সিপাই বিদ্রোহ: দমনের দোসর হয়েছিলেন যারা
পলাশী যুদ্ধের শতবর্ষের পর ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ওয়াহাবিদের প্রচার-প্রচারণা ভারতীয় জনগণকে, বিশেষ করে ব্রিটিশ বাহিনীতে কর্মরত বঞ্চিত ভারতীয় সিপাইদের ব্রিটিশ শাসন উৎখাতে উজ্জীবিত করেছিল। অসাম্য-বৈষম্যের শিকার ভারতীয় সিপাইরা ব্রিটিশদের ওপর চরমভাবে ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। ওয়াহাবিদের ব্রিটিশবিরোধী প্রচার-প্রচারণা সিপাইদের বিদ্রোহ সংঘটনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বিক্ষুব্ধ সিপাইদের জন্য এনফিল্ড রাইফেলের বিশেষ নতুন টোটা প্রবর্তন বিদ্রোহের সূত্রপাত। এই টোটা মুসলিম ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের পক্ষে অস্পৃশ্য শূকর-গরুর চর্বিমিশ্রিত যেটি দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে বন্দুকের নলে ঢোকানো হত।
এ কারণে এই টোটা দুই সম্প্রদায়ের কারো পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। তবে একথার সত্যতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। বাস্তবতা ছিল এ রটনা বিক্ষুব্ধ সিপাইদের মধ্যে ছড়ানো হয়েছিল উদ্দেশ্যমূলকভাবে। যার প্রমাণের অপেক্ষা পর্যন্ত সিপাইরা করে নি। তাৎক্ষণিক এই টোটা ব্যবহারে তীব্র ঘৃণায় ইংরেজদের আদেশ প্রত্যাখ্যানে একশত বছরের নিয়ম-শৃঙ্খলা ভেঙেছিল। নতুন টোটা ব্যবহারকে কেন্দ্র করেই ভারতীয় হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সিপাইরা জোটবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ সংঘটিত করেছিল। সিপাই বিদ্রোহ সুশৃঙ্খলভাবে সংগঠিত হতে পারে নি সত্য। তবে বিদ্রোহ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ১৮৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এনফিল্ড রাইফেলের নতুন টোটা প্রবর্তনে সৃষ্ট সিপাই অসন্তোষ দ্রুতই বিদ্রোহে পরিণত হয়ে পড়ে। টোটা ব্যবহার নিয়ে সৃষ্ট বির্তক-অসম্মতি ছিল নেহায়েত উপলক্ষ মাত্র। পেছনের কারণ ছিল দীর্ঘকালের জমে থাকা ক্ষোভ। যার মূলে ছিল বঞ্চিত সিপাইদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ। সিপাইদের নগণ্য বেতন, পদমর্যাদা, নিম্নস্তরের আবাস-খাদ্য ইত্যাদি। তাদের প্রতি ইংরেজদের আচরণ ছিল প্রভু-ভৃত্যের সমতুল্য। ভারতীয় সিপাই ও ইংরেজদের বেতন, সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য ছিল গগনস্পর্শী। এই বিদ্রোহে তারই প্রকাশ ঘটেছিল।
সিপাই বিদ্রোহের প্রারম্ভিক সূত্রপাত বঙ্গদেশে। ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরের সিপাইদের প্যারেড গ্রাউন্ডে ইংরেজবিরোধী অভ্যুত্থানের প্রথম প্রকাশ্যে ডাক দিয়েছিলেন সিপাই মঙ্গল পাণ্ডে। বিদ্রোহী মঙ্গল পাণ্ডেকে নিবৃত্ত করতে অস্ত্র উঁচিয়ে আসা দুই ইংরেজ অফিসার এ্যাডজুট্যান্ট লেফটেন্যান্ট বাগ এবং সার্জেন্ট মেজরকে প্রকাশ্যে হত্যা করে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন সিপাই মঙ্গল পাণ্ডে। সঙ্গীদের বিদ্রোহে অংশ নেয়ার ডাক দিলেও, কেউ সেদিন তাঁর সঙ্গী হয় নি। ব্যক্তিগত একজনের পক্ষে বিদ্রোহে জয়ী হওয়া যায় না। সংগঠিত বিদ্রোহ ব্যতিরেকে বিদ্রোহ সফল হতে পারে না। সিপাই মঙ্গল পাণ্ডের একার পক্ষেও সম্ভব হয় নি প্রবল শক্তিধর ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সফল হওয়া। সঙ্গীরা তাঁর সঙ্গে যোগ দেবে, একত্রে বিদ্রোহ সংঘটিত করবে, সেটা ছিল যেমন প্রত্যাশিত, তেমনি অনিবার্যও।
মঙ্গল পাণ্ডের বিদ্রোহের প্রতি মানসিক-নৈতিক শতভাগ সমর্থনের পরও সঙ্গীরা কেউ সেদিন মঙ্গল পাণ্ডের সঙ্গী হয় নি, অংশ নেয়নি বিদ্রোহে। পরিণতিতে সংগঠিত ইংরেজ বাহিনী কর্তৃক আক্রান্তের পূর্বমুহূর্তে আত্মসমর্পণের পরিবর্তে নিজ বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন সিপাই মঙ্গল পাণ্ডে। গুলিবিদ্ধ মঙ্গল পাণ্ডেকে ব্রিটিশ শাসকেরা চিকিৎসায় সুস্থ করে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। ইংরেজ অফিসারের আদেশ অমান্যের অভিযোগে অপর ভারতীয় সিপাই ঈশ্বরী পাণ্ডেকেও একই সাথে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। মঙ্গল পাণ্ডের বীরত্বপূর্ণ আত্মদান বিফলে যায় নি। এই ঘটনা সারা ভারতবর্ষের সিপাইদের মধ্যে প্রচ- সাড়া জাগিয়েছিল। সিপাই মঙ্গল পাণ্ডের আত্মদানে উজ্জীবিত ভারতীয় সিপাইরা সংঘবদ্ধভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সেনানিবাসে-ব্যারাকে আক্রমণকারীর ভূমিকায় সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটিত করেছিল। মীরাট, দিল্লি, এলাহাবাদ, অযোধ্যা, লক্ষ্মৌ, কানপুর, ঝাঁসী, বারাণসী, পাটনা, বেরলী প্রভৃত স্থানে সিপাই বিদ্রোহ দাবানলের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজ বাহিনী আত্মরক্ষার্থে দূর-দূরান্তে পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে আত্মগোপনে বাধ্য হয়। উল্লেখিত অঞ্চল সমূহে সিপাইদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ইংরেজ অনুগত একমাত্র শিখ সম্প্রদায়ের সিপাইরা বিদ্রোহে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল। শিখ সিপাইরাই কেবল ইংরেজ আনুগত্যে সিপাই বিদ্রোহ দমনে নির্লজ্জ ভূমিকা পালন করেছিল। এই বিদ্রোহের বিপক্ষে শিখ সিপাইরা চরম বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়েছিল। সিপাই বিপ্লব প্রসঙ্গে কার্ল মার্কস বলেছিলেন-‘উপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ।’ বিদ্রোহ সুশৃঙ্খল যেমন ছিল না। তেমনি ছিল না সুসংগঠিতও। কেন্দ্রীয় যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এই বিদ্রোহ সফল হতে পারে নি। কার্ল মার্কস সুদূর ইংল্যান্ড অবস্থানেও সিপাই বিদ্রোহ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। সিপাই বিদ্রোহ প্রসঙ্গে তাঁর অগ্রবর্তী চিন্তার প্রকাশ পায় তাঁরই অপর মন্তব্যে-‘...নিজ সেনাপতিদের হত্যাকারী, শৃঙ্খলাবর্জিত এবং সর্বাধিনায়কদের দায়িত্ব বহনক্ষম কোনো ব্যক্তি সন্ধানে ব্যর্থ এই সব বহুধাবিভক্ত বিদ্রোহী সিপাইদের পক্ষে সংগঠিত, দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ গড়ে তোলার সম্ভাবনা খুবই সামান্য আছে।’ সিপাই বিদ্রোহের পরিণতি কার্ল মার্কসের চিন্তা-মন্তব্য বাস্তবিক আগাম বার্তারূপে প্রকাশ পেয়েছিল।
সিপাই বিদ্রোহের সূতিকাগার বঙ্গদেশের অন্য কোথাও সিপাই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়নি। ক্ষুব্ধ সিপাইদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ সেনানিবাসে-ব্যারাকেই সীমাবদ্ধ ছিল। সিপাই বিদ্রোহের সূতিকাগার ব্যারাকপুরে সিপাই বিদ্রোহ ঘটবে তেমনটি ছিল প্রত্যাশিত এবং অনিবার্যও। কিন্তু ঘটেনি। বিদ্রোহ দানা বেধেছিল মাত্র। ঘটার পূর্বেই গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ইংরেজ বাহিনী ব্যারাকপুরের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল। কলকাতা, জলপাইগুড়ি এবং ঢাকার পরিণতিও ছিল অভিন্ন। চট্টগ্রামের সিপাই বিদ্রোহের পর ডিসেম্বরের ৪ ও ৫ তারিখে ঢাকায় বিদ্রোহের সূচনা হলেও, ঢাকার বিদ্রোহে সিপাইরা আক্রমণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেনি। ব্যারাকে, লালবাগ কেল্লায় ইংরেজ বাহিনীর দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে; প্রতিরোধ যুদ্ধে শামিল হয়েছিল। ইতিহাস-খ্যাত ঢাকার কালা-ধলার লড়াই ছিল সিপাইদের প্রতিরোধেরই লড়াই। আক্রমণের নয়।
ব্যারাকে-কেল্লায় বিদ্রোহী সিপাইদের নির্মূলে ইংরেজ বাহিনী চালিয়েছিল নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ। পরাজিত বন্দি সিপাইদের গণহারে সদরঘাটের ভিক্টোরিয়া পার্কের (পরবর্তীতে নামকরণ বাহাদুরশাহ পার্ক) পাশে আণ্টাঘরে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে ইংরেজ বাহিনী। ঢাকার সিপাই বিদ্রোহের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ইংরেজদের গোপন সংবাদ প্রদান, অস্ত্র এবং অঢেল অর্থ দিয়ে বিদ্রোহ দমনে ইংরেজ সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ঢাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী-জমিদার আব্দুল গনি। এই আব্দুল গনিকেই ইংরেজ শাসকেরা পরবর্তীতে কৃতকর্মের পুরস্কার স্বরূপ প্রশাসনিক ক্ষমতাবিহীন ঢাকার নবাব পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিল। যিনি নবাব আব্দুল গনি নামে খ্যাত। দুঃখজনকভাবে সচিবালয়ের দক্ষিণ দিকের সড়কটির ‘নবাব আব্দুল গনি রোড’ নামকরণ আজও বহাল রয়েছে। তারই পুত্র নবাব আহসান উল্লাহ এবং পৌত্র নবাব সলিমুল্লাহ। নবাব সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গে ইংরেজদের অনুগত-সমর্থক ছিলেন। ব্রিটিশদের ইচ্ছাপূরণে ১৯০৬ সালে তাঁরই নেতৃত্বে ঢাকায় গঠিত হয়েছিল মুসলিম লীগ। জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাত ধরেই সাম্প্রদায়িক দেশভাগ এবং চূড়ান্তে রক্তাক্ত দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল। গঠিত হয়েছিল সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান। নতুন এই রাষ্ট্রের প্রদেশে পরিণত হয়েছিল খ-িত পূর্ববঙ্গ।
বঙ্গদেশে সিপাই বিদ্রোহের প্রবল সম্ভাবনার পরও কোথাও বিদ্রোহ সংঘটিত হতে পারেনি। একমাত্র হয়েছিল চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের বিদ্রোহী সিপাইরা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রামের ৩৪নং রেজিমেন্টের সিপাইরা বিনা রক্তপাতে পরাভূত করেছিল ইংরেজ বাহিনীকে। আত্মসমর্পণকারী ইংরেজদের হত্যা না করে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, কারাগারের সকল বন্দিদের মুক্তি, ব্যারাক আগুন দিয়ে পুড়িয়ে, অস্ত্রাগার বিস্ফোরণে উড়িয়ে, বিপুল সরকারি অর্থ লুণ্ঠন করে চট্টগ্রাম শহরে বেরিয়ে আসে বিদ্রোহী সিপাইরা। লুণ্ঠিত অর্থ তিনটি হাতি ও দুইটি ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে বিদ্রোহের নেতা হাবিলদার রজব আলী খাঁ’র নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে স্বাধীন (করদরাজ্য) ত্রিপুরা রাজ্য অভিমুখে রওনা হয়। ত্রিপুরার শাসনকর্তা স্থানীয় মহারাজা ঈশ্বরচন্দ্র। ত্রিপুরা সরাসরি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীনে ছিল না। ত্রিপুরা রাজ্যটি তখন ছিল আরো বিস্তৃত। কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেশিরভাগ অঞ্চল ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের অধীন। বহুপরে ইংরেজ শাসনাধীনে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া পূর্ববাংলা প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। হাবিলদার রজব আলী খাঁ বিদ্রোহকে আরো ব্যাপক বিস্তৃত করার লক্ষ্যে স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যকে বেছে নিয়েছিলেন এই ভেবে যে, ইংরেজ মুক্ত মহারাজার নিয়ন্ত্রিত স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যে তাদের আশ্রয়ের সঙ্কট হবে না। সেখান থেকে রাজ্যে-রাজ্যে বিদ্রোহ ছড়িয়ে ইংরেজ মুক্ত স্বাধীন ভারতবর্ষ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে পারবে। সে উদ্দেশ্যে বিদ্রোহী সিপাইরা সংঘবদ্ধভাবে সীতাকু- পেরিয়ে পাহাড়-জঙ্গলের পথ ধরে ত্রিপুরা অভিমুখে যাত্রা করেছিল। কিন্তু বিধিবাম। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের সিপাই বিদ্রোহের সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল।
চট্টগ্রামের বিদ্রোহী সিপাইদের শায়েস্তা এবং নির্মূলে ইংরেজ বাহিনী ত্রিপুরার মহারাজাকে হুকুম প্রদান করে। ত্রিপুরার মহারাজা ইংরেজ কোম্পানি শাসনের অনুগত এবং চরম আজ্ঞাবহ। তাই মহারাজা চট্টগ্রামের বিদ্রোহী সিপাইদের দমন অভিযানের দ্রুত প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ইংরেজ শাসনামলে ভারতীয় রাজা, মহারাজা, নবাব, জমিদার সকলেই ছিল ইংরেজ অনুগত। ব্যতিক্রম দু’একজন ছিল না, তা নয়। যেমন ঝাঁসীর রানি লক্ষ্মীবাঈ। তিনি এই সিপাই বিদ্রোহে বীর বিক্রমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। অপরদিকে হায়দরাবাদের নিজাম, সিন্ধিয়া, গায়কোয়ার, ভুপালের বেগম, কাশ্মীরের গোপাল সিং, ত্রিপুরার মহারাজা প্রমুখ দেশীয় রাজন্যবর্গ কার্যত ছিল ইংরেজদের হুকুমের দাস। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন অবসানের সকল আন্দোলন-সংগ্রাম, বিদ্রোহ-বিপ্লব ইংরেজ শাসনের সুবিধাভোগী রাজা, মহারাজা, নবাব, জমিদারেরা ব্রিটিশদের পক্ষে দেশ-মাতৃকার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে উপনিবেশিক শাসনকে দীর্ঘায়িত করেছিল।
চট্টগ্রামের সিপাইরা ত্রিপুরা রাজ্যে প্রবেশের মুখে আক্রান্ত হয় ত্রিপুরার মহারাজার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে। আচানক অনভিপ্রেত আক্রমণে অনেক সিপাই মারা যায়। অনেকে হয় বন্দিও। ত্রিপুরার মহারাজার বাহিনী দ্বারা আক্রান্তে তিনটি হাতিসহ লুণ্ঠিত প্রচুর অর্থ খোয়া যায়। এমন শোচনীয় পরিস্থিতিতে দিক-দিশাহীন চট্টগ্রামের সিপাইদের সংগঠিত অংশটি ত্রিপুরার পরিবর্তে কুমিল্লার পাহাড়ের পথ ধরে মণিপুর রাজ্যের দিকে অগ্রসর হয়। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আরো কঠিন বিপদ। মণিপুর রাজ্য অভিমুখে শ্রীহট্টে চট্টগ্রামের সিপাইদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে ইংরেজ মেজর বাইঙ্গের নেতৃত্বে সুসজ্জিত পদাতিক বাহিনী। মেজর বাইঙ্গের অধীনে থাকা ভারতীয় শিখ সম্প্রদায়ের সিপাইদের নিকট চট্টগ্রামের সিপাইরা সাহায্য-সহযোগিতার আকুল আবেদন জানিয়েও সাড়া পায়নি। বিপরীতে তারা চট্টগ্রামের সিপাইদের ওপর সর্বশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেজর বাইঙ্গের নেতৃত্বে লাতু নামক স্থানে প্রচ- যুদ্ধে মেজর বাইঙ্গ নিহত হন। শ্রীহট্টের পদাতিক বাহিনীর উপর্যুপরি আক্রমণে চট্টগ্রামের প্রচুর সিপাই মৃত্যুবরণ করে। ইংরেজ নেতৃত্বের বিশাল সাঁজোয়া বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ক্লান্ত-অবসন্ন চট্টগ্রামের সিপাইদের পক্ষে যুদ্ধ জয় ছিল অসম্ভব। নিশ্চিত পরাজয় উপলব্ধি করেই বেঁচে যাওয়া সিপাইরা আত্মরক্ষার্থে লাতু এবং মণিপুরের বিস্তীর্ণ জঙ্গলে ঢুকে যায়।
মনোবলহারা চট্টগ্রামের সিপাইদের বেঁচে যাওয়া যে অংশটি জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিল তাদের শেষ পরিণতি কি হয়েছিল, সেটা আর জানা সম্ভব হয় নি। এভাবেই বঙ্গদেশে একমাত্র সংঘটিত চট্টগ্রামের সিপাই বিপ্লবের পরিসমাপ্তি ঘটে। সিপাই বিদ্রোহের বীরত্বপূর্ণ অবদানের ধারাবাহিকতায় ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ। ব্রিটিশবিরোধী লড়াই-সংগ্রামে অগ্নিযুগের বীর পুরুষ মাস্টার দা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বীর সন্তানেরা পরাক্রমশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিল ১৯৩০ সালের এপ্রিলে। দেশপ্রেমের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের নজির দেশ ও জাতির জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল বীর চট্টলা। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে পরবর্তী তিনদিন চট্টগ্রাম ছিল স্বাধীন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত। ওই তিনদিন চট্টগ্রামে উড়েছিল স্বাধীন ভারতবর্ষের পতাকা। চট্টগ্রামের স্বদেশী সশস্ত্র বিপ্লব ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবান্বিত স্মারক। দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ২৫ মার্চ পরবর্তী তিনদিন চট্টগ্রাম ছিল পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত, স্বাধীন। ওই তিনদিনও চট্টগ্রামে উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র সম্বলিত পতাকা। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের অসামান্য ভূমিকা-অবদান এবং বীরত্ব অতীতের ধারাবাহিকতার একই সূত্রে গাথা। কোনোটি কোনোটির থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, সংলগ্ন অবশ্যই। আমাদের স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সকল পর্বে চট্টগ্রামের বীরত্বপূর্ণ অবদান ইতিহাস স্বীকৃত। সেটা চট্টগ্রামের জন্য যেমন গর্বের-তেমনি জাতির জন্য অনুপ্রেরণারও নিশ্চয়।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত