‘ওয়াণ্টি ওয়ান’, ‘সাড়ে ফার্স্ট’ এবং শিশু শিক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক বহুমাত্রিকতার জটলা!



ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ড. মো: ফখরুল ইসলাম, ছবি: বার্তা২৪.কম

ড. মো: ফখরুল ইসলাম, ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

গত দু’দিন ধরে ফেসবুক খুললেই শুধু চোখ পড়ছিল প্রাথমিকে কৃতি শিক্ষার্থীদের হাসিমাখা ছবি। বাবা-মা আপনজনদের আঁকুতি- দোয়া করবেন আমার সোনামণিটার জন্য। হ্যাঁ, ওদের জন্য প্রাণখুলে দোয়া তো করবই। কিন্তু পাশাপাশি শঙ্কা জাগে, ওরা এত এত নম্বর পাচ্ছে, এত ভালো ফলাফল করছে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এসে তারা তাদের পাঠ্য বইয়ের সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হচ্ছে কেন? বিষয়টি দিন দিন জাতিকে ভাবিয়ে তুলছে।

বাচ্চারা স্কুলে কিছু শিখুক বা না শিখুক অভিাবকগণ একটি গোল্ডেন জিপিএ চান। এজন্য বাচ্চাদের ওপর চলে নানমুখী চাপ, গৃহশিক্ষকের শাসন ও ট্রাফিকজ্যামের মধ্যে নাওয়া-খাওয়া ভুলে কোচিংবাড়ি যাওয়া-আসার নির্যাতন। একজন মন্ত্রী কিছুদিন আগে শিশুদের জিপিএ ফাইভ বিষয়টিকে ‘নির্যাতনের’সংগে তুলনা করতে কুন্ঠিত হননি! শহুরে অনেক অভিভাবক একটি গোল্ডেন জিপিএ বিষয়টিকে দেখিয়ে সন্তানকে ভাল দামী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারেন অথবা বিদেশে পাঠিয়ে দিতে পারেন। পত্রিকায় প্রকাশ- কোনো কোনো বিত্তশালী অভিভাবক সেসব নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাসুযোগ নেয়ার পাশাপাশি তাদের সন্তানদের চাকুরী কিনে দেয়ারও ক্ষমতা রাখেন!

এছাড়া- নকল, ভেজাল, অনৈতিকতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে কথা বলাকে আজকাল আনস্মার্ট-বোকা বলে মনে করা হয়! কারণ, আজকাল শতাধিক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও সেগুলোতে মানবিক, সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার প্রসার বন্ধ হবার উপক্রম হয়ে গেছে। সেগুলোর সিংহভাগই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ব্যবসায়িক এবং ধার করা পার্টটাইম পঠন-পাঠন ব্যবস্থাপনার থাকায় তাদেরকে বাজারে টিকে থাকার ভাবনায় পেয়ে বসেছে। অনেকে মন খারাপ করতে পারেন, কিন্তু একমত হবেন যে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে আকৃষ্ট করা হলেও সেসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই আজ সনদ বিকি-কিনির বাজার। এসব ঘটতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা জাতি হিসেবে মেধাহীন হয়ে আস্তাকুঁড়ে আস্তানা বেছে নেব আর কি!

যাহোক, কিছুদিন আগে সাড়ে পাঁচ বছরের মেয়েকে সংখ্যা গণনা পড়ানোর সময় সে বলেছিল, আব্বু ইংরেজীতে ২১ যদি টুয়েণ্টি ওয়ান হয় এবং ধারাবাহিকভাবে ৩১, ৪১, ..., ..., ৯১ পর্যন্ত যদি একটা ধারা বজায় থাকে তাহলে ইলেভেন (১১) কেন ওয়াণ্টি ওয়ান হয় না? বাংলায় এক দশ এক এগার হয়, তাহলে একদশ দুই বেগারো হয় না কেন? আবার ২১, ৩১, ৪১ একই ধারায় উচ্চারিত হলেও ১১ কে ইলেভেন বলা হয় কেন? বিষয়টি আপাতঃ দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে আমি উত্তর দিলাম- পড়ার নিয়মটা এভাবেই চলে আসছে। এত বেশি ব্যাখ্যা চেও না, ভালভাবে পড়াশোনা কর, পরীক্ষায় ফার্ষ্ট হতে হবে। সে বলল ফার্ষ্ট হলে আমাকে কী উপহার দিবে? আর যদি সাড়ে ফার্ষ্ট হই তাহলে কি তার চেয়ে বেশি কিছু দিবে?

আমি তো শুনে হতবাক। এতটুকু মেয়ে, কেবল বাংলা বলা শিখেছে, তার কথার ধরন এবং গভীরতা দেখলে ভিমড়ি খাবার মত অবস্থা আর কি! কিন্তু একটি বিষয় সত্যি যে, বাংলাদেশে ওয়াণ্টি ওয়ানের ধারাবাহিকতা না থাকার মত শিশুদের শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই একটা বহুমাত্রিক ব্যবস্থার ধারা বিদ্যমান। শিক্ষা ব্যবস্থায় সাধারণতঃ মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শুরু হয়ে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বহুমাত্রিকতা রয়েছে কিন্তু পৃথিবীর কোথাও শিশুদের শিক্ষা জীবনের শুরুতেই বাংলাদেশের শিক্ষা ধারার মত বৈচিত্র্য, বৈষম্য, বিভেদ, সমন্বয়হীনতা ও অসামঞ্জস্য চোখে পড়ে না। বিশেষতঃ শহুরে শিশুদের মধ্যে এই বিভেদ বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

আজকের লেখাটিতে শিশু মস্তিষ্কের অসাধারণ ক্ষমতা, শিশুদের শিক্ষা জীবনের শুরুতেই প্রতিষ্ঠানগত নানা বিভেদ ও পার্থক্য নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।

আজকাল সব বাবা-মা'কে বলতে শুনি, আজকালকার বাচ্চারা খুবই পাকা পাকা কথা বলে। বাচ্চাদের মস্তিষ্ক বিশেষ করে যাদের পাঁচ বছর বয়স পূর্ণ হয়েছে তাদের মগজ খুবই শাণিত। আর কেনই বা হবে না? আজকাল বাচ্চারা জন্মের পর হতেই পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা থেকে যা কিছু দেখছে, ব্যবহার করছে এবং শুনতে অভ্যস্ত হচ্ছে সেগুলো তাদের মগজকে নিয়তই শাণিত করছে। বাচ্চাদের অবসর বলতে কিছু নেই। শুধু ঘুমের সময়টা বাদে তারা কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। টিভিতে কার্টুন অথবা ছবি অথবা অন্য কোন অনুষ্ঠান, কম্পিউটারে গেম, ছবি আঁকা, স্কুলের পড়া তৈরি, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খেলা করা আর খাওয়া-দাওয়া নিয়ে যে কোনো বাচ্চা সারাটা দিন ব্যস্ত সময় কাটায়। এমনকি স্কুল ছুটির পর দুপুরে খাবার খাইয়ে দিয়ে ঘুম-পাড়ানো খুবই অসম্ভব ব্যাপার। বাচ্চারা যেন দিনে ঘুমুতেই চায় না। কেউ কেউ সারাদিন ভিডিও গেম খেলে। কেউ কার্টুন দেখে এমনকি রাতে বড়দের সাথে নাটকসহ সকল টিভি অনুষ্ঠান দেখতে পছন্দ করে। খুব অল্পবয়সী বাচ্চাদের মধ্যে নাটকের পাত্র-পাত্রীদের নাম, ডায়লগ মুখস্থ রাখতে দেখা যায়। টিভি অনুষ্ঠান দেখতে অভ্যস্ত এক বাচ্চা তার মাকে বলেছিল, মা টিভিতে শুধু বাংলা ও ইংরেজী খবর হয় কিন্তু অংক খবর কেন হয় না ?


এক গবেষণায় দেখা যায়, একজন বয়স্ক মানুষ তার মস্তিষ্কের ক্ষমতার ১৫ ভাগও ব্যবহার করতে সচেষ্ট হয় না। এর চেয়ে বেশি ব্যবহারকারীরা নাকি নিউটন হয়ে যাবেন! তবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটা ব্যতিক্রম। একটি সুস্থ সবল বাচ্চা যেভাবেই হোক তার জানা ক্ষমতার সবটুকু ব্যবহার করতে তৎপর থাকে। যদি তা না করে তাহলে বুঝতে হবে সে বাচ্চা স্বাভাবিক নয়। কিছু কিছু বাচ্চার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন, অনেক সুস্থ বাচ্চা স্বভাবতইঃ চুপচাপ ও লাজুক ধরণের। তবে আজকাল এদের সংখ্যা খুবই কম।

শৈশবকালে বাচ্চাদের কৌতুহল প্রবণতা খুব বেষি থাকে। কৌতুহল থেকে নতুনকে জানা ও বোঝার পথ উন্মোচিত হয়। তাই বাচ্চাদের স্বভাবজাত কৌতুহলকে খুবই সতর্কতার সাথে সহজ, সরল, সঠিক এবং প্রাঞ্জল ভাষায় নিবৃত্ত করতে হবে। কোনো ধরনের ছল-চাতুরী, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তাদেরকে দমিয়ে রাখা যাবে না। তাহলে তাদের স্বভাবজাত কৌতুহলের মধ্যে ছেদ পড়বে এবং যদি তারা কোন কৌতুহলের প্রেক্ষিতে জবাবটা বাবা-মায়ের কাছে একরকম, শিক্ষকদের কাছে একরকম এবং বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আরেকরকম ভাবে জানতে পারে তাহলে তাদের কৌতুহলের সঠিক জবাব কোনটি এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকবে সঠিক উত্তর খুঁজতে একসময় হতাশ হয়ে পড়বে এবং অপরকে ঘৃণা করা শুরু করবে। অধিকন্তু তার ভিতরেও মিথ্যা, ছলনা, ক্ষোভ ইত্যাদির সৃষ্টি হবে এবং স্বাভাবিক সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলবে। মনে রাখতে হবে যে, শিশু মস্তিষ্ক একটি প্রায় ফাঁকা হার্ড ডিস্ক। এই হার্ড ডিস্কে সহজেই নতুন কিছু রেকর্ড হয়ে যেতে পারে। তাই ভাইরাস সদৃশ্য মিথ্যা, চাতুরী, অসততা ইত্যাদি শিশুকালেই যাতে তাদের মাথায় ঢুকে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

তাই শিশুদের মধ্যে সৃজনশীলতাবোধকে জাগ্রতকরণ ও তার লালনের জন্য কৌতুহলকে ইতিবাচকভাবে অথবা নেতিবাচকভাবে যা সত্য তাই তুল ধরতে হবে। তবে জিপিএ ফাইভ পেতে গিয়ে পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য যদি বাজারের গাইড বা নোটবই কিনে মুখস্থ করা হয় সেটা আত্মঘাতী হবে। আজকাল এটাই ঘটে চলেছে। সেজন্য স্কুল-কলেজের সনদে ডাবল জিপিএ ফাইভ পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হতে দেখা যাচ্ছে।

যা বলছিলাম, আজকাল শিশুদের মধ্যে অধিক কৌতুহল প্রবণতা ও অধিক জিজ্ঞাসু মনোভাব লক্ষণীয়। শিশুদের এই জিজ্ঞাসু মনোভাবকে সযতেœ লালন করতে হবে। তাদের মননশীলতার এদিকটিকে ইতিবাচক হিসেবে ধরে নিয়ে তাদের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন ব্যবহার প্রদর্শন করতে হবে।

আরেকটি বিষয়, আজকাল আমাদের দেশে শিশুতে শিশুতে পার্থক্য ও বৈষম্য খুবই পীড়াদায়ক। ঘনিষ্ট বন্ধু দুই শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায় স্কুলের পার্থক্য, পোষাকের পার্থক্য, খাদ্যের পার্থক্য। এই পার্থক্য কমিয়ে আনার জন্য শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রগুলোকে সার্বজনীন করতে হবে। বিশেষতঃ শহরাঞ্চলের শিশুরা কেউ কিন্ডারগার্টেনে যায়, কেউ ইংরেজী মাধ্যম শিখে, কেউ কমদামী স্কুলে যায়। এক্ষেত্রে অতি শৈশবকাল থেকেই আমরা জাতিকে বিভক্ত করে তুলছি। কিছু শিশু ইংরেজী শিখে স্মার্ট হচ্ছে কিছু শিশু সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে তাদের সমমানে যেতে পারছে না। উন্নত বিশ্বে এই বৈষম্য নেই বললেই চলে। যেমন, জাপানে ধনী-গরীব, উচ্চ-নীচু সবার বাচ্চারাই একই স্কুলে যায়, কমপক্ষে শুরু থেকে ৮ গ্রেড পর্যন্ত সব পিতামাতাই তাদের সন্তানদের একই ধরনের পরিবেশে লালন-পালন করাতে পারেন। সেক্ষেত্রে বাবা-মায়ের আয়ের পরিমাণ অনুযায়ী স্কুলের খরচ নির্ধারণ করে দেয়া থাকে। মূলতঃ সরকারি তত্ত্বাবধানে সেসকল স্কুল পরিচালনা করা হয়। শিশুদের খাবার, পোষাক, চিকিৎসা এবং অবস্থানকালীণ সময়ের নিয়ম-কানুন চাকুরীজীবি বাবা-মাকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে একটি নিশ্চিন্ত সেবাদান করার সুযোগ এনে দেয়। কর্মজীবি বাবা-মায়েরা সকাল থেকে রাতের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেসকল ‘ডে-কেয়ার কাম-স্কুলে’ বাচ্চাদের রেখে নিশ্চিন্তে নিজেদের পেশাগত কাজ চালিয়ে থাকেন।

বাংলাদেশে (২০১০ এর শিক্ষানীতিতে উল্লেখ আছে) এখন সময় এসেছে বৈষম্যহীনভাবে ১ম-৮ম শ্রেণির বাচ্চাদের জন্য সার্বজনীন শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা দেয়ার। গ্রামাঞ্চলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের ক্ষেত্রে বৈষম্য আপাতঃ দৃষ্টিতে নেই। কারণ গ্রামে সরকারি ও কিছু রেজিষ্টার্ড বিদ্যালয় এবং মক্তব, মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া ছাড়া শিশুদের শিক্ষার অন্য কোন গত্যন্তর নেই। কিন্তু থানা, জেলাশহর এবং রাজধানীতে শিশু শিক্ষার বৈষম্য আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের দুর্বলতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। শহরাঞ্চলে বাহারি নামের কিন্ডারগার্টেন, প্রি-ক্যাডেট, ক্যাডেট মাদ্রাসা, চাইল্ড কেয়ারহোম গুলোতে বিদেশি ভাষা মাধ্যমে শিক্ষা, অভিনব পাঠ্যসূচি, বোঝা বোঝা বই-পুস্তক এবং বাচ্চাদের মাসিক খরচের পর্বত প্রমাণ হিসেব প্রভৃতি শৈশবকাল থেকেই বাচ্চাদের মধ্যে বিভেদ এবং পড়াশুনা নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে এবং অনেকক্ষেত্রে বাচ্চাদের প্রাকৃতিক ও সুপ্ত সৃজনশীলতাকে বিলীন করে দিচ্ছে।

কোমলমতি বাচ্চারা তাদের দেহের ওজনের চেয়ে বেশি ওজনের বই খাতা পিঠে নিয়ে কুঁজো হয়ে বহন করে । এর সাথে দৈহিক ও মানসিক উভয় যন্ত্রনা বিজড়িত হয়ে যায় । এ ছাড়া বিশাল সিলেবাসের ঝক্কি সামলাতে বাড়ীতে উচ্চ বেতনে হাউস টিউটর এবং কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভরশীলতার প্রবণতা জড়িত এবং শহরাঞ্চলের স্কুলগুলোতে কর্মরত অধিকাংশ শিক্ষকগণ ক্লাশরুমে পড়ানো ফাঁকি দিয়ে উচ্চতর মাসিক বেতনে বাসা-বাড়িতে গিয়ে পড়ানো, নিজ বাসভবনে স্কুল খুলে ব্যবসা চালিয়ে সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে এই বৈষম্যকে আরো প্রকট করে তুলছেন।

পাশাপাশি সীমিত আয়ের অভিভাবকদের মধ্যে হীন প্রতিযোগিতা, হতাশা এবং শিশুদের শিক্ষাক্ষেত্রে সামাজিক এই বিষয়টিতে সামঞ্জস্য বিধান করতে না পারায় ঘুষ- দুর্নীতিতে লিপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে। খোদ রাজধানীতে বাচ্চাদের কোনো কোনো স্কুলে ভর্ত্তি ফি’র পরিমাণ এত বেশি, যা দিয়ে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় পাবলিক স্কুল- থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বাংলাদেশে একজন ছাত্রের ১ম শ্রেণী থেকে মাস্টার্স পাশ করা পর্যন্ত সমূদয় খরচ মেটানো সম্ভব (যেখানে পাবলিক স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসিক বেতন মাত্র ২০ বা ৩০ টাকা, সেখানে রাজধানীর একটি নামকরা স্কুলে ২য় শ্রেণীতে ভর্ত্তি হতে খরচ হয় ডোনেশনসহ ৮০ হাজার থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা)।

ক’দিন পরেই নতুন বছর শুরু হবে। তাই গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় না হোক, কমপক্ষে শিশুজীবনের জন্য একটি ইতিবাচক পর্যায় গড়ে তুলতে হলে শহরে প্রাথমিক শিক্ষার বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি, গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী শিক্ষকরা যাতে শিক্ষকতা করতে আকৃষ্ট হয় সেজন্য বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাড়াতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণে এই পদক্ষেপ প্রভূত বিপ্লব বয়ে আনতে পারে। তাহলে শিশুতে-শিশুতে বৈষম্য ও বঞ্চনা কম হবে এবং শিশুদের সৃজনশীলতাকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। একটি ইতিবাচক সৃজনশীলতার জন্য প্রয়োজন ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তন। আর এই ধরনের সামাজিক পরিবর্তন আনতে হলে শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত সংস্কার ঘটানো জরুরি। এই সংস্কার সূচিত হলে কেউ আর ‘গোল্ডেন জিপিএ’-র মত আজব তথা বৈষম্যমূলক প্রতিযোগিতায় সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে আগ্রহী হবে না। বরং একজন শিশুর ‘ওয়াণ্টি ওয়ান’ বা ‘অংক খবর’সৃষ্টির ইচ্ছার মত লক্ষ লক্ষ শিশুর বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুহলগুলোকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যাবে এবং শুধুমাত্র একজন শিশু ‘সাড়ে ফার্ষ্ট’হয়ে সুযোগ লাভ করবে- তা না হয়ে সমাজের আপামর শিশু ‘সাড়ে ফার্ষ্ট’স্থান লাভ করার মনো:দৈহিক ও নৈতিক শক্তি অর্জন করে ভবিষ্যতে দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত করতে পারবে।

ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

   

গ্রামীণ বাংলাদেশে সামাজিক নেতৃত্বের বিবর্তন



ড. মতিউর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গ্রামীণ বাংলাদেশ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং সম্প্রদায়ের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। শতাব্দী ধরে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সাংস্কৃতিক রীতিনীতি এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামো এই অঞ্চলগুলিতে নেতৃত্বের ধারণাকে গড়ে তুলেছে।

তবে গত কয়েক দশকে দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ বাংলাদেশে নেতৃত্বের ধারণাও বিবর্তিত হয়েছে।

ঔপনিবেশিক শাসন এবং নেতৃত্বের বিবর্তন
ঐতিহ্যগতভাবে গ্রামীণ নেতৃত্ব ছিল জমিদার, ধর্মীয়প্রধান, গ্রামপ্রধান এবং শিল্পীদের মতো সম্মানিত ব্যক্তিদের হাতে। এই ব্যক্তিরা তাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং সম্পদের ভিত্তিতে সম্প্রদায়ের দিকনির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।

ঔপনিবেশিক শাসন এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দল, সরকারি কর্মকর্তা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আরো বেশি প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। এছাড়াও শিক্ষা ও সচেতনতার প্রসার, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং বাজার অর্থনীতির উত্থান নতুন নতুন নেতৃত্বের ধারণার জন্ম দেয়।

আজকের দিনে গ্রামীণ বাংলাদেশে নেতৃত্ব আরো বৈচিত্র্যময় এবং বহুমুখী। নারী, যুবক এবং উদ্যোক্তারা ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এই পরিবর্তনগুলি ঐতিহ্যবাহী কাঠামোর সঙ্গে নতুন ধারণার সংমিশ্রণ তৈরি করেছে। এতে করে গ্রামীণ বাংলাদেশের সমাজ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় নতুন নতুন গতিশীলতা দেখা দিচ্ছে।

ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ বাংলাদেশ ছিল কৃষিভিত্তিক সমাজের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা, যেখানে সামাজিক নেতৃত্ব গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। এই নেতৃত্ব ব্যবস্থা ছিল শ্রেণীবদ্ধ, জমিদার এবং ধনী কৃষকদের মতো স্থানীয় অভিজাত শ্রেণীর ওপর নির্ভরশীল।

এই নেতারা যাদের প্রায়শই ‘গ্রাম প্রধান’ বলা হতো, তাদের সম্প্রদায়ের ওপর উল্লেখযোগ্য কর্তৃত্ব ছিল। তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন। এর মধ্যে রয়েছে- গ্রামের অভ্যন্তরীণ বিরোধ সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা; ধর্মীয় উৎসব, সামাজিক অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন ও তত্ত্বাবধান করা; গ্রামে শৃঙ্খলা ও আইনের শাসন বজায় রাখা।

এই নেতাদের কর্তৃত্বের উৎস ছিল বেশ জটিল। তাদের ক্ষমতা প্রায়শই জমির মালিকানা, সম্পদ এবং পারিবারিক বংশের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ঐতিহ্য এবং রীতিনীতি তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। স্থানীয় রীতিনীতি ও ঐতিহ্য মেনে চলা তাদের নৈতিক কর্তব্য ছিল এবং সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য ছিলেন।

সামন্ততন্ত্র ও জমিদারি প্রথা
ঔপনিবেশিক যুগ গ্রামীণ বাংলাদেশের নেতৃত্ব কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছিল। বৃটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন জমিদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, যা ‘জমিদার’ নামক ব্যক্তিদের বিপুল পরিমাণ জমির ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং ‘কর’ আদায়ের ক্ষমতা প্রদান করে।

এই ব্যবস্থার ফলে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি দেখা দিয়েছিল। জমিদাররা অভিজাত শ্রেণীর অংশ হয়ে ওঠে এবং তাদের সম্পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করে সমাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তারা গ্রামের প্রধান নেতা হয়ে ওঠে এবং স্থানীয় প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জমিদাররা প্রায়শই তাদের অধীন কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায় করতেন এবং তাদের শোষণ করতেন, যার ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।

এই পরিবর্তনগুলি সত্ত্বেও জমিদারি ব্যবস্থা প্রভাবশালী স্থানীয় নেতাদের একটি শ্রেণী তৈরি করেছিল, যারা গ্রামীণ সমাজে নেতৃত্ব প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। জমিদাররা প্রায়শই স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতেন এবং গ্রামের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।

ভূমি সংস্কার ও নেতৃত্বের পালাবদল
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেবল একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্মই চিহ্নিত করেনি বরং এটি উল্লেখযোগ্য সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনাও করেছিল। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছিল- জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি এবং ভূমি সংস্কারের প্রবর্তন।

ভূমি সংস্কারের লক্ষ্য ছিল ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে জমি পুনর্বণ্টন করা, যা ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতা কাঠামোকে ব্যাহত করে এবং গ্রামীণ এলাকায় ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করে।

ভূমি সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল- গ্রামীণ দরিদ্রদের ক্ষমতায়ন করা এবং আরো সমতাপূর্ণ সমাজ গঠন করা। যাই হোক, এই প্রক্রিয়াটি অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল। পৃষ্ঠপোষক-গ্রাহক সম্পর্কের অবশিষ্টাংশ এবং স্থানীয় অভিজাতদের প্রভাব গ্রামীণ এলাকায় নতুন নেতৃত্ব গঠনে বাধা সৃষ্টি করে।

এছাড়াও জমি বণ্টনের অসমতা এবং দুর্নীতির অভিযোগ ভূমি সংস্কার প্রোগ্রামের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে। তবুও ভূমি সংস্কার বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছিল। এটি অনেক কৃষককে জমির মালিকানা দিয়েছিল এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করেছিল। যদিও সম্পূর্ণ সমতা অর্জিত হয়নি। তবে ভূমি সংস্কার বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক শক্তির উন্মেষ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেবল রাষ্ট্রীয় সীমানা পরিবর্তনই করেনি, বরং দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তনগুলির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল রাজনৈতিক দলের উত্থান এবং গ্রামীণ এলাকায় তাদের প্রভাব বৃদ্ধি।

জাতীয় পর্যায়ে স্বাধীনতার পরবর্তী বছরগুলিতে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। এই দলগুলি তাদের নিজস্ব ভাবধারা ও নীতি নিয়ে ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে। এই প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলি গ্রামীণ এলাকায় তাদের ভিত্তি শক্তিশালী করতে মনোযোগ দিতে শুরু করে। তারা স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে জোট গঠন করে দলীয় শাখা প্রতিষ্ঠা করে এবং নির্বাচনে প্রার্থী দেয়।

এই প্রক্রিয়াটি গ্রামীণ নেতৃত্বের রাজনীতিকরণের দিকে পরিচালিত করে। স্থানীয় নেতারা, যারা আগে সামাজিক বা অর্থনৈতিক প্রভাবের ভিত্তিতে ক্ষমতা ধরে রাখতেন, তাদের এখন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়েছিল, তাদের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখার জন্য।

এই পরিবর্তনটির বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। প্রথমত, এটি গ্রামীণ এলাকায় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করে। দ্বিতীয়ত, এটি স্থানীয় নেতাদের ক্ষমতা আরো প্রাতিষ্ঠানিক করে তোলে। তৃতীয়ত, এটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ওপর রাজনৈতিক দলের প্রভাব বৃদ্ধি করে।

গ্রামীণ নেতৃত্বের রাজনীতিকরণের কিছু নেতিবাচক প্রভাবও ছিল। কিছু ক্ষেত্রে এটি স্থানীয় স্তরে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বৃদ্ধি করে। অন্যান্য ক্ষেত্রে এটি গ্রামীণ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদও সৃষ্টি করে।

তবুও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল এবং গ্রামীণ নেতৃত্বের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই সম্পর্কটি এখনো বিবর্তিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে গ্রামীণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যকে আকার দিতে থাকবে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) উদ্ভব ও পরিবর্তন
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন ও সামাজিক পরিবর্তনে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়।

‘ব্র্যাক’, ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ এবং ‘প্রশিকা’র মতো সংস্থাগুলি দারিদ্র্যবিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী পদ্ধতির পথিকৃৎ ছিল। এইসব বেসরকারি সংস্থা কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানই করেনি বরং নেতৃত্বের নতুন ধারারও প্রবর্তন করেছিল, যা সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ, তৃণমূল সংহতি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছিল।

এনজিও-কর্মীরা প্রায়শই স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন, তাদের চাহিদা (Demand) বোঝা এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী সমস্যা সমাধানে (Problem-solving) সহায়তা করার জন্য। এটি এমন নেতাদের উত্থানকে উৎসাহিত করেছিল, যারা তাদের সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তাদের উন্নতিতে কাজ করেছিলেন।

এনজিওগুলি নারীর ক্ষমতায়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তারা নারীদের অর্থনৈতিক সুযোগ প্রদান করেছিল। তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে সমর্থন করেছিল এবং পরিবারে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে উত্সাহিত করেছিল। এর ফলে গ্রামীণ বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

এনজিওগুলির অবদান সত্ত্বেও তাদের সমালোচনাও রয়েছে। কিছু লোক যুক্তি দিয়েছেন যে, এনজিওগুলি খুব বেশি আন্তর্জাতিক তহবিলের ওপর নির্ভরশীল ছিল, যা তাদের স্থানীয় চাহিদার প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল হতে বাধা দেয়। অন্যরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, এনজিওগুলি কখনো কখনো ‘অতিরিক্ত শক্তিশালী’ হয়ে উঠতে পারে এবং ‘স্থানীয় সরকার’ ও ‘প্রতিষ্ঠান’গুলিকে দুর্বল করতে পারে।

তবুও সন্দেহ নেই যে, বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়নে এনজিওগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তারা দারিদ্র্যবিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং নারীর ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।

ঐতিহ্যগত ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে কাজ করে এনজিও নেতারা গ্রামীণ সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদের চাহিদা বোঝার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। তাদের নেতৃত্ব ক্ষমতা বৃদ্ধি, ক্ষমতায়ন এবং টেকসই উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করেন।

‘অংশগ্রহণমূলক’ পদ্ধতির প্রচার এবং ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের’ প্রক্রিয়ায় সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে, এনজিওগুলি তাদের সম্প্রদায়ের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি সংবেদনশীল নেতাদের একটি নতুন প্রজন্ম তৈরি করেছে।

গ্রামীণ নেতৃত্বে এনজিওগুলোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল নারীর ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেওয়া। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে এনজিওগুলি নারীদের তাদের পরিবার ও সম্প্রদায়ের মধ্যে নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করেছে।

নারী-নেতৃত্বাধীন স্বসহায়ক গোষ্ঠী এবং সমবায়গুলি সম্মিলিত পদক্ষেপ এবং সামাজিক পরিবর্তনের প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে, ঐতিহ্যগত লিঙ্গ নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করে এবং গ্রামীণ নেতৃত্বের পরিধি প্রসারিত করেছে।

এছাড়াও ‘বিকেন্দ্রীকরণ সংস্কার’ বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল। এই সংস্কারের প্রধান লক্ষ্য ছিল- ‘স্থানীয় স্তরে শাসনকে শক্তিশালী করা’ এবং ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা’।

বিকেন্দ্রীকরণ সংস্কার গ্রামীণ এলাকায় নতুন নতুন নেতাদের উত্থানকে উৎসাহিত করেছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জয়ী প্রতিনিধিরা প্রায়শই স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্মানিত এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি হন। এই নেতারা তাদের সম্প্রদায়ের চাহিদা ও উদ্বেগের প্রতি সাড়া দিতে সক্ষম এবং স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নারী ও প্রান্তিক গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে নেতৃত্বের ভূমিকায় অংশগ্রহণ করার অনুমতি দেয়। স্থানীয় কাউন্সিলে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন অন্তর্ভুক্ত করা লিঙ্গ-অন্তর্ভুক্ত নেতৃত্বের দিকে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

ইউনিয়ন পরিষদের নারী নেতৃবৃন্দ আঞ্চলিক সমস্যা যেমন স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং সামাজিক কল্যাণ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

গ্রামীণ বাংলাদেশের অর্থনীতি, কৃষি আধুনিকায়ন, রেমিট্যান্স এবং অকৃষি কর্মকাণ্ডের বৃদ্ধির মাধ্যমে দ্রুত রূপান্তরিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলি সামাজিক নেতৃত্বের ধরনকেও প্রভাবিত করেছে।

‘সবুজ বিপ্লব’, ‘উচ্চ ফলনশীল’ ফসলের জাত এবং ‘আধুনিক চাষাবাদের কৌশল’ প্রবর্তনের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে অনেক কৃষকের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এই সফল কৃষকেরা প্রায়শই নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের পথিকৃৎ, তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ নেতৃত্ব, যা প্রায়শই জমির মালিক, ধর্মীয় নেতা বা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তা ক্রমশ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। নতুন ধনী কৃষকেরা তাদের অর্থনৈতিক শক্তি এবং উদ্যোক্তা মানসিকতার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করছেন। তারা স্থানীয় সরকার, সামাজিক সংস্থা এবং উন্নয়ন প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

পোশাকশিল্প ও জনশক্তি রফতানি
পোশাক শিল্পের উত্থান এবং বিদেশে শ্রম রফতানি গ্রামীণ বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং নেতৃত্বের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। পোশাকশিল্প এবং বিদেশে শ্রম রফতানি গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এর ফলে পারিবারিক আয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে।

রেমিট্যান্স, অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ, গ্রামীণ এলাকায় স্কুল, রাস্তা, বিদ্যুৎ এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মতো অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়েছে। রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত পরিবারগুলি প্রায়শই ব্যবসা শুরু করতে বা কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে অর্থ ব্যবহার করে। এটি গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরো বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে।

অভিবাসী পরিবারগুলি প্রায়শই তাদের সম্প্রদায়গুলিতে ফিরে এসে অর্জিত সম্পদ এবং অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করে। এটি ঐতিহ্যবাহী নেতাদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নতুন ধরনের নেতৃত্বের দিকে পরিচালিত করে। অর্থ এবং প্রভাব অর্জনের মাধ্যমে, অভিবাসী পরিবারগুলি প্রায়শই তাদের সম্প্রদায়গুলিতে উচ্চতর সামাজিক মর্যাদা অর্জন করে। এটি সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস এবং ক্ষমতার গতিশীলতাকে প্রভাবিত করে।

পোশাকশিল্পে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ তাদের আর্থিক স্বাধীনতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। এটি গ্রামীণ সমাজে লিঙ্গের ভূমিকা পরিবর্তনে অবদান রেখেছে। উল্লেখ্য যে, পোশাকশিল্প এবং বিদেশে শ্রম রফতানির কিছু নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শ্রমিকদের শোষণ, পরিবেশগত ক্ষতি এবং পারিবারিক ও সামাজিক বিচ্ছেদ।

গ্রামীণ এলাকায় অকৃষি কার্যকলাপের বৃদ্ধি, যেমন ছোট ব্যবসা, বাণিজ্য এবং পরিষেবা, আয়ের উৎস এবং নেতৃত্বের ধরনকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। এই প্রবণতাটি কৃষিকাজের ওপর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী নির্ভরতা কমিয়ে দিচ্ছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে।

অকৃষি কাজ গ্রামীণ এলাকায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে, যা পারিবারিক আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাস করে। বিভিন্ন ধরনের অকৃষি কার্যকলাপের উপস্থিতি গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরো স্থিতিশীল করে তোলে এবং বাজারের ঝুঁকির প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। অকৃষি ব্যবসা প্রায়শই স্থানীয় অবকাঠামো, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে অবদান রাখে।

উদ্যোক্তা এবং ব্যবসার মালিকেরা, যারা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেন এবং স্থানীয় উন্নয়নে অবদান রাখেন, তারা গ্রামীণ সম্প্রদায়ের নতুন নেতা হয়ে উঠছেন। এই নতুন নেতাদের নেতৃত্ব প্রায়শই উদ্ভাবন, ঝুঁকিগ্রহণ এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ওপর ফোকাস করা হয়। ঐতিহ্যবাহী নেতারা, যারা প্রায়শই জমির মালিকানা বা সামাজিক মর্যাদার ওপর ভিত্তি করে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখেন, তাদের প্রভাব কমতে পারে।

গ্রামীণ বাংলাদেশে সামাজিক নেতৃত্বের পরিবর্তনে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং সাক্ষরতার হার এবং শিক্ষায় প্রবেশাধিকার উন্নত করার উদ্যোগ নতুন প্রজন্মের নেতাদের ক্ষমতায়িত করেছে। জ্ঞান এবং দক্ষতাসহ শিক্ষিত তরুণেরা তাদের সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করছেন।

গ্রামীণ এলাকায় যুব নেতৃত্ব ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সামাজিক পরিবর্তন, উদ্ভাবন এবং সম্প্রদায় পরিষেবার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তরুণ নেতারা তাদের সম্প্রদায়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছেন।

গ্রামীণ বাংলাদেশে, সামাজিক নেতৃত্বে তরুণদের ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতার গতিশীলতা বিন্যাস করছে এবং উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। এই তরুণ নেতারা প্রায়শই উদ্ভাবনী চেতনা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রবল আকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত, গ্রামীণ সমাজের পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন।

শিক্ষাগত অগ্রগতি, অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি এবং এনজিও ও সুশীল সমাজ সংস্থার প্রচেষ্টার সমন্বয়ে গ্রামীণ এলাকায় নারী নেতৃত্বের উত্থান ঘটেছে। এর মূলে রয়েছে, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ। যেমন, মেয়েদের শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করেন, যা তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে এবং নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করে।

ক্ষুদ্রঋণ, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং স্বসহায়ক গোষ্ঠীতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারীরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন। এর ফলে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সমাজে তাদের কণ্ঠস্বর আরো শক্তিশালী হয়। এসব প্রতিষ্ঠান নারীদের নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা নারীদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করে এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।

নারী নেতৃত্ব গ্রামীণ পরিবার ও সম্প্রদায়ের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। নারীরা শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নতিতেও অবদান রাখেন এবং স্থানীয় সরকারে নারীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখেন।

এই অগ্রগতি সত্ত্বেও, অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সাংস্কৃতিক নিয়ম, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা এবং সম্পদে সীমিত প্রবেশাধিকার নেতৃত্বে নারীদের পূর্ণ অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করার জন্য এবং লিঙ্গ সমতাকে উন্নীত করার জন্য শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক সুযোগগুলিতে নারীদের প্রবেশাধিকার বাড়ানো এবং নারীদের নেতৃত্বের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

গ্রামীণ বাংলাদেশের সামাজিক নেতৃত্ব ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি অর্জন করেছে। স্থানীয় সম্প্রদায়ের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন নেতারা। ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্বের ধরন থেকে শুরু করে নারী, তরুণ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নতুন নেতৃত্বের উত্থান পর্যন্ত, আমরা বৈচিত্র্যময় নেতৃত্বের বিকাশ দেখেছি।

গ্রামীণ বাংলাদেশে সামাজিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনের জন্য, আধুনিক আকাঙ্ক্ষা ও ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।

অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্ব
একদিকে, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্বের গুরুত্বের ক্রমবর্ধমান স্বীকৃতি রয়েছে। অন্যদিকে, গভীরভাবে উপবিষ্ট সাংস্কৃতিক নিয়ম এবং পরিবর্তনের প্রতিরোধ অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

গ্রামীণ বাংলাদেশে সামাজিক নেতৃত্বের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় নেতা ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতায়ন একটি অপরিহার্য চ্যালেঞ্জ। নেতাদের কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং জটিল উন্নয়ন সমস্যা মোকাবিলায় তাদের সক্ষম করার জন্য প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এটি অর্জন করা যেতে পারে। উপরোন্তু, দৃঢ় ও জবাবদিহিমূলক স্থানীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সামাজিক নেতৃত্বের অগ্রগতি ধরে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

গ্রামীণ নেতৃত্বে তথ্যপ্রযুক্তি এবং ডিজিটাল সংযোগের প্রভাব

গ্রামীণ নেতৃত্বের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যোগাযোগ, তথ্যপ্রাপ্তি এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এটি নেতাদের ক্ষমতায়ন করতে পারে। তবে ডিজিটাল বিভাজন বিদ্যমান বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে, কারণ সবার প্রযুক্তির সমান অ্যাক্সেস (প্রবেশাধিকার) নেই। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং প্রযুক্তির সম্ভাব্য সুবিধাগুলি সর্বাধিক করা গুরুত্বপূর্ণ।

গ্রামীণ বাংলাদেশের সামাজিক নেতৃত্ব দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিবর্তিত হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী শ্রেণিবদ্ধ কাঠামো থেকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থার দিকে এই পরিবর্তনগুলি নতুন চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রতিফলন ঘটায়।

বাংলাদেশ উন্নয়নের জটিল পথে এগিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামীণ এলাকায় সামাজিক নেতৃত্বের ভূমিকা অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি এবং পরিবর্তনশীল সামাজিক প্রেক্ষাপটে, টেকসই ও প্রাণবন্ত গ্রামীণ সম্প্রদায় গড়ে তোলার জন্য স্থানীয় নেতাদের ক্ষমতায়ন, লিঙ্গসমতা এবং তরুণদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

গ্রামীণ বাংলাদেশের সামাজিক নেতৃত্বের ক্রমবর্ধমান বিবর্তন কেবল একটি পরিবর্তনশীল সমাজেরই প্রতিফলন নয় বরং এটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অসাধারণ স্থিতিস্থাপকতা ও গতিশীলতার প্রমাণ। ঐতিহ্যবাহী কাঠামো থেকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির দিকে এই ক্রমবর্ধমান পরিবর্তন রূপান্তর, অভিযোজন এবং অগ্রগতির একটি অনুপ্রেরণামূলক গল্প বলে।

এই বিবর্তনের পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও দৃঢ় প্রতিশ্রুতি এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তাদের নিরলস পরিশ্রম এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতিই গ্রামীণ এলাকায় ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়নে অবদান রেখেছে।

যদিও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে তবুও এখনো অনেক কিছু করার আছে। নতুন চ্যালেঞ্জের উত্থান এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সামাজিক নেতৃত্বের ভূমিকাকে আরো গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

গ্রামীণ বাংলাদেশে সামাজিক নেতৃত্বের ভবিষ্যত উজ্জ্বল। সঠিক পদক্ষেপ এবং সমর্থনের মাধ্যমে, আমরা এমন নেতাদের বিকাশ করতে পারি, যারা তাদের সম্প্রদায়কে ন্যায়বিচার, সমৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এই প্রচেষ্টায় সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন - সরকার, বেসরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, স্থানীয় সম্প্রদায় এবং ব্যক্তি। একসঙ্গে কাজ করে আমরা একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তন আনতে পারি।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী, ইমেইল: [email protected]

;

সামাজিক অস্থিরতা: কারণ, প্রভাব ও করণীয়



মো: বজলুর রশিদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সামাজিক অস্থিরতা বলতে বোঝায় সেই পরিস্থিতিকে যেখানে সমাজের বিভিন্ন অংশ বা গোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, অসন্তোষ ও সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এটি একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক সমস্যা যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কারণের ফলে সৃষ্ট হতে পারে। সামাজিক অস্থিরতার প্রধান কারণগুলো হলো অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বৈষম্য, বেকারত্ব, শিক্ষার অভাব, এবং সাংস্কৃতিক সংঘাত।

অর্থনৈতিক বৈষম্য হলো সামাজিক অস্থিরতার অন্যতম প্রধান কারণ। যখন সমাজের কিছু অংশ সম্পদে পরিপূর্ণ থাকে এবং অন্য অংশটি দারিদ্র্যপীড়িত থাকে, তখন সমাজে অসন্তোষ ও হতাশা সৃষ্টি হয়। ধনী-গরীবের এই পার্থক্য সমাজের অস্থিরতা বাড়িয়ে তোলে এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য ও দ্বন্দ্বের সূত্রপাত করে। অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব এবং বেকারত্বও সামাজিক অস্থিরতার কারণ হিসেবে দেখা যায়। যখন যুব সমাজ কর্মসংস্থানের সুযোগ পায় না, তখন তারা হতাশ হয়ে পড়ে এবং অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

রাজনৈতিক অস্থিরতাও সামাজিক অস্থিরতার একটি বড় কারণ। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, স্বার্থপরতা, এবং সুশাসনের অভাব সমাজে অসন্তোষ ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক অস্থিরতা সমাজের আইন-শৃঙ্খলা ব্যাহত করে এবং জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। এছাড়া, সমাজের কিছু অংশের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এবং তাদের অধিকার বঞ্চিত করাও সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে। নারীর প্রতি বৈষম্য, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার, এবং জাতিগত বৈষম্য সমাজে অসন্তোষের জন্ম দেয়।

সামাজিক অস্থিরতার প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিফলিত হয়। প্রথমত, এটি সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। সামাজিক অস্থিরতার ফলে সমাজে অপরাধমূলক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায় এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। সামাজিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হয় এবং বিনিয়োগকারীরা সমাজে বিনিয়োগ করতে ভীত থাকে। তৃতীয়ত, এটি সামাজিক বন্ধনকে দুর্বল করে দেয়। সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন এবং অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়, যা সামাজিক ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

বাংলাদেশের সমাজে সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অস্থিরতা বিরাজমান রয়েছে যা সমাজের স্থিতিশীলতা ও শান্তিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এই অস্থিরতার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক সংঘাত, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষার অভাব, এবং সামাজিক বৈষম্য। এছাড়াও, ধর্মীয় ও জাতিগত সংঘাত, শ্রমিক অসন্তোষ, এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা এসব সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে অন্যতম।

প্রথমত, রাজনৈতিক সংঘাত সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সামাজিক অস্থিরতার একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের ফলে সমাজে একটি বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে যা শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশ্বাস ও সংলাপের অভাব, এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে মতবিরোধ সমাজে একটি অসন্তোষের আবহ সৃষ্টি করেছে।

দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক বৈষম্য বাংলাদেশে সামাজিক অস্থিরতার একটি বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ধনী ও গরীবের মধ্যে ক্রমবর্ধমান পার্থক্য সমাজে অসন্তোষ ও হতাশার জন্ম দিচ্ছে। বিশেষ করে, নগর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে আয় ও সুযোগের বৈষম্য সমাজে একটি গভীর ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। উচ্চমূল্যের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে যাচ্ছে, যা তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

তৃতীয়ত, সামাজিক বৈষম্য এবং নারীর প্রতি সহিংসতা সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারীর প্রতি বৈষম্য, শিশুশ্রম, এবং শিশু ও নারীর প্রতি সহিংসতা সমাজে একটি গভীর সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এছাড়া, বিভিন্ন ধর্মীয় ও জাতিগত গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতও সামাজিক অস্থিরতাকে বাড়িয়ে তুলছে।

শিক্ষার অভাবও সামাজিক অস্থিরতার একটি কারণ। অনেক অঞ্চলে শিক্ষার সুযোগের অভাব, এবং শিক্ষার মান কম হওয়া, যুবসমাজের মধ্যে হতাশা ও অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে তুলছে। শিক্ষার অভাব সমাজে অপরাধমূলক কার্যকলাপ এবং উগ্রপন্থী সংগঠনের সদস্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছে।

শ্রমিক অসন্তোষও সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক অস্থিরতার একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে, গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের মজুরি ও কর্মপরিবেশ নিয়ে অসন্তোষ এবং শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সমাজে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। শ্রমিকদের অসন্তোষ এবং তাদের আন্দোলন অনেক সময়ই সহিংস সংঘর্ষে রূপ নিচ্ছে, যা সমাজের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে।

এই সব সমস্যার সমাধান করতে হলে সুশাসন, অর্থনৈতিক সমতা, শিক্ষার প্রসার, এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন, এবং শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এছাড়া, নারীর অধিকার রক্ষা, শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত, এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংঘাত নিরসনেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এই সব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশে সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

সামাজিক অস্থিরতা মোকাবিলার জন্য কয়েকটি করণীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার জন্য ন্যায্য বন্টন নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তৃতীয়ত, সামাজিক বৈষম্য দূর করতে শিক্ষার প্রসার এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সকলের জন্য সমান সুযোগ ও অধিকার নিশ্চিত করা সমাজের অস্থিরতা কমাতে সাহায্য করবে।

এছাড়া, সমাজের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সম্মান করা এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করা অপরিহার্য। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ এবং তাদের সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সমাজে সমন্বয় ও সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। সামাজিক অস্থিরতা দূর করতে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সরকার, রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন এবং সাধারণ জনগণ একসাথে কাজ করলে সমাজে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

;

ইফাতের খাসি ও প্রজাতন্ত্রের এক উচ্চকুলের কর্মচারী



কবির য়াহমদ
ছবি : সংগৃহীত

ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

কোরবানির ঈদের আগে মুশফিকুর রহমান ইফাত নামের এক তরুণ একটি ছাগল নিয়ে ভাইরাল হয়েছিলেন। পনের লাখ টাকা দামের ছিল ছাগলটি। বলেছিলেন তিনি, এরকম একটি খাসি কেনা নাকি তার স্বপ্ন ছিল। এমন খাসি সামনাসামনি আগে কখনো দেখেননি তিনি। আল্লাহ তার নসিবে রেখেছেন বলে তার হয়েছে এই খাসি। আবেগাপ্লুত ছেলেটির কণ্ঠে এরপর ঝরল অশেষ সন্তুষ্টি; এরচেয়ে বেশি আর কী বলব!

এক ছাগলের দাম পনের লাখ—এমন ভিডিওতে সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় হয়েছে। মুহূর্তে ভাইরাল ছেলেটি ও তার ছাগল। ছাগলের এমন দামে পিলে চমকানোর মতো অবস্থা হলেও কোটি টাকা দামের গরুও আছে দেশে। গত এপ্রিলে রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে অনুষ্ঠিত প্রাণিসম্পদ মেলায় একটি গরুর দাম হাঁকা হয়েছিল এক কোটি টাকা। দামের সপক্ষে তখন এর মালিক সাদিক অ্যাগ্রোর ইমরান হোসেন বলেছিলেন, গরুটির বংশমর্যাদার জন্য দাম বেশি। এই গরুটার বাবা, দাদা, দাদার বাবার পরিচয় আছে। তিনি বলেছিলেন, গরুর দাম এক কোটি চাওয়ার অনেক কারণ আছে। এক নম্বর কারণ হচ্ছে—এই গরু ১১০ বছরের পেডিগ্রি (বংশ পরম্পরা) আছে। আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে, এই গরুর বাবা ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন ব্লাড লাইন।

পনের লাখ টাকা দামের ছাগল কোটি টাকা দামের গরুর মালিকের খামারের। আগের গরুটি কত টাকায় বিক্রি হয়েছিল, কে কবে কিনেছিল—সেটা জানা না গেলেও, জানা গেছে পনের লাখে কেনা ছাগলের ক্রেতার পরিচয়। মুশফিকুর রহমান ইফাত একজন সরকারি কর্মকর্তার ছেলে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সভাপতি ড. মো. মতিউর রহমান ইফাতের বাবা। তিনি রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক পিএলসির পরিচালকও। এরপর আলোচনায় আসে মতিউর রহমানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ, আয় ও ব্যয়ের নানা তথ্য। জানা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব তথ্য খতিয়ে দেখবে।

দৈনিক খবরের কাগজ মতিউর রহমানের সম্পদের তথ্য নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গেছে, তিনি একজন সরকারি চাকরিজীবী হয়েও এ পর্যন্ত শত কোটি টাকা সাদা করেছেন। বসুন্ধরায় দুই কোটি টাকার একটি ফ্ল্যাট এবং ধানমন্ডিতে ৪০ কোটি টাকা মূল্যমানের ৫ কাঠায় ৭ তলা বাড়ির মালিক। তিনি প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ওপর গ্লোবাল জুতার ফ্যাক্টরি, রয়েছে ৬০ শতাংশ জমি। জেসিক্স নামে একটি যৌথ ডেভেলপার কোম্পানি রয়েছে তার। বসুন্ধরার ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবন আছে। গাজীপুর সদরে ৪০ কোটি টাকা মূল্যমানের ৮টি খতিয়ানে ৬০ শতাংশ জমি রয়েছে। তার প্রথম স্ত্রীর নামে সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১৪.০৩ শতাংশ, গাজীপুর থানার খিলগাঁও মৌজায় ৬২.১৬ শতাংশ জমি রয়েছে। প্রথমপক্ষের ছেলের নামে ৯০ কোটি টাকা দামের ১৪.৫০ শতাংশ জমি আছে গাজীপুরে। তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে আছে একাধিক দামি গাড়ি। তার নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যাংকে ৫০ কোটি টাকার বেশি এফডিআর করা আছে। তিনি একাধিক বিয়ে করেছেন।

গণমাধ্যমে আসা সম্পদের এই তথ্য তার নিজের নামের এবং পরিবারের একটা অংশের নামে। অন্য স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের তথ্য আসেনি। যেখানে মুশফিকুর রহমান ইফাতরা রয়েছেন। ইফাতের দামি দামি গাড়ির যে তথ্য সামাজিক মাধ্যমে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে এই পক্ষ এবং যদি অন্য কোথাও অন্য কারো নামে কোন সম্পদ থাকে সেগুলো এখনো অপ্রকাশ্য। তবে প্রকাশিত তথ্যই বলছে, তিনি অন্তত হাজার কোটি টাকার মালিক।

মতিউর রহমান মুশফিকুর রহমান ইফাতের সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ককে অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, ইফাত তার সন্তান নয়। যদিও ফেনির সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী বলছেন, ইফাত মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরের সন্তান। নিজাম উদ্দিন এমপি দাবি করছেন, ইফাতের মা তার আত্মীয় হন। একই কথা বলেছেন ফেনির একাধিক জনপ্রতিনিধি, যা ইতোমধ্যেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ মতিউর রহমান পুত্রের ছাগলকাণ্ডে ভাইরালের পর তার সম্পদের তথ্য বের হয়ে যাওয়ায় রক্তের সম্পর্ককেই অস্বীকার করে বসেছেন।

একজন সরকারি কর্মকর্তা কীভাবে এত বিপুল সম্পদের মালিক হলেন—এই প্রশ্নটাই এখন জোরদার হয়েছে? জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উচ্চপর্যায়ে আসীন ব্যক্তি যখন দেশের রাজস্ব নিয়ে ভাবনার কথা ছিল, সেখানে আড়ালে তিনি কীভাবে নিজেদের জন্যেই ‘রাজস্ব আহরণ’ করে গেছেন এতদিন, এটা ইফাতের ছাগলকাণ্ড অনুষ্ঠিত না হলে জানা যেত না। ইফাতের খাসি এবং এর দামকে এখানে তাই যতই নেতিবাচকভাবে দেখা হোক না কেন, এই খাসি, দাম ও ইফাতের ভিডিও পথ দেখিয়েছে সেই ‘উচ্চকুলের’ সরকারি অফিসারের খোঁজ দিতে।

মতিউর রহমান নামের এই সরকারি কর্মকর্তা ইফাতের সঙ্গে তার সম্পর্ককে অস্বীকার করেছেন। তার স্বীকার-অস্বীকারে কিছু যায় আসে না। কারণ ইফাত কোন ফৌজদারি অপরাধী দোষী, এমনকি অভিযুক্তও নয়। পারিবারিকভাবে প্রাপ্ত বিপুল সম্পদ ভোগের নানা তরিকা তার বয়সের কারণেই। এই বয়সের কোন তরুণ যদি এত সম্পদ পায়, তবে নানাভাবে সে ব্যবহার করবেই। এখানে তাকে দোষী বলা যাবে না। হতে পারে, তার খরচের তরিকা অনিয়ন্ত্রিত কিংবা বেহিসাবি সে, তবে এটা যতক্ষণ না অন্যের ক্ষতির কারণ হয় ততক্ষণ সেটা অপরাধ নয়। গণমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে, সে প্রতিবছর খামারে-খামারে গিয়ে পশুর বুকিং আসলে সবগুলো নিতো না। এটা হতে পারে তার অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরা ও বয়সের দোষ। এখানে কাউন্সেলিংয়ে সম্ভব এই দোষের সংশোধন।

পনের লাখ টাকা দাম দিয়ে খাসি কেনার ভিডিও করে ভাইরাল হয়ে মুশফিকুর রহমান ইফাত আদতে দেশের অনেক বড় উপকারই করেছেন। এরমাধ্যমে ‘উচ্চকুলের’ এক সরকারি কর্মচারীর দেখা পেয়েছে দেশ। দেশবাসী জানতে রাষ্ট্রের রাজস্ব আহরণের দায়িত্বে থাকা লোকজনের কেউ কেউ কীভাবে কোথায় নিয়ে গেছেন নিজেদের। ইফাতের খাসি তাই দুদককে বাধ্য করছে এনিয়ে উদ্যোগী হতে। সরকারকে বাধ্য করেছে এনবিআর থেকে ‘জনস্বার্থে’ মতিউর রহমানকে সরিয়ে দিতে। রোববার (২৩ জুন) অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মকিমা বেগম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মো. মতিউর রহমানকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। জনস্বার্থে এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইফাত ও ইফাতের খাসি তাই ক্ষতিকর কিছু নয়। বরং এটা দেশেরই উপকার করেছে বেশ। অনিয়ন্ত্রিত কিংবা বেহিসাবি খরচের বিষয়টা একপাশে সরিয়ে রেখে ইফাতকে তাই ধন্যবাদ দেওয়াই যায়। কারণ তার খাসি, দাম ও ভিডিও খুঁজে দিয়েছে এক সরকারি কর্মকর্তাকে, যিনি এতদিন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে সেই প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ করে গেছেন বিনা বাধায়, গোপনে।

;

সমাজ জীবনে আধুনিকতা ও প্রযুক্তির প্রভাব



মো. বজলুর রশিদ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সমাজ জীবনে আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির প্রভাব বহুমুখী এবং গভীর। আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তনগুলোর যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে, তেমনি কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে।

আধুনিকতা ও প্রযুক্তির ইতিবাচক দিক
আধুনিকতা ও প্রযুক্তির প্রভাব সমাজে বহুবিধ ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তনগুলি আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ, কার্যকর এবং সুবিধাজনক করেছে। প্রথমত, যোগাযোগ ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা এখন বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে মুহূর্তের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারি।

মোবাইল ফোন, ইমেইল, সামাজিকমাধ্যম এবং ভিডিওকলের মাধ্যমে মানুষ দূরত্বের বাধা অতিক্রম করে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছে। এটি ব্যক্তিগত এবং পেশাগত উভয় ক্ষেত্রেই সুবিধাজনক হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার ফলে কার্যক্রমের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষাখাতে প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষার মান ও পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, অনলাইন কোর্স এবং ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সহজেই শিক্ষাগ্রহণ করতে পারছেন। গ্রামীণ এবং দূরবর্তী অঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও উন্নত শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন। এছাড়া, ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করতে পারছেন, যা তাদের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করছে।

তৃতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবায় প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি, টেলিমেডিসিন এবং অনলাইন স্বাস্থ্য পরামর্শের মাধ্যমে মানুষ ঘরে বসেই চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন।

রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবন রক্ষা এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হচ্ছে। এছাড়া, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং অ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা মানুষের স্বাস্থ্যগত জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধি করছে।

চতুর্থত, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ই-কমার্স এবং অনলাইন ব্যবসার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য ও সেবা সহজেই গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছেন। ছোট ও মাঝারি ব্যবসাগুলি অনলাইনে কার্যক্রম পরিচালনা করে তাদের ব্যবসার পরিসর বাড়াতে পারছেন।

এছাড়া, ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম এবং মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন সহজ ও আরো নিরাপদ হয়েছে।

পঞ্চমত, কৃষিখাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়েছে। মেকানিক্যাল হাল, আধুনিক সেচ ব্যবস্থা, উচ্চ ফলনশীল বীজ এবং কৃষি তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষকদের কাজ সহজ এবং কার্যকর হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, কৃষিখাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কৃষকের আয় বৃদ্ধি হয়েছে।

ষষ্ঠত, পরিবহন ও যাতায়াতে প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবনে ব্যাপক সুবিধা নিয়ে এসেছে। আধুনিক যানবাহন, জিপিএস প্রযুক্তি এবং অনলাইন রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের মাধ্যমে যাতায়াত সহজ ও সময় সাশ্রয়ী হয়েছে। এর ফলে, কর্মক্ষেত্রে যাওয়া আসা এবং ব্যক্তিগত যাতায়াত আরো সুবিধাজনক হয়েছে।

সপ্তমত, সামাজিকমাধ্যম এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে মানুষের সৃজনশীলতা ও প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে। মানুষ তাদের সৃজনশীল কাজ, শিল্প, সঙ্গীত, লেখালেখি ইত্যাদি সহজেই শেয়ার করতে পারছেন এবং বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করছেন।

এছাড়া, সামাজিকমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারছেন, যা সামাজিক বন্ধনকে আরো দৃঢ় করছে।

অষ্টমত, আধুনিক প্রযুক্তি ও গ্যাজেটের ব্যবহারে গৃহস্থালি কাজ সহজ হয়েছে। আধুনিক রান্নাঘর যন্ত্রপাতি, হোম অটোমেশন সিস্টেম, ক্লিনিং রোবট ইত্যাদি গৃহস্থালি কাজের সময় ও শ্রম সাশ্রয় করেছে। এর ফলে, মানুষ তাদের পরিবারের সঙ্গে আরো বেশি সময় কাটাতে পারছেন এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে।

নবমত, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়নে প্রযুক্তির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। নবায়নযোগ্য শক্তি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি, স্মার্ট সিটি প্রকল্প এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে। এতে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং পরিবেশ দূষণ কমানোর পাশাপাশি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাচ্ছে।

সবশেষে, সাইবার নিরাপত্তা এবং তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তি কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। উন্নত সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা, এনক্রিপশন প্রযুক্তি এবং তথ্য সুরক্ষা পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত এবং সংবেদনশীল তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে। এর ফলে, তথ্য চুরি, হ্যাকিং এবং সাইবার অপরাধের ঝুঁকি কমানো সম্ভব হচ্ছে।

সব মিলিয়ে, আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকগুলি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ও উন্নতি এনেছে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং এর সুবিধাগুলি গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং সামাজিক অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব, যা আমাদের ভবিষ্যতকে আরো সমৃদ্ধ ও উন্নত করতে সহায়ক হবে।

আধুনিকতা ও প্রযুক্তির নেতিবাচক দিক
তবে এটাও ঠিক যে, আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির প্রভাবের ফলে কিছু নেতিবাচক দিকও পরিলক্ষিত হয়। আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির প্রভাব সমাজে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে, তবে এর কিছু নেতিবাচক দিকও আছে, যা আমাদের নজর এড়িয়ে যায় না। এই নেতিবাচক দিকগুলি সমাজ, সংস্কৃতি, পরিবার এবং ব্যক্তিগত জীবনে বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলছে।

প্রথমত, সামাজিক সম্পর্ক এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগে প্রযুক্তির অতি ব্যবহার নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সামাজিকমাধ্যম এবং ডিজিটাল যোগাযোগের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধির ফলে মানুষ মুখোমুখি যোগাযোগে কম সময় ব্যয় করছে। এর ফলে, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে এবং মানুষ নিজেদের মধ্যে প্রকৃত সংযোগ হারাচ্ছে। শিশু এবং কিশোররা বেশি সময় ডিজিটাল ডিভাইসের সামনে ব্যয় করছে, যা তাদের সামাজিক এবং ব্যক্তিগত দক্ষতা হ্রাস করছে।

দ্বিতীয়ত, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলিও প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কিত। সামাজিকমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং আত্মসম্মানহীনতার কারণ হতে পারে। সামাজিকমাধ্যমে প্রদর্শিত সুখী জীবনযাত্রা এবং সাফল্যের ছবি দেখে মানুষ নিজেকে হীন মনে করতে পারেন। এছাড়া, ডিজিটাল আসক্তি এবং ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ঘুমের সমস্যা, একাকীত্ব এবং মানসিক চাপ বাড়ছে।

তৃতীয়ত, প্রযুক্তির অতি নির্ভরতা কর্মজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অফিস বা কর্মস্থলে প্রযুক্তির ব্যবহার কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করলেও এর মাধ্যমে কাজের চাপ এবং মানসিক চাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে ইমেইল, মেসেজ এবং অনলাইন মিটিংয়ের অতিরিক্ত ব্যবহার ব্যক্তিগত জীবনের সময়কে কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে কর্ম-জীবন ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

চতুর্থত, গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগও প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলোর একটি। ডিজিটাল যুগে ব্যক্তিগত তথ্য সহজেই অনলাইনে শেয়ার হচ্ছে, যা গোপনীয়তা হানির ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। সাইবার অপরাধ, তথ্য চুরি, হ্যাকিং এবং অনলাইন জালিয়াতির ঘটনাগুলি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ বৃদ্ধি করছে।

পঞ্চমত, প্রযুক্তির কারণে শারীরিক স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হচ্ছে। দীর্ঘ সময় কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের সামনে বসে থাকার ফলে চোখের সমস্যা, মাথাব্যথা, ঘাড় ও পিঠের ব্যথা, স্থূলতা এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে শিশু এবং কিশোররা অল্প বয়সেই এই ধরনের সমস্যায় ভুগছে, যা তাদের ভবিষ্যত শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

ষষ্ঠত, প্রযুক্তির কারণে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধেরও অবক্ষয় ঘটছে। প্রচলিত সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সামাজিক রীতিনীতি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে এবং এর জায়গায় পশ্চিমা সংস্কৃতি এবং আধুনিক ধারার প্রবেশ ঘটছে। ফলে, স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

সপ্তমত, গ্রামীণ অর্থনীতির ওপরও প্রযুক্তির কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে কৃষিতে মেশিনের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কৃষকদের জীবিকা নির্বাহের প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলছে। অনেক কৃষক তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন এবং তাদের আয় কমে যাচ্ছে। ফলে, গ্রামীণ অর্থনীতির স্থিতিশীলতা হ্রাস পাচ্ছে এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সবশেষে, প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে শিক্ষার মান ও পদ্ধতি পরিবর্তিত হচ্ছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের মৌলিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে বাধা সৃষ্টি করছে। অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা সুবিধাজনক হলেও, শিক্ষার্থীদের সরাসরি শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ এবং শিক্ষার সামাজিক পরিবেশ থেকে বঞ্চিত করছে। এছাড়া, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সহজলভ্য তথ্যের প্রাচুর্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে তথ্যের মান যাচাই করার ক্ষমতা হ্রাস করছে এবং গভীর চিন্তাশক্তির বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।

আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। যদিও প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের জীবনকে সহজ এবং সুবিধাজনক করেছে, তবে এর নেতিবাচক দিকগুলি মোকাবিলা করতে সচেতনতা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তির সুবিধাগুলি গ্রহণের পাশাপাশি এর নেতিবাচক প্রভাবগুলি মোকাবিলায় আমাদের আরো সচেতন হতে হবে এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

;