প্রিয়, পুষ্পক্রীড়া নয়, ধান কাটিবার দিন অদ্য
বিলাতে আমার মাস্টার্সে ESOL (English for Speakers of Other Languages) শীর্ষক একটা মডিউল ছিল। কোর্সটির একাংশ নিয়েছিলেন মিস হেলেন (ট্রয়ের নয়)। তো, ভাষা শিক্ষাদানের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করার একপর্যায়ে Communicative Language Teaching (CLT) সম্পর্কে শ্বেতদ্বীপবাসিনী একটা উমদা কথা বলেছিলেন, ‘CLT is the sexiest language teaching method in the contemporary pedagogic landscape.’ বাংলার অক্ষাংশে, দ্রাঘিমাংশে যেভাবে ধানকাটার ধুম পড়েছে, সুন্দরীশ্রেষ্ঠার ইংরেজ প্রতিপক্ষের অনুকরণে বলতে বড্ড সাধ জাগে— Paddy cutting is the sexiest trend in the Covid-19 Bangladesh.
২.
আহা, কচি নেবু পাতার মতো নরম, নেশা জাগানিয়া সোনালী আলোয় ভরে গিয়েছে আমাদের নিখিল জগৎ সংসার এই ফাগুনের আগুনে করোনা বেলায়! সোনালী ধানের, পোয়াতি ক্ষেতের উর্বর, বহুপ্রজ প্রণয় নেশার মৌতাত এনেছে ‘কাটার মাস্টারদা’দের মনে। ধানের ক্ষেতে সোনালী আলো রূপালী বৃষ্টির মতো ঝরছে। তাইতো মদির, মাতাল তারা—পদ্মভূকের মতো ধানের ঘ্রাণে আচ্ছন্ন। ‘বন থেকে এলো এক টিয়ে মনোহর, সোনার টোপর শোভে মাথার উপর।’ আজ আমাদের এই নর-টিয়ে মনোহরদের হাতে শোভিছে লৌহ-টোপর—এক ফালি ধাতুজ চাঁদ, কাস্তে। আহা! সোনার হাতে সোনার কাস্তে-কাকন, কে কার অলংকার!
৩.
তারা হাঁটছে, দলে দলে, সপারিষদ। তারা উত্তরে যায়, দক্ষিণে যায়, যায় ঈশানে, নৈঋতে। ধান কাটতে হবে। কাঁচা কী পাকা বড় কথা নয়, ধান্য কর্তনে অংশগ্রহণই বড় কথা। ধান আদপে আকর্ষণীয়া অনূঢ়া যৈবতীর লাহান। একে ‘শুভস্য শীঘ্রম’ নীতি অনুসরণ করে কৃষকের ঘরে তোলার এন্তেজাম করতে হবে। নাহলে কিন্তু সাড়ে সব্বোনাশ— Mango আর sack দুটোই যাবে!
৪.
আমাদের আকাশে এখন সোনার ডিমের মতো ফাগুনের চাঁদ নেই। চন্দ্রভূক অমাবস্যা লেফাফাবন্দী করেছে এই বদ্বীপকে। নগর-বন্দর-গাঁ উদরে পুরেছে আলকাৎরার মতো রাত্রি। কাজেই ‘শস্যের চেয়ে আগাছা বেশি, কাস্তের চেয়ে কর্তক বেশি’ জাতীয় সমালোচনা-শর বুমেরাং করে দিয়ে সোনালী ধান ক্ষেতে ক্রুসোর মতন হেঁটে হেঁটে তারা পেয়ে গেছে কী বিপুল, উন্মুক্ত, অনাক্রমণীয় আলোকচিত্রভূমি! শহীদ কাদরীকে অপ্রাসঙ্গিক বানিয়ে তাই নেতা বলেছেন—
ভয় নেই আমি এমন ব্যবস্থা করব
বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে
কাস্তে-হস্ত আলোকচিত্র ভাঙ্গালে
বেহুদা গোলাপ কিম্বা চন্দ্রমল্লিকা নয়,
লক্ষ কোটি টাকার স্বীকৃতি পাওয়া যাবে।
এই স্বীকৃতি আর মার্জারের বরাতে শিকে ছিঁড়লে হবু ‘নবীনসেনের’ (পড়ুন, ‘নমিনেশন’) টানেই তো ‘ধানকাটা’ শব্দবন্ধ তাদের কানে আর প্রাণে গানের মতো, তাদের মর্মের মাঝে মর্মরি বাজে—
কঙ্কা! কঙ্কা! ও কঙ্কাবতী
চলো মোরা ধানকাটি, ধাঙ্কাটি!
তাইতো যুবক এখন হৃদকম্পী, ভৈরব নিনাদে উচ্চারণ করছে, ‘এখন যৌবন যার, ধান কাটা মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ নেতা বারংবার কর্মীকূলকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন, ‘আমাদের ক্যালেন্ডারে এখন বৃষ্টি বার, রোদবার, কিংবা বৃক্ষবার নেই, শুধুই আছে ধানকাটাবার।’ চলুন, মে দিবসকে সামনে রেখে রাঙা প্রভাত আনতে তেনাদের আর নেতাদের সাথে সঙ্গত করি—
প্রিয় ফুল খেলিবার দিন নয় অদ্য,
করোনার মুখোমুখি আমরা
নয়নে আজ স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
পিঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া
চলো মিলি সবে কাটি ধান আমরা।
আরো পড়ুন মনুষ্যত্বের দাফন-কাফন ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নৃতত্ত্ব