ননাই



হুমায়ূন সাধু
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

আজকে এত বছর পর হামিন যখন স্কুলের ভূগোল গাইড বইটা খোলে ভিতরে চিরকুটটা পায়।

তার গায়ের লোম খাড়ায় যায়। সে স্কুলের বেস্টফ্রেন্ড আসাদরে ডাকে। তারপর মসজিদের মধ্যে নামাজের পর আসাদরে আরো কাছে নিয়া আস্তে গোপনে শার্টের পকেট থেকে চিরকুটটা বের করে দেখায়।

“দুষ্টু,
স্কুল ছুটির পর থাকব পুকুরপাড়ের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। এসো।
–দুষ্টুর মম”

আসাদঃ মম?!
হামিন জোরে কল্লা নাড়ে।
আসাদঃ কারে দিসে?
হামিন উত্তেজনায় ভুইলাই গেসে ব্যাকগ্রাউন্ড কইতে।
হামিনঃ আমার ভূগোল বইয়ে।
আসাদ একবার চিরকুটটা একবার হামিনের দিকে তাকায়। ভালো করে।
“এখন?”
হামিন নিশ্চিত করে কয়, যাব।
পারলে তখনি ছুটে যায় হামিন।
আসাদঃ কেমনে দিল? কই পাইলি তারে?
হামিনঃ তারে পাই নাই তো...

অতি উত্তেজনায় আসলেই সব গুইলা খায়া ফেলসে হামিন। “আরে খাড়া খাড়া খাড়া” হামিন আসাদরে খাড়া করায় মনে করার ট্রাই করল।
হামিনঃ ক্লাস নাইনে মম একবার আমার কাছ থেকে বইটা নিসিল।
আসাদ মুনাজাত ধরে। মুনাজাত শেষ কইরা হামিনরেসহ নিয়া বাইর হয়।

দুইজনে মাঠের ডাব বেচতেসিলো, ডাব খাইতে খাইতে আসাদ এনশিউর করে, ক্লাস নাইনে?
এখন তারা কলেজে।
হামিনঃ হুম, ক্লাস নাইনে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় আমি ভূগোলে হায়েস্ট নাম্বার পাইসিলাম মনে আছে? তখন।

আসাদ মনে করতে পারলেও ঘটনার লগে কানেক্ট করতে পারে না।
আসাদঃ এতদিন আমার কাছে লুকায় রাখসিলি।
হামিনঃ না, আমি পাইলাম আজকে। বাসা থেকে পুরান সব বই খাতা বের করসে বেচবে, তখন। আমি নস্টালজিক হয়া না, কী বুঝে ঘাঁটতেসিলাম।
আসাদ কিছুক্ষণ ধরে তাকায় থাকল।
হামিনঃ আমি ঐ জায়গায় যাব।
আসাদ হাসল।
“এখন? এত বছর পর?!”
হামিনের মাথা আউলায় গেসে। এত বছর পর কোথায় কী? কোথায় মম?
হামিনঃ না। ঐ জায়গায় তো এখন নাই। মমরে খুঁইজা বাইর করতে হবে আগে।
আসাদঃ শুনসি ও চট্টগ্রামে থাকে।
হামিনঃ কই শুনলি?
আসাদঃ আমার সাথে একদিন দেখা টিএসসিতে।
হামিনঃ কই বলিসনি তো।
আসাদঃ আমি কি জানি নাকি তোর এই ব্যাপার।
হামিনঃ চট্টগ্রাম কোথায় জানিস?
আসাদঃ খুলশির দিকে। তাও তো অনেক বছর আগে। এরপর আর জানি না।
হামিনঃ একটা সূত্র তো পাওয়া গেল।
আসাদঃ যাবি? এখন কোথায় আছে। বিয়া টিয়া হয়া গেসে নাকি!
হামিনঃ বলিস কী?! ধুর ব্যাটা! ভালো স্টুডেন্ট ছিল। পড়া শেষ না কইরা এত তাড়াতাড়ি বিয়া করব না।
আসাদঃ কইলাম আর কি! এত বছর পর…

হামিন যাবে না বলেও ঐ জায়গায় যায়। ঐ স্কুলে যায়। স্কুলের পাশে একটা পুকুর ছিল। ওপারে কৃষচূড়া গাছটা। এখন পুকুর নাই। বিল্ডিং উঠতেসে। গাছটা আছে।

কী মনে করে নিচা হয়া মাটি, ঘাস হাত দিয়া ছুঁইয়া ছুঁইয়া যায়। গায়ে কারেন্টের মতো বিঁধে। তার অনেক কিছু মনে পড়ে।

হামিনও মুটামুটি ভালো ছাত্র ছিল। পড়ালেখার লাইগা মাইর খাইতে হয় নাই। একবার বিশৃঙ্খলার কারণে ম্যাডাম তারে পিটাইসিল। সেদিন সে খুব লজ্জা পাইসিল। হামিনের পেটভর্তি মানসন্মান। সেদিন ক্লাস শেষে বাসায় ফেরার পথে কোত্থেকে মম আসল বান্ধবীসহ। সান্ত্বনা দিতে। ঐটাই কি প্রথম কথা মমর সাথে? কোনো কথা খুঁইজা না পাইয়া বা ঐ কথা না তুইলা হামিনরে জিগাইসিল,
“কই যাবা? বাসায়?”
চড়া মানসন্মানওয়ালা হামিন সবার সামনে পানিশমেন্ট খাইয়া এম্নিতে বেইজ্জতির মধ্যে। মম আইসে সফট একটা মন নিয়া সেটারেই হামিন কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো লাইগা খোমায় বিরক্তির ভাব নিয়া তারে করসে অপমান।
“ধুর! কই যাব আবার? নাচতে।”
খুব খারাপ। সেইদিনের কথা ভাইবা আরেকবার খারাপ লাগে হামিনের। অনেকবার ভাবসিল, মাফ চাইয়া নিবে, পারে নাই। আহা! মমর সেই চোখ! আর কোনোদিন কি সুযোগ পাবে না হামিন?

মম ডাইকা কি কইতে চাইসিল?
মম প্রায়ই কাছাকাছি এসে কেমন করে জানি তাকাত। কেউ খেয়াল করত না। কিন্তু হামিনের কেমন জানি লাগত। মনে হইত কিছু কইতে চাইত? সে বুঝে নাই। এখন বুঝতেসে কিছু কইতে চাইত।
সায়েন্সের প্র্যাক্টিক্যালে ল্যাব-এ আলুর অভিস্রবণ প্র্যাক্টিক্যালের সময় মম বান্ধবীকে আমাকে দেখায় দিলে বান্ধবী আইসা আমারে কয়, আমার আলু লিক হয়া গেসে। একটু করে দিবেন?
ইজ্জতের প্রশ্ন আবার। হামিনের আলুও কাজ করতেসিল না। মাইয়ার আলুর সমস্যা না। হুদাই ডিস্টার্ব করতে আইসে।

হামিন আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় দিকে আসে। কী করবে?! ‘কই যাই কোথা যাই’ অবস্থা!
কী কথা? কী কথা?
ফেসবুকে খোঁজে। প্রভাতি স্কুলে বা স্টুডেন্টসদের খোঁজে। কয়েকটা বন্ধুর লগে ফোনে, ফেসবুকে নক করে। ইনাইয়ে বিনায়ে এই কথা সেই কথার ভিতরে ফাঁক দিয়া মমর কথা তোলে।
“আচ্ছা ঐ মাইয়াটার নাম জানি কী? ডিফিডিং করত?”
অপরপ্রান্তে সুজনঃ লাভলি ঘোষ?
লাভলি ঘোষটা আবার কে?
হামিনঃ তুই লাভলি ঘোষের পিছে ঘুরতি না? আরে ঐ ম...ম... কী জানি?
সুজনঃ অ আচ্ছা, মোর্শেদ…
হামিনঃ বেটা, ঐ যে ঐ মেয়ে, এ প্লাস... মম না কী জানি…
সুজনঃ মনে পড়সে মনে পড়সে…
হামিনঃ হ্যাঁ হ্যাঁ। কী খবর তার।
সুজনঃ আরে তার লগে দেখা হয় তো।

সুজন গেণ্ডারিয়ার একটা এড্রেস দেয়। এড্রেস নিয়া আবোল তাবোল কইয়া কোনোমতে রাখে হামিন। আরে, পাইয়া গেছেরে... আসাদরে জানাইতে হবে। না, এখন না।

চিরকুটটা নিয়া, নতুন একটা ট্রিশার্ট পইরা, ডিউ স্প্রে করে বডিতে।
ভাবে, তারে দেখলে কী করবে মম? সেই-ই বা কী করবে?
তার গা দিয়া একটা উথাল পাথাল ঢেউ খেইলা যায়। আচ্ছা, চেহারা তো একই থাকবে, না? আসাদের কোম্পানি নিতে পারলে ভালো হইত। কিন্তু সে দেশে নাই। শিপে উইঠা গেসে, এখন সমুদ্রের মাঝখানে।

বিকালবেলা ফুরফুরা বাতাসের মইদ্ধে হামিন রিক্সা নিয়া রওনা দেয় গেণ্ডারিয়ার দিকে। আবহাওয়াটাও সেই। তার অনূকুলে। রোমান্টিক।

জায়গামত গিয়া যারে পায় সে মম না। সুমনা। মমরে চিনতে পারসে। কিন্তু তার ব্যাপারে কিচ্ছু জানে না। এটা কোন এম্ব্যারাসিং-এ ফালাইলো সুইজইন্নার বাচ্চা।

যাবার সময় শাহবাগ থাইকা ফুল নিবে ভাবসিল। বাঁইচ্চা গেসে।

পকেটে হাত দিয়া চিঠিটার অস্তিত্ব ফিল করে। তারপর আইসা সোহরাওয়ার্দীর এখানে চা খায়। মাঠে, ঘাসে শুইয়া থাকে। আকাশে মমর পাশাপাশি সুজইন্নার চেহারাও ভাসে। শালা মজা নিলোনি!

কানে হেডফোন দিয়া না হওয়া প্রেমে ছ্যাঁকা খাইয়া ছ্যাঁকা খাওয়া গান শোনে হামিন।
“মাইয়ারে মাইয়ারে তুই অপরাধীরে, আমার যত্নে গড়া ভালোবাসা দে ফিরায়া দে…”
গানটা খুব হিট যাইতেসে।
ভুরভুরায় কান্না পায় তার। কই কান্দা তো আসে না, পানি বের হয় না।

একবার হামিনের জন্মদিনে মম একটা প্যাকেট নিয়া পিছে পিছে ঘুরসে। নাইনের শেষের দিকে নাকি নিউ টেনের শুরুর দিকে। হামিন খুব বিরক্ত হইসিল। বন্ধু আসাদ আর হামিন পণ করসিল তারা প্রেম করবে না। প্রেম খুব খারাপ। কোনো মাইয়ারেই পাত্তা দেয়া যাইবে না। কিন্তু মন চাইত। হামিন মনে মনে মমরে চাইত। স্বপ্নে দেখত মম তারে লাভ লেটার দিবে। লিট্যারেলি স্বপ্ন দেখত ডাব গাছের নিচে সে আর মম শুইয়া আছে। ডাব রোমান্টিক কিনা বা কেন ডাব গাছ হামিন জানে না। হয়তো স্কুলের চারপাশে ডাব গাছ। এই পরিবেশের বাইরে তো মমরে দেখে নাই।

এসব স্বপ্নে সে নিজেই এত শরমিন্দা হইত যে, একমাত্র ক্লোজ ফ্রেন্ড আসাদরেও কইত না। প্রেমে ফান্দে পড়া যাবে না। তাতে পড়ালেখার ক্ষতি হবে। স্কুলে খুব গ্র্যাভিটি নিয়া চলত তারা দুইজন।

ততদিনে মমর একটা ল্যাঞ্জা হইসে। সানা নামে এক পোলা তার পিছে পিছে ঘোরে। বইন পাতাইসে। মম তারে ছোটভাই বানাইসে। মমর ছোটখাটো, বড়খাটো সব কাম এই সানা কইরা দেয়। সেই সানা কইত্থে ঠিকানা নিয়া হামিনের বাসায় আইসা হাজির। মমর লগে এক্সট্রা খাতির দেখে হামিন তারে দেখতে পারত না, এখন আবার বাসায় হাজির। এক সারপ্রাইজ নিয়া আইসে। আমারে ঐ প্যাকেটটা দিসে। তারে বাইরে দাঁড় করায় কইল, খাড়া। ভিতরে গিয়া প্যাকেট খুইলা দেখে গানের সিডি। প্লেয়ারে চালাইল। একটা গান শুনল, টাইনা টাইনা কয়েকটা শুনল। খাস্রা খাস্রা লুতুপুতু রোমান্টিক গান। হামিন আবার বাইরে আইসা সিডি দেখায় কইল, কিরে! এইটা কী?
সানা একগাল হাসি দিয়া কইল, একজন দিতে কইসে।
হামিনঃ খেতা পুরি তোর গানের…
কইয়া আছাড় দিয়া ভাংতে নিসে। সানা ‘হা’ ‘হা’ কইরা উঠল,
“হামিন, এটা মম দিসে। তোর জন্য বাছাই কইরা কইরা গান রেকর্ড করসে। আমারে বলসে...”
হামিনঃ এইত্তোর গুষ্টি কিলাই। তোর কী? তুই এটা নিয়া বাসায় আইছিস কেন?
সানাঃ দেখ, এত দেমাগ।
হামিনঃ তাই? কইস তারে
সানা মজা পায় মনে হয়। হাসতে হাসতে বোঝানোর ট্রাই করে, দেখ এত গরমের কী আছে বুঝতেসি না।
হামিনঃ তুই আর কোনো কিছু নিয়া আসবি না। আর বাসায়ও আসবি না।
সানা হাসে। সে এরকম। অপমান নিয়াও হাসে। তারপর চলে যায়।
হাসতে হাসতেই হয়তো সে মমরে বলসে। বাট এটাও বেশি বেশি হয়া গেসে হামিনের। এর পানিশমেন্ট সে পাবে, মাফ নাই।
তার আগে মমরে খুঁইজা বাইর করতে হবে।

আচ্ছা, সানারে পাইলে তো একটা গতি হবে। এসএসসি কোচিং একসাথে একবেঞ্চিতে বইসা পড়সে। এসএসসি এক্সামে একসাথে আসা যাওয়া করসে, পারলে মমর লগে মাইয়াগো কম্পার্টমেন্টে বসে। ফেল করসিল যদিও মমর সেই পাতাইন্না ছোট ভাই।
সানারে পাইলে নিশ্চিত কাজ হবে।
এবার খোঁজ দ্য সার্চঃ সানা।
কোনো হদিসই নাই। লাইগা থাকলে কী না হয় সানার খোঁজ পাওয়া গেল। শালার পুত, কী কামে জানি জেলে। এক অমোঘ টানে সেখানেই গেল হামিন। যথারীতি হাসতেছে খবিসে। ঘেন্নায় হামিনের গা গুলায় আসে।
ডিরেক্ট তো মমর আলাপে যাওন না। তারে কেউ দেখতে আইসে, সে এক্সাইটেড। তারপর হামিনরে কয়, একটা কাম করে দিতে পারবি?
হামিনঃ আমি কোনো কাজ কাম করতে পারুম না।
সানাঃ আরে বেটা, পারলে পারবি করলে করবি। তুই যেহেতু জেল পর্যন্ত আইছস, এটাও করবি। মমরে তারে একটা জিনিস দিতে হইব।
হামিন ঝাঁকি দিয়া ওঠে।
“মম কই?”
সানাঃ তুই জানিস না?
হামিনঃ না। তুই জানিস?
সানাঃ না। আমিতো জেলে। দেখ না একটু...
“কম্মকাবার!” জীবনে জেলে আসে নাই। কার লগে দেখা করতে আইলো।
হামিনঃ আমার লগে কোনো যোগাযোগই নাই। লাস্ট কাছাকাছি দেখা ঐ এসএসসির কোচিং-এ।

ক্লাস টেনে টেস্ট পরীক্ষার পর হঠাৎ আর দেখা হইব না ভাইবা হামিনের স্কুলের লাইগা, ফ্রেন্ডদের লাইগা এবং স্পেশালি মমর লাইগা বুক হু হু করে উঠসিল। মম এসএসসির যেখানে কোচিং করে এক ছুতায় গেসিল হামিন। মমর সাথে যদি দেখা হয়া যায়। মম যদি ডাইকা কিছু কয়। বা সে যদি কইতে পারে। গেসিল। কিছু হয় নাই। নিজেদের স্কুলের, অন্য স্কুলের পোলাপানরা ছিল। হাসাহাসি করতেসিল।

হামিনের সুইডেন যাবার ব্যাপারে চেষ্টা চরিত্র চলতাসে। মম চ্যাপটার ক্লোজ।
এভাবে বছর চইলা গেল। ঈদে আসাদ দেশে ছিল। দেখা হয়। তারা দুইজন ঘুরাঘুরি করে। আসাদের ভাইয়ের বিয়া। বিয়ার সূত্রে আর হামিনের বিদেশ যাত্রার সূত্রে দুইজনে পুরান বন্ধুদের লগে দেখা করে। কিন্তু মমর কথা তোলে না। কেউ কয় না। হামিনও না। জম্পেশ আড্ডার পর সবাই চইলা যায়।

সুইডেন যাবার আগে শেষ মুহূর্তের ছুটাছুটি, চরম রাশ যায় হামিনের। আগের দিন কাগজপত্র গোছাইতেসিল। একটা কল আসে। হামিনের খুশিতে মুখ হাইসা ওঠে। প্রভাতি স্কুলের পুনর্মিলনী।
হামিন কোনো কিছু চিন্তা না করে জিগায়, মম আসবে?

[লেখকের বানানরীতি অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে]

আরো পড়ুন ➥ মহুয়া ║ হুমায়ূন সাধু

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;