এলাম। শোন এই গাছটা চেনো? ওই যে বড় বড় পাতা? লম্বাটে ফুল। বাইরের পাপড়িটা খসখসে খয়েরি। আর ভেতরে সাদা পাপড়ি। এর শক্ত শক্ত ফল হয়। আর তার ভেতরে বীজগুলো আরশোলার ডানার মতো। ছেড়ে দিলে ঘূর্ণিপাক খেতে খেতে নামে। নামটা বইয়ে আছে। সবাই পড়েছে ছোটবেলায়। কিন্তু এই গাছটাকে অনেকেই নামে চেনে না। কলকাতায় আমাদের স্কুলের কাছে এই গাছটা ছিল বলে আমি চিনি। ওর নাম মুচকুন্দ। কেউ কেউ বলেন কনকচাঁপা।”
“নামটা শুনেছি মনে হচ্ছে। তুমি তো বেশ গাছ চেনো!”
“ওই দু’-চারটে। গাছ চেনা সহজ। সামনের লেকের পাড়ে ছোট্ট পার্কটায় অনেক গাছে নাম লেখা রয়েছে। তবে সেগুলো ছাড়াও গাছ আছে যার নাম আমি জানি। থাক ও-সব কথা। চল সামনের লেকে গিয়েই বসি। সঙ্গে একটু চা নিয়ে কথা বলি তোমার সাথে।
“চা-ওয়ালা এই সময় পাবে না। লোকজন নেই, ছুটির দিনও নয় আজ। তার উপর মহামারির ছায়ায় পুরো পৃথিবীর মতোই বিষণ্ণ হয়ে আছে আমাদের এই ছোট্ট ক্যাম্পাস শহর।”
“তা ঠিক। তবু চলো আজ বাইরেই বসি।”
“চলো। কিন্তু আমার মধ্যে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক করছে। তুমি কি আগেও এতটা ফিলসফিক আর গাছপাগল ছিলে?”
কোনও উত্তর দেয় না পল্লবী। আলগা হাসিতে পথ চলতে চলতে শুধু ফিকে করে দেয় ম্যারির প্রশ্নটাকে। পরিণত বয়সের পথে বুঝি মানুষের ঝুলিতে চুপ করে থাকার নানা কৌশল ভরে দিয়ে যায়।
বেশ খানিকটা সময় চুপ থেকে পল্লবী বলে,
“গৃহী মানুষের মতো সব পথিকও চায় একটা গাছ। যার তলায় বসে মিলবে ফেলে আসা পথের দিকে তাকানোর অবসর। মাথার উপরে সেই গাছ কত ফুল কত ফলের অভিজ্ঞতা দিয়ে এক একটা বর্ষবলয় আঁকবে তার অন্তরে। সব কুঁড়ি ফুল হয় না বা সব ফুল থেকে ফল। তবু গাছকে পথিক কি ভুলতে পারে! জীবনের পূরণ না হওয়া সম্ভাবনা, অসমাপ্ত গল্পগুলো গাছের পাশাপাশি ঘুমিয়ে থাকে ক্লান্ত পথিকের মনেও।”
ততক্ষণে লেক সামনে নিয়ে ছোট্ট পার্কের বেঞ্চিতে বসে তন্ময় হয়ে পল্লবীর কথা শুনছিলেন ম্যারি। আসলে মেয়েটি কি বলতে চায়? শুধু কথা বলার জন্য কথা বলে না এই মেয়ে। অনেক গভীর, স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল মেয়েটিকে ম্যারি এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেন নি। বরং তিনি মাথার উপরে পাকুড় গাছটার সঙ্গে একাত্মবোধ করেন। সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তারপর সরাসরি তাকিয়ে থাকেন পল্লবীর দিকে। আচমকাই কথা বলে পল্লবী,
“ক্যাভিনের সঙ্গে কথা হয়?”
একটা ঝাঁকি অনুভব করেন ম্যারি। সেটা বুঝতে দেন না পল্লবীকে। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি স্বাভাবিক গলায় উত্তর দেন,
“না রে। ওর সঙ্গে দেখা তো হয়ই নি অনেক দিন। কথাও হয় নি।”
“মনে পড়ে ওর কথা?”
“জানি না। কিন্তু টের পাই, কেমন করে যেন একটা ক্ষীণ যোগসূত্র রয়েই গিয়েছে।”
“কেন বল তো?”
“কে জানে!”
“এই বয়সে এসে আর এড়াচ্ছো কেন? সত্য স্বীকারের আনন্দকে নস্যাৎ করে লাভ নেই কোনো।”
“তা নেই। আবার অকপটে আমার মনের কথা বলব, তেমন পরিবেশ আর মানুষ কোথায়? আর নিজের একান্ত সব কথা শেয়ার করাও বিব্রতকর মনে হয় আমার কাছে।”
চুপ করে ম্যারির কথাগুলো শুনে পল্লবী। কিছুই বলে না মেয়েটি। ম্যারিও তাকিয়ে থাকেন পল্লবীর দিকে। ম্যারির মনের কথাটা মুখে প্রায় এসে গিয়েছিল আজ। তবু পারলেন না। কে আটকাল তাকে! সংস্কার কিংবা সংকোচ? তিনি দীর্ঘ বেদনার গল্পগুলো এই মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলার একটা সুপ্ত আকাঙ্খা নিজের মধ্যে সংগোপনে রেখে দেন।
লেকের পাড়ে পার্কের ঢালে একটি পুরনো পাকুড় গাছের গুঁড়িটাকে কেন্দ্র করে বসেছিল দু’জনে। এক সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল হঠাৎই। এই অদ্ভুত সমাপতনে দু’জনেই হেসে ফেললেন। সেই রেশটুকু নিয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে দু’জনে। পরস্পরের বিপরীতে। গন্তব্য দু’জনেরই আলাদা। মাঝখানের ফারাক বাড়তে বাড়তে একসময় সেই ঘন পাতায় ছাওয়া পাকুড় গাছটার নজর থেকে মিলিয়ে যান দু’জনে। দু’জনের মনেই বহু দিনের লালন করা একটা প্রশ্ন আর একটা উত্তর। তারা দুজনেই জানে, আবার কখনও হয়তো এই গাছের তলায় দেখা হবে তাদের। হয়তো পাকুড় গাছটার বর্ষবলয়ে সে দিনও আঁকা হবে গৃহী হয়েও দুই পথিকের না-হওয়া প্রশ্নোত্তরের ইঙ্গিত।
[পরবর্তী কিস্তি আগামী শুক্রবার]