কোলাজ মন্তাজ
তবু সে দেখিল কোন ভূত
বব ডিলান তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কবি ডিলান টমাস তাকে প্রভাবিত করেছেন পুরোমাত্রায়। ২০০৪ সালে হাফিংটন পোস্টে এক সাক্ষাৎকারে ডিলান বলেন, “আমার জন্ম আসলে ভুল নামে ভুল মা-বাবার ঘরে। এমনই হয়। কাজেই তুমি আমাকে যে কোনো নামে ডাকতে পারো।” সোয়ানসিয়া নামের যে শহরে ডিলান টমাস ১৯১৪ সালের অক্টোবরে জন্মেছিলেন সেই শহরে এখন আছে ‘ডিলান বুকস্টোর’ নামের বুকশপ। এর কর্ণধার জেফ টাউনস। তিনিও হাফিংটন পোস্টের একই সংখ্যায় বলেন, “আমেরিকানরা মূলত তাকে পছন্দ করা শুরু করেছে নিউইয়র্কে তার মৃত্যুর পর। বিশেষ করে রিচার্ড বাটন ও বব ডিলানের প্রশংসার পর তারা তাকে পছন্দ করতে শুরু করে। ১৯৩৪ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে তার প্রথম কবিতাগ্রন্থে ১৮টি কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ইংরেজিভাষী পাঠকের কাছে, ইংরেজি কবিতার ভুবনে আলোড়ন তুলেছিলেন। ১৯৪৬-৪৯ পর্যন্ত চলচ্চিত্র ও বেতারের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ডিলানের সৃষ্টিশীলতার আরেক অধ্যায়। জীবনকে ভালোভাবে উদযাপনের জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে তিনি অর্থ উপার্জন করেছেন। কিছুকাল বোহেমিয়ান জীবন কাটিয়ে ১৯৩৭ সালেক্যাটলিন ম্যাকনামারাকে বিয়ে করেন তিনি। এরপর চলে গেলেন সমুদ্র উপকূলের একটি গ্রামে, কারামানখেয়ার অঞ্চলে। কবিতা ও দাম্পত্য জীবন চলতে লাগল হাত ধরাধরি করে। ১৯৫২-তে ইন কানট্রি স্লিপ নামে প্রকাশিত হলো তাঁর কবিতাসমগ্র। এর আগে ১৯৪০-এ লিখেছিলেন আত্মজৈবনিক গদ্য ‘পোট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট অ্যাজ আ ইয়ং ডগ’। এ বইতে ডিলান টমাস লিখেছেন, “আমার জীবনে আমি সতেরবার সুইসাইডের চেষ্টা করি। প্রচুর মদ খেতাম। জীবনের কোনো মিনিং খুঁজে পেতাম না। আসলে নেই। যেন মানুষের জন্মই হয় বুড়ো হয়ে মরে যাওয়ার জন্য।”
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মারা যান তিনি একটি হোটেলে। হোটেলের নাম চেলসি। এখানে বসে অনেক কবি ও লেখকরা, পুরনো ঢাকার বিউটি বোর্ডিয়ের যেমন আমাদের দেশের লেখক-কবিরা একসময় লিখেছেন, তেমন লিখতেন। ডিলান টমাসের মৃত্যুকে ঘিরে আছে রহস্য। অনেকে বলেন মৃত্যুকে কাছে টেনে নেওয়া। জীবনানন্দের মৃত্যু আজও এক রহস্য, তা দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে আমার। যদিও বেশি মনে হয় আত্মহত্যাই। কারণ কবির ডায়েরিতে আত্মহত্যার আকাঙ্ক্ষা পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতার ট্রামলাইনে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন তিনি, চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ দিন পর মারা যান। ট্রামের ক্যাচারে আটকে যাওয়ার মতো সেই দুর্ঘটনা এর আগে কখনো হয়নি, পরেও নয়। অবাক বিষয় যখন জীবনানন্দ ওই ট্রাম লাইনের কাছাকাছি ছিলেন তখন তাকে ডাব খেতে খেতে হাঁটতে দেখা গেছে এমন দাবি করেছেন অতুল বসু তার লেখা, ‘জীবনান্দকে ফিরে দেখা’ (এক্ষণ প্রকাশনী) বইতে। তিনি লেখেন, “আত্মহত্যার আগে ডাব কেন খেয়েছিলেন কবি। সেদিন এক লোক দেখেছিল এ দৃশ্য। তার কাছ থেকে জেনেছিলেন অতুল বসুর প্রপিতামহ।
এই ট্রামলাইন নিয়ে জীবনানন্দ লিখেছিলেন
“কলকাতার ফুটপাত থেকে ফুটপাতে—ফুটপাত থেকে ফুটপাতে—
কয়েকটি আদিম সর্পিণী সহোদরার মতো এই যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে
পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ অনুভব করে হাঁটছি আমি।”
ওই রাতে ১১টা ৩৫ মিনিটে ডাক্তার জীবনানন্দকে মৃত ঘোষণা করলে সঞ্জয় ভট্টাচার্য লেখেন, “একটি জাহাজ ছেড়ে গেল…।”
আমাদের দেশের কথাসাহিত্যিক কায়েস আহমেদকে মনে আছে আপনাদের। তিনিও সুইসাইড করেছিলেন। এখন গুলিস্তানের গোলাপশাহের মাজার, সেখানে আড্ডা দিয়েছিলেন রাত ১০টা অব্দি কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে। মার্কসবাদ ও বিপ্লবের কথা বলেছিলেন। কিন্তু রাতে তার মধ্যে কী ভূত চেপেছিল কে বলবে আর। সুইসাইডই করলেন। মনোবিদ গুস্তভ ইয়্যুং বলেছেন, “লেখক-কবি-শিল্পীরা সাধারণত অন্য দশটা সাধারণ মানুষের চেয়ে হন বেশি সংবেদনশীল। তাই তাদের আত্মহত্যার কারণ এমনকি নিছক একটি পিয়ানোর সুরও হতে পারে। তারা থাকেন সবসময়ই তাড়িত পীড়িত। যেন বেহেশত থেকে বিতাড়িত অভিশপ্ত।”
না হলে ১৯৬১ সালের জুলাই মাসের এক সকালে নিজের প্রিয় দোনলা বন্দুকটা মাথায় ঠেকিয়ে সুইসাইড করেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে? অথচ ‘ওল্ড ম্যান এন্ড সি’ নামক কালজয়ী উপন্যাসে এই হেমিংওয়ে বৃদ্ধ সান্তিয়াগোকে দিয়ে বলিয়েছেন, “Man is not made for defeat… [a] man can be destroyed but not defeated”
আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে যৌনতা
কালজয়ী উপন্যাস ‘দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড সি’সহ অনেক মাস্টারপিসের এই রচয়িতা ১৯৫৪ সালে নোবেল পুরস্কার পান। পেয়েছেন পুলিৎজার প্রাইজও। সেই হেমিংওয়ে কি নিজেই হতাশার কাছে পরাজিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিলেন? তার বাবা ক্লারেন্স হেমিংওয়ে, ভাই লিস্টার হেমিংওয়ে আর বোন উরসালা হেমিংওয়েও আত্মহত্যা করেছেন। হেমিংওয়ে পরিবারের রক্তেই কি মিশে আছে এই আত্মহত্যার বাতিক? নাকি এটি সত্য যে নোবেল পুরস্কারের পর তার হাত দিয়ে নতুন লেখা বেরুচ্ছিল না। রাইটিং ব্লক? না হলে কেন বলবেন “রিপিটেশন রিপিটেশন, আর হবে না কিছুই।”
হেমিংওয়ের মতো নিজেকে গুলি করে মেরেছিলেন রুশ কবি মায়াকোভস্কিও। রাশিয়ান কবিতার তাকে বলা হয় ‘রেগিং বুল’। পুঁজিবাদী সমাজের শোষণ, মানুষে মানুষে অসাম্যের কথা বলেছেন এই কিংবদন্তি কবি তার লেখনীতে। তার কবিতা অনূদিত হয়েছে নানান ভাষায়। সমাদৃত নানান দেশে। এই কবির পুরো নাম ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ মায়াকোভস্কি। একদিন তার সঙ্গে পরিচয় হয় অভিনেত্রী ভেরোনিকা পোলানস্কায়ার। প্রথম দেখাতেই তিনি ভেরোনিকা পোলানস্কায়ার প্রেমে পড়েন। পোলানস্কায়াকে বলেছিলেন, “আমাকে কখনো ছেড়ে চলে যেও না। আমি ভীষণ ভয় পাই নীরবতা আর একাকীত্ব। ১৯৩০ সালের শুরুর দিকে স্ত্রী ইয়ানশিনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করেন মায়কোভস্কি। পোলানস্কায়াকে বিয়ে করার কথা বলেন মায়াকোভস্কি। কিন্তু পোলানস্কায়া রাজি না। তাদের মাঝে সম্পর্কের টানাপড়েন নতুন করে শুরু হয়। ১৯৩০ সালের ১৪ এপ্রিল মায়াকোভস্কির সঙ্গে পোলানস্কায়ার দেখা হয়। এরপর সকাল ১০টা ১৭ মিনিটে মায়াকোভস্কি রিভলবারের গুলিতে আত্মহত্যা করেন। মায়াকোভস্কির সাবেক স্ত্রী ইয়ানশিন মৃত্যু সংবাদ শুনে শুধু বলেছিলেন, “তার (পোলানস্কায়া) কারণে আমাদের ছাড়াছাড়ি হলো। অথচ সে জানত না মায়াকো ছিল শিশু ও দারুণ অভিমানী। আমি কত রাত জেগে তাকে সঙ্গ দিয়েছি। তার পাগলামিকে প্রশ্রয় দিয়েছি। উজাড় করা ভালোবাসা দিয়েছি। কিন্তু তবু পুরনো হয়ে গিয়েছিলাম।”
ঔপন্যাসিক হান্টার এস থম্পসন আমেরিকান । নিজের শেষ লেখাটির নাম দিয়েছিলেন ‘ফুটবল খেলার মৌসুম শেষ’। নোটটি তিনি লিখেছিলেন স্ত্রী অনিতাকে উদ্দেশ্য করে। থম্পসন লেখেন, “আর কোনো খেলা নেই। আর কোনো বোমা নেই। চলতে থাকা নেই। কোনো মজা নেই। সাঁতার কাটা নেই। ৬৭। ৫০-এর পরও ১৭টি বছর। আমার চাওয়ার অথবা দরকারের চেয়েও ১৭টি বাড়তি বছর। বিরক্তিকর। আমি সব সময়েই উদ্দাম। কারো জন্য কোনো আনন্দ নেই। ৬৭। তুমি লোভী হয়ে যাচ্ছো। বুড়োমি দেখাও। শান্ত হও—এটা ব্যথা দেবে না।” এই লেখার মাত্র চার দিনের মধ্যেই নিজের মাথায় গুলি করেন তিনি। অনেক দিন ধরে শারীরিক বিকলাঙ্গতায় ভুগছিলেন থম্পসন। মৃত্যুর সময় টেলিফোনে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আত্মহত্যা করেন তিনি।
এমনভাবে গুলি করে নিজেকে হত্যা না করলেও অনতিক্রম্য বিষণ্ণতার কারণে সুইসাইড করেছেন আরো অনেকে। কয়েকজনের কথা বলি। কারিন বোয়ে কবিতা লিখতেন। তার বেশির ভাগ কবিতা প্রতীকধর্মী। তিনি পড়াশোনা করেন উপশাল ও স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতা সংকলন। একটি সাহিত্য পত্রিকাও ছিল তার। কারিন বোয়ের কবিতায় স্থান পেত পরাবাস্তবতা। কবিতার বই প্রকাশ করার পর তা বিখ্যাত হয়ে যায়। এরপর একটি উপন্যাসও লেখেন কারিন বোয়ে। তিনি বিয়ে করেছিলেন, তবে সমকামী ছিলেন। ফলে তার বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। কারণ সমকামিতায় আকর্ষণ ছিল বেশি। পরবর্তীতে বান্ধবী মারগেট হ্যানেলের সঙ্গে সম্পর্ক হয় তার। জীবনের শেষ ১০ বছর তিনি মারগেট হ্যানেলের সঙ্গেই থাকেন। জানা যায়, মানসিক চাপের কারণেই তিনি আত্মহত্যা করেন। ১৯৪১ সালের এপ্রিলে একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মারগেট হ্যানেলের সঙ্গে নাস্তা করেন। কফি খান। এসময় তিনি একটি গান গেয়ে শোনান বান্ধবীকে। ফুলের বাগান থেকে গিয়ে কিছু ফুল এনে তুলে দেন বান্ধবীর হাতে। বলেন, “লাভ ইউ ফর এভার।” এরপর তিনি গাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। কিছুদিন পর তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।
এডগার অ্যালান পো ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক। অ্যালান পো ১৮০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি আমেরিকার বোস্টন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। কৈশোর থেকেই লেখালেখি শুরু করেন তিনি। অসাধারণ প্রতিভাবান এই লেখকের সারা জীবন কাটে অভাব, অনটন ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে। তিনি খামখেয়ালি জীবনযাপন করেছেন। মদ্যপান ও জুয়া ছিল তার নিত্যসঙ্গী। ১৮৮৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনিও কবি কারিন বোয়ের মতো বাড়ি থেকে বের হয়ে যান কাউকে কিছু না বলে। এর আগে একই ঘটনার ধারাবাহিকতা। গান শোনেন নাস্তার টেবিলে। ফুল দেন বাসার সবাইকে। পরবর্তী কয়েক দিন তার কোনো খোঁজ কেউ দিতে পারেননি। ঠিক ছয় দিন পর অক্টোবরের ৩ তারিখ বাল্টিমোরের রাস্তায় নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় অ্যালান পোর। কাছের মানুষজন এরপর তাকে বাল্টিমোর হাসপাতালে নিয়ে যান। এর চারদিন পর হাসপাতালে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় এই লেখককে। ডেথ সার্টিফিকেটে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে মানসিক বিষণ্নতা থেকে আত্মহত্যার কথা বলা হয়েছে।
পুলিৎজার জয়ী কবি জন ব্যারিম্যানের বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন। এরপর তার মা আবার বিয়ে করেন। বাবার এমন মৃত্যুতে মানসিকভাবে ভঙ্গুর ছিলেন ব্যারিম্যান। কখনো মেনে নিতে পারেননি বাবার এমন মৃত্যু। তিনি পড়াশোনা করেন কলম্বিয়া কলেজ ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষে ১৯৫৫ সালে তিনি অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেন মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সনেট কাব্য সংকলনের জন্য ১৯৬৪ সালে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পান। ৩৮৫টি কবিতা ছিল বইটিতে। প্রকাশের পর বইটি ওই সময়ের অন্যতম সেরা কাব্যগ্রন্থের স্বীকৃতি পায়। সেই সঙ্গে জন ব্যারিম্যানকে এনে দেয় বিশ্বজোড়া খ্যাতি। এত কিছু পেয়েও কেমন যেন আনমনা থাকতেন জন ব্যারিম্যান। তারপর একদিন বাবার পথেই হাঁটলেন। তিনি ১৯৭২ সালে ওয়াশিংটন এভিনিউ ব্রিজ থেকে প্রায় ৯০ ফুট নিচে মিসিসিপি নদীতে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। তার মতোই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন সাহিত্যিক হার্ট ক্রেন। হুট করেই গুডবাই এভরিবডি বলে মেক্সিকান উপসাগরে একটি নৌকা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। তখন হার্ট ক্রেনের বয়স মাত্র ৩২। আরেক বিখ্যাত সাহিত্যিক কোয়েসলার আত্মহত্যার আগে লিখেছিলেন দীর্ঘ চিঠি। হার্ট ক্রেন এমনটা করেননি; তার চিরকুটটা ছিল এমন—‘বন্ধুরা, কাজ তো শেষ তবে আর অপেক্ষা কেন?’ ক্রেন এখানে কাজ শেষ বলতে কী কাজের কথা বুঝিয়েছেন! যার পর পৃথিবীতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই করার মতো! সাহিত্যের আরেক দিকপাল পল ক্লি ঝাঁপ দিয়েছিলেন সিন নদীতে ৪৯ বছর বয়সে। কবি গিলিজ ডিলুয়েজকে বাধ্যতামূলক অক্সিজেন মেশিন ব্যবহার করতে হতো। একদিন তিনি মেশিনটি ফেলে দেন জানালার বাইরে। এরপর সুইসাউড করেন।
ভার্জিনিয়া উলফ বিখ্যাত ব্রিটিশ কবি। তার মৃত্যুও কাব্যিকভাবেই ঘটেছে। নিজের ওভারকোটের পকেটে নুড়ি পাথরবোঝাই করে হেঁটে নেমে গিয়েছিলেন খরস্রোতা পাথুরে নদীতে। আর কোনো দিন ফিরে আসেননি। তার উল্লেখযোগ্য রচনা হলো—মিসেস ডাল্লাওয়ে (১৯২৫), টু দ্য লাইটহাউস (১৯২৭), ওরলান্ডো (১৯২৮)। ভার্জিনিয়ার বিখ্যাত উক্তি—“নারী যখন ফিকশন লেখে তখন তার একটি কক্ষ আর কিছু অর্থ খুব প্রয়োজন।” ৫৯ বছরের জীবনে উলফ বেশ কয়েকবার মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার রোগের নাম ছিল ডিপোলার ডিজঅর্ডার। তিনি ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ আত্মহত্যা করেন। শেষ বিদায়ের আগে প্রিয়তম স্বামীর উদ্দেশ্যে এক চিঠি লিখে যান ভার্জিনিয়া। চিঠিটি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পড়া সুইসাইড নোটগুলোর একটি। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ওই চিঠিটি এখনো পড়েন বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমীরা, উলফের পাঠকরা। “আমি নিশ্চিতভাবে অনুভব করছি যে, আমি আবার পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি অনুভব করছি যে, ওরকম আরেকটি ভয়াবহ সময়ের ভিতর দিয়ে যেতে পারব না আমরা এবং আমি এবার সেরে উঠব না। আমি কণ্ঠ শুনতে আরম্ভ করেছি।” মানসিক অবসাদ একজনকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার প্রমাণ উলফ। অথচ তার সব ছিল। সুখী গৃহকোণ। বিত্তবৈভব। তবু কেন হইল মরিবার সাধ!
নোবেলজয়ী অ্যানি সেক্সটন বিশ্বখ্যাত কবি। অন্য কবিরা যে বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতেন অ্যানি সেক্সটন সে বিষয়গুলোই তুলে আনতেন কলমে। হস্তমৈথুন, রজঃস্রাব, গর্ভপাত ইত্যাদি বিষয়ও তার লেখায় চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। কিন্তু পুরো জীবনজুড়েই হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। মানসিক চাপ কমাতে তিনি মদ্যপানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তার কবিতা বিখ্যাত সব পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হয়। ১৯৬৭ সালে পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন। অতিরিক্ত মদ্যপান করতেন এই কবি। তবে তা কখনো তার সৃষ্টিশীলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তিনি বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিবারই বিফল হতে থাকেন। তার সর্বশেষ কবিতার পাণ্ডুলিপি একজন রিপোর্টারকে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এটা যেন প্রকাশিত না হয়। ১৯৭৪ সালের ৪ অক্টোবর তিনি গাড়ির মধ্যে কার্বন মনো-অক্সাইড গ্যাস ছেড়ে আত্মহত্যা করেন।