‘ওয়াণ্টি ওয়ান’, ‘সাড়ে ফার্স্ট’ এবং শিশু শিক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক বহুমাত্রিকতার জটলা!



ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ড. মো: ফখরুল ইসলাম, ছবি: বার্তা২৪.কম

ড. মো: ফখরুল ইসলাম, ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

গত দু’দিন ধরে ফেসবুক খুললেই শুধু চোখ পড়ছিল প্রাথমিকে কৃতি শিক্ষার্থীদের হাসিমাখা ছবি। বাবা-মা আপনজনদের আঁকুতি- দোয়া করবেন আমার সোনামণিটার জন্য। হ্যাঁ, ওদের জন্য প্রাণখুলে দোয়া তো করবই। কিন্তু পাশাপাশি শঙ্কা জাগে, ওরা এত এত নম্বর পাচ্ছে, এত ভালো ফলাফল করছে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এসে তারা তাদের পাঠ্য বইয়ের সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হচ্ছে কেন? বিষয়টি দিন দিন জাতিকে ভাবিয়ে তুলছে।

বাচ্চারা স্কুলে কিছু শিখুক বা না শিখুক অভিাবকগণ একটি গোল্ডেন জিপিএ চান। এজন্য বাচ্চাদের ওপর চলে নানমুখী চাপ, গৃহশিক্ষকের শাসন ও ট্রাফিকজ্যামের মধ্যে নাওয়া-খাওয়া ভুলে কোচিংবাড়ি যাওয়া-আসার নির্যাতন। একজন মন্ত্রী কিছুদিন আগে শিশুদের জিপিএ ফাইভ বিষয়টিকে ‘নির্যাতনের’সংগে তুলনা করতে কুন্ঠিত হননি! শহুরে অনেক অভিভাবক একটি গোল্ডেন জিপিএ বিষয়টিকে দেখিয়ে সন্তানকে ভাল দামী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারেন অথবা বিদেশে পাঠিয়ে দিতে পারেন। পত্রিকায় প্রকাশ- কোনো কোনো বিত্তশালী অভিভাবক সেসব নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাসুযোগ নেয়ার পাশাপাশি তাদের সন্তানদের চাকুরী কিনে দেয়ারও ক্ষমতা রাখেন!

এছাড়া- নকল, ভেজাল, অনৈতিকতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে কথা বলাকে আজকাল আনস্মার্ট-বোকা বলে মনে করা হয়! কারণ, আজকাল শতাধিক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও সেগুলোতে মানবিক, সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার প্রসার বন্ধ হবার উপক্রম হয়ে গেছে। সেগুলোর সিংহভাগই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ব্যবসায়িক এবং ধার করা পার্টটাইম পঠন-পাঠন ব্যবস্থাপনার থাকায় তাদেরকে বাজারে টিকে থাকার ভাবনায় পেয়ে বসেছে। অনেকে মন খারাপ করতে পারেন, কিন্তু একমত হবেন যে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে আকৃষ্ট করা হলেও সেসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই আজ সনদ বিকি-কিনির বাজার। এসব ঘটতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা জাতি হিসেবে মেধাহীন হয়ে আস্তাকুঁড়ে আস্তানা বেছে নেব আর কি!

যাহোক, কিছুদিন আগে সাড়ে পাঁচ বছরের মেয়েকে সংখ্যা গণনা পড়ানোর সময় সে বলেছিল, আব্বু ইংরেজীতে ২১ যদি টুয়েণ্টি ওয়ান হয় এবং ধারাবাহিকভাবে ৩১, ৪১, ..., ..., ৯১ পর্যন্ত যদি একটা ধারা বজায় থাকে তাহলে ইলেভেন (১১) কেন ওয়াণ্টি ওয়ান হয় না? বাংলায় এক দশ এক এগার হয়, তাহলে একদশ দুই বেগারো হয় না কেন? আবার ২১, ৩১, ৪১ একই ধারায় উচ্চারিত হলেও ১১ কে ইলেভেন বলা হয় কেন? বিষয়টি আপাতঃ দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে আমি উত্তর দিলাম- পড়ার নিয়মটা এভাবেই চলে আসছে। এত বেশি ব্যাখ্যা চেও না, ভালভাবে পড়াশোনা কর, পরীক্ষায় ফার্ষ্ট হতে হবে। সে বলল ফার্ষ্ট হলে আমাকে কী উপহার দিবে? আর যদি সাড়ে ফার্ষ্ট হই তাহলে কি তার চেয়ে বেশি কিছু দিবে?

আমি তো শুনে হতবাক। এতটুকু মেয়ে, কেবল বাংলা বলা শিখেছে, তার কথার ধরন এবং গভীরতা দেখলে ভিমড়ি খাবার মত অবস্থা আর কি! কিন্তু একটি বিষয় সত্যি যে, বাংলাদেশে ওয়াণ্টি ওয়ানের ধারাবাহিকতা না থাকার মত শিশুদের শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই একটা বহুমাত্রিক ব্যবস্থার ধারা বিদ্যমান। শিক্ষা ব্যবস্থায় সাধারণতঃ মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শুরু হয়ে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বহুমাত্রিকতা রয়েছে কিন্তু পৃথিবীর কোথাও শিশুদের শিক্ষা জীবনের শুরুতেই বাংলাদেশের শিক্ষা ধারার মত বৈচিত্র্য, বৈষম্য, বিভেদ, সমন্বয়হীনতা ও অসামঞ্জস্য চোখে পড়ে না। বিশেষতঃ শহুরে শিশুদের মধ্যে এই বিভেদ বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

আজকের লেখাটিতে শিশু মস্তিষ্কের অসাধারণ ক্ষমতা, শিশুদের শিক্ষা জীবনের শুরুতেই প্রতিষ্ঠানগত নানা বিভেদ ও পার্থক্য নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।

আজকাল সব বাবা-মা'কে বলতে শুনি, আজকালকার বাচ্চারা খুবই পাকা পাকা কথা বলে। বাচ্চাদের মস্তিষ্ক বিশেষ করে যাদের পাঁচ বছর বয়স পূর্ণ হয়েছে তাদের মগজ খুবই শাণিত। আর কেনই বা হবে না? আজকাল বাচ্চারা জন্মের পর হতেই পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা থেকে যা কিছু দেখছে, ব্যবহার করছে এবং শুনতে অভ্যস্ত হচ্ছে সেগুলো তাদের মগজকে নিয়তই শাণিত করছে। বাচ্চাদের অবসর বলতে কিছু নেই। শুধু ঘুমের সময়টা বাদে তারা কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। টিভিতে কার্টুন অথবা ছবি অথবা অন্য কোন অনুষ্ঠান, কম্পিউটারে গেম, ছবি আঁকা, স্কুলের পড়া তৈরি, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খেলা করা আর খাওয়া-দাওয়া নিয়ে যে কোনো বাচ্চা সারাটা দিন ব্যস্ত সময় কাটায়। এমনকি স্কুল ছুটির পর দুপুরে খাবার খাইয়ে দিয়ে ঘুম-পাড়ানো খুবই অসম্ভব ব্যাপার। বাচ্চারা যেন দিনে ঘুমুতেই চায় না। কেউ কেউ সারাদিন ভিডিও গেম খেলে। কেউ কার্টুন দেখে এমনকি রাতে বড়দের সাথে নাটকসহ সকল টিভি অনুষ্ঠান দেখতে পছন্দ করে। খুব অল্পবয়সী বাচ্চাদের মধ্যে নাটকের পাত্র-পাত্রীদের নাম, ডায়লগ মুখস্থ রাখতে দেখা যায়। টিভি অনুষ্ঠান দেখতে অভ্যস্ত এক বাচ্চা তার মাকে বলেছিল, মা টিভিতে শুধু বাংলা ও ইংরেজী খবর হয় কিন্তু অংক খবর কেন হয় না ?


এক গবেষণায় দেখা যায়, একজন বয়স্ক মানুষ তার মস্তিষ্কের ক্ষমতার ১৫ ভাগও ব্যবহার করতে সচেষ্ট হয় না। এর চেয়ে বেশি ব্যবহারকারীরা নাকি নিউটন হয়ে যাবেন! তবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটা ব্যতিক্রম। একটি সুস্থ সবল বাচ্চা যেভাবেই হোক তার জানা ক্ষমতার সবটুকু ব্যবহার করতে তৎপর থাকে। যদি তা না করে তাহলে বুঝতে হবে সে বাচ্চা স্বাভাবিক নয়। কিছু কিছু বাচ্চার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন, অনেক সুস্থ বাচ্চা স্বভাবতইঃ চুপচাপ ও লাজুক ধরণের। তবে আজকাল এদের সংখ্যা খুবই কম।

শৈশবকালে বাচ্চাদের কৌতুহল প্রবণতা খুব বেষি থাকে। কৌতুহল থেকে নতুনকে জানা ও বোঝার পথ উন্মোচিত হয়। তাই বাচ্চাদের স্বভাবজাত কৌতুহলকে খুবই সতর্কতার সাথে সহজ, সরল, সঠিক এবং প্রাঞ্জল ভাষায় নিবৃত্ত করতে হবে। কোনো ধরনের ছল-চাতুরী, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তাদেরকে দমিয়ে রাখা যাবে না। তাহলে তাদের স্বভাবজাত কৌতুহলের মধ্যে ছেদ পড়বে এবং যদি তারা কোন কৌতুহলের প্রেক্ষিতে জবাবটা বাবা-মায়ের কাছে একরকম, শিক্ষকদের কাছে একরকম এবং বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আরেকরকম ভাবে জানতে পারে তাহলে তাদের কৌতুহলের সঠিক জবাব কোনটি এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকবে সঠিক উত্তর খুঁজতে একসময় হতাশ হয়ে পড়বে এবং অপরকে ঘৃণা করা শুরু করবে। অধিকন্তু তার ভিতরেও মিথ্যা, ছলনা, ক্ষোভ ইত্যাদির সৃষ্টি হবে এবং স্বাভাবিক সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলবে। মনে রাখতে হবে যে, শিশু মস্তিষ্ক একটি প্রায় ফাঁকা হার্ড ডিস্ক। এই হার্ড ডিস্কে সহজেই নতুন কিছু রেকর্ড হয়ে যেতে পারে। তাই ভাইরাস সদৃশ্য মিথ্যা, চাতুরী, অসততা ইত্যাদি শিশুকালেই যাতে তাদের মাথায় ঢুকে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

তাই শিশুদের মধ্যে সৃজনশীলতাবোধকে জাগ্রতকরণ ও তার লালনের জন্য কৌতুহলকে ইতিবাচকভাবে অথবা নেতিবাচকভাবে যা সত্য তাই তুল ধরতে হবে। তবে জিপিএ ফাইভ পেতে গিয়ে পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য যদি বাজারের গাইড বা নোটবই কিনে মুখস্থ করা হয় সেটা আত্মঘাতী হবে। আজকাল এটাই ঘটে চলেছে। সেজন্য স্কুল-কলেজের সনদে ডাবল জিপিএ ফাইভ পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হতে দেখা যাচ্ছে।

যা বলছিলাম, আজকাল শিশুদের মধ্যে অধিক কৌতুহল প্রবণতা ও অধিক জিজ্ঞাসু মনোভাব লক্ষণীয়। শিশুদের এই জিজ্ঞাসু মনোভাবকে সযতেœ লালন করতে হবে। তাদের মননশীলতার এদিকটিকে ইতিবাচক হিসেবে ধরে নিয়ে তাদের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন ব্যবহার প্রদর্শন করতে হবে।

আরেকটি বিষয়, আজকাল আমাদের দেশে শিশুতে শিশুতে পার্থক্য ও বৈষম্য খুবই পীড়াদায়ক। ঘনিষ্ট বন্ধু দুই শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায় স্কুলের পার্থক্য, পোষাকের পার্থক্য, খাদ্যের পার্থক্য। এই পার্থক্য কমিয়ে আনার জন্য শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রগুলোকে সার্বজনীন করতে হবে। বিশেষতঃ শহরাঞ্চলের শিশুরা কেউ কিন্ডারগার্টেনে যায়, কেউ ইংরেজী মাধ্যম শিখে, কেউ কমদামী স্কুলে যায়। এক্ষেত্রে অতি শৈশবকাল থেকেই আমরা জাতিকে বিভক্ত করে তুলছি। কিছু শিশু ইংরেজী শিখে স্মার্ট হচ্ছে কিছু শিশু সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে তাদের সমমানে যেতে পারছে না। উন্নত বিশ্বে এই বৈষম্য নেই বললেই চলে। যেমন, জাপানে ধনী-গরীব, উচ্চ-নীচু সবার বাচ্চারাই একই স্কুলে যায়, কমপক্ষে শুরু থেকে ৮ গ্রেড পর্যন্ত সব পিতামাতাই তাদের সন্তানদের একই ধরনের পরিবেশে লালন-পালন করাতে পারেন। সেক্ষেত্রে বাবা-মায়ের আয়ের পরিমাণ অনুযায়ী স্কুলের খরচ নির্ধারণ করে দেয়া থাকে। মূলতঃ সরকারি তত্ত্বাবধানে সেসকল স্কুল পরিচালনা করা হয়। শিশুদের খাবার, পোষাক, চিকিৎসা এবং অবস্থানকালীণ সময়ের নিয়ম-কানুন চাকুরীজীবি বাবা-মাকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে একটি নিশ্চিন্ত সেবাদান করার সুযোগ এনে দেয়। কর্মজীবি বাবা-মায়েরা সকাল থেকে রাতের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেসকল ‘ডে-কেয়ার কাম-স্কুলে’ বাচ্চাদের রেখে নিশ্চিন্তে নিজেদের পেশাগত কাজ চালিয়ে থাকেন।

বাংলাদেশে (২০১০ এর শিক্ষানীতিতে উল্লেখ আছে) এখন সময় এসেছে বৈষম্যহীনভাবে ১ম-৮ম শ্রেণির বাচ্চাদের জন্য সার্বজনীন শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা দেয়ার। গ্রামাঞ্চলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের ক্ষেত্রে বৈষম্য আপাতঃ দৃষ্টিতে নেই। কারণ গ্রামে সরকারি ও কিছু রেজিষ্টার্ড বিদ্যালয় এবং মক্তব, মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া ছাড়া শিশুদের শিক্ষার অন্য কোন গত্যন্তর নেই। কিন্তু থানা, জেলাশহর এবং রাজধানীতে শিশু শিক্ষার বৈষম্য আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের দুর্বলতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। শহরাঞ্চলে বাহারি নামের কিন্ডারগার্টেন, প্রি-ক্যাডেট, ক্যাডেট মাদ্রাসা, চাইল্ড কেয়ারহোম গুলোতে বিদেশি ভাষা মাধ্যমে শিক্ষা, অভিনব পাঠ্যসূচি, বোঝা বোঝা বই-পুস্তক এবং বাচ্চাদের মাসিক খরচের পর্বত প্রমাণ হিসেব প্রভৃতি শৈশবকাল থেকেই বাচ্চাদের মধ্যে বিভেদ এবং পড়াশুনা নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে এবং অনেকক্ষেত্রে বাচ্চাদের প্রাকৃতিক ও সুপ্ত সৃজনশীলতাকে বিলীন করে দিচ্ছে।

কোমলমতি বাচ্চারা তাদের দেহের ওজনের চেয়ে বেশি ওজনের বই খাতা পিঠে নিয়ে কুঁজো হয়ে বহন করে । এর সাথে দৈহিক ও মানসিক উভয় যন্ত্রনা বিজড়িত হয়ে যায় । এ ছাড়া বিশাল সিলেবাসের ঝক্কি সামলাতে বাড়ীতে উচ্চ বেতনে হাউস টিউটর এবং কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভরশীলতার প্রবণতা জড়িত এবং শহরাঞ্চলের স্কুলগুলোতে কর্মরত অধিকাংশ শিক্ষকগণ ক্লাশরুমে পড়ানো ফাঁকি দিয়ে উচ্চতর মাসিক বেতনে বাসা-বাড়িতে গিয়ে পড়ানো, নিজ বাসভবনে স্কুল খুলে ব্যবসা চালিয়ে সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে এই বৈষম্যকে আরো প্রকট করে তুলছেন।

পাশাপাশি সীমিত আয়ের অভিভাবকদের মধ্যে হীন প্রতিযোগিতা, হতাশা এবং শিশুদের শিক্ষাক্ষেত্রে সামাজিক এই বিষয়টিতে সামঞ্জস্য বিধান করতে না পারায় ঘুষ- দুর্নীতিতে লিপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে। খোদ রাজধানীতে বাচ্চাদের কোনো কোনো স্কুলে ভর্ত্তি ফি’র পরিমাণ এত বেশি, যা দিয়ে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় পাবলিক স্কুল- থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বাংলাদেশে একজন ছাত্রের ১ম শ্রেণী থেকে মাস্টার্স পাশ করা পর্যন্ত সমূদয় খরচ মেটানো সম্ভব (যেখানে পাবলিক স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসিক বেতন মাত্র ২০ বা ৩০ টাকা, সেখানে রাজধানীর একটি নামকরা স্কুলে ২য় শ্রেণীতে ভর্ত্তি হতে খরচ হয় ডোনেশনসহ ৮০ হাজার থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা)।

ক’দিন পরেই নতুন বছর শুরু হবে। তাই গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় না হোক, কমপক্ষে শিশুজীবনের জন্য একটি ইতিবাচক পর্যায় গড়ে তুলতে হলে শহরে প্রাথমিক শিক্ষার বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি, গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী শিক্ষকরা যাতে শিক্ষকতা করতে আকৃষ্ট হয় সেজন্য বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাড়াতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণে এই পদক্ষেপ প্রভূত বিপ্লব বয়ে আনতে পারে। তাহলে শিশুতে-শিশুতে বৈষম্য ও বঞ্চনা কম হবে এবং শিশুদের সৃজনশীলতাকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। একটি ইতিবাচক সৃজনশীলতার জন্য প্রয়োজন ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তন। আর এই ধরনের সামাজিক পরিবর্তন আনতে হলে শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত সংস্কার ঘটানো জরুরি। এই সংস্কার সূচিত হলে কেউ আর ‘গোল্ডেন জিপিএ’-র মত আজব তথা বৈষম্যমূলক প্রতিযোগিতায় সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে আগ্রহী হবে না। বরং একজন শিশুর ‘ওয়াণ্টি ওয়ান’ বা ‘অংক খবর’সৃষ্টির ইচ্ছার মত লক্ষ লক্ষ শিশুর বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুহলগুলোকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যাবে এবং শুধুমাত্র একজন শিশু ‘সাড়ে ফার্ষ্ট’হয়ে সুযোগ লাভ করবে- তা না হয়ে সমাজের আপামর শিশু ‘সাড়ে ফার্ষ্ট’স্থান লাভ করার মনো:দৈহিক ও নৈতিক শক্তি অর্জন করে ভবিষ্যতে দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত করতে পারবে।

ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

   

পদোন্নতি-পদাবনতি: কেমন প্রভাব ফেলবে বিএনপিতে?



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
বিএনপি লোগো

বিএনপি লোগো

  • Font increase
  • Font Decrease

সরকারবিরোধী আন্দোলনে পিছু হটা বিএনপি এবার সংগঠনকে গতিশীল করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে বিএনপি ছাত্রদলের আট মহানগর কমিটিসহ জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার মতো আলঙ্কারিক পদও আছে এখানে। নতুন কমিটি দিয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলে। হঠাৎ দলে বড় ধরনের এই পরিবর্তনের কারণ, বিগত আন্দোলনে নেতাদের ভূমিকা, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয়তা।

বিএনপির নতুন এই সাংগঠনিক তৎপরতায় যেমন কমিটি ভেঙে দেওয়া, নতুন কমিটি দেওয়া যেমন আছে, তেমনি আছে নেতাদের পদোন্নতি ও পদাবনতি। এই পদাবনতি এবং কমিটি ভেঙে দেওয়া আন্দোলনে ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে, তবে পদোন্নতি ঠিক কীসের কারণে—এনিয়ে প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক। কারণ যে আন্দোলন ব্যর্থ, সেখান থেকে কারো পদোন্নতির সুযোগ ছিল না। দলের ব্যর্থতায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাফল্য খোঁজার কিছু থাকে না। এখানে সংগঠনের চাইতে ব্যক্তিকে প্রাধান্য সাংগঠনিকভাবে হওয়ার কথা না, তবু সেটাই করেছে বিএনপি। বিএনপি এখানে কি কাউকে পদ দিয়ে খুশি করে তবেই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে চাইছে?

বছরাধিক সময়ের ধারাবাহিক আন্দোলনের একটা পর্যায়ে দেশি-বিদেশি চাপ যখন সরকারের ওপর রাখতে সক্ষম হয়েছিল বিএনপি, তখন গত বছরের অক্টোবরে মাঠের আন্দোলন জোরদার করার নামে আদতে তাদের পিছুটান শুরু হয়। ২৮ অক্টোবরের বহুল আলোচিত সমাবেশ থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন নতুন গতি সঞ্চারের আশা দলটির কর্মীসমর্থকদের থাকলেও নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং আন্দোলনে অনভিজ্ঞতায় তাদের পিছু হটতে হয়। কর্মীসমর্থকদের অতি-উৎসাহসঞ্জাত বাড়াবাড়ি, আগুন, পুলিশে ওপর হামলা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় আশাবাদের বেলুন চুপসে যায়। বড় ধরনের জনসমাগম ঘটিয়েও রাজপথ ছাড়তে হয় তাদের। এরপর কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর সরকারের দমননীতি, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের কারাগমনে আন্দোলন শেষ হয়ে যায়। এরপর হরতাল-অবরোধ দিয়ে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিএনপি যে আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিল সেটা ছিল কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। সাধারণ নাগরিকদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে যেমন পারেনি তারা, তেমনি পারেনি নেতাকর্মীদেরও আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে।

আন্দোলনে ব্যর্থতার দায় এতদিন বিএনপি কেবলই সরকারের দমননীতিকে উল্লেখ করে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। এটা যে ছিল তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য, তা এবারের দলের ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আদতে স্বীকার করে নিয়েছে। এই স্বীকারে অবশ্য তাদের রাজনৈতিক পরাজয় নেই, আছে আত্মোপলব্ধির চেষ্টা। তবে কথা থাকে, পুনর্গঠন প্রক্রিয়া যদি হয় আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতাকে কেন্দ্র করে, সেখানে কীভাবে দলের কিছু নেতার পদোন্নতি হয়? পদোন্নতি পাওয়া এত নেতা আন্দোলনে কী ভূমিকা রেখেছিলেন? স্থানীয়ভাবে হয়ত চেষ্টা থাকতে পারে তাদের, তবে দল যখন সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ, সেখানে আলাদাভাবে ‘পরাজিত সৈনিকদের’ মূল্যায়ন করা কতখানি যৌক্তিক?

আন্দোলনে ব্যর্থ বলে বিএনপির কেউ পদোন্নতি পাবেন না, এমন বলছি না; তবে তাদের মূল্যায়ন হতে পারে যথাযথ প্রক্রিয়ায়। রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি বণ্টনের যৌক্তিক জায়গা হচ্ছে কাউন্সিল, স্রেফ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এখানে কাউকে পদপদবি দিলে এটা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। বিএনপির যখন বলছে, তারা দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফেরাতে আন্দোলন করছে, তখন নিজ দলের মধ্যে এ কেমন গণতন্ত্র চর্চা তাদের? রাজনৈতিক দলে করপোরেট সংস্কৃতি চর্চা কি শোভন?  

বিএনপির বর্তমান কমিটির বয়স ৮ বছরের বেশি। ২০১৬ সালের মার্চে সবশেষ কাউন্সিল করেছিল দলটি। এই কমিটি থাকাকালে দেশে দুইটা জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা জোটগতভাবে অংশ নিলেও, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। গত নির্বাচনের সময়ে দেশি-বিদেশি যে চাপের মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগ সরকার, তাতে তারা অংশ নিলে কী হতো এনিয়ে আছে নানা আলোচনা। তবে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত এবং নির্বাচন প্রতিহত করার নামে দিনশেষে পিছুটান দেওয়ায় সরকারবিরোধী সবচেয়ে বড় দলটি কোনোভাবেই লাভবান হয়নি। কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচনই নয়, বিএনপি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতেও অংশ নিচ্ছে না।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলটির তৃণমূল অংশ নিতে চাইলেও কেন্দ্র তাতে সম্মত হয়নি। ফলে অনেক জায়গায় দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে অনেকেই অংশ নিয়েছে, কেউ কেউ জয়ীও হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়া নেতাদের বহিস্কার করেছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে যে সিদ্ধান্ত, সেটা তারা যেমন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিয়েছিল, সে একই সিদ্ধান্ত আবার তাদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও। অথচ ইতিহাসে কখনই স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীন ছাড়া হয় না, এমনটা হওয়ারও সুযোগ নেই। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে সেই নির্বাচনকেই ‘না’ বলার এই পূর্ব-সিদ্ধান্তে দলটি আদতে লাভবান হচ্ছে না।

বিএনপির সাম্প্রতিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় যাদের পদাবনতি হয়েছে তারা বড় নেতা ছিলেন, এমন না। পাঁচ সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব কমিয়ে তাদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। কেন্দ্রে যাদের পদোন্নতি হয়েছে তাদের কেউ যে বিগত আন্দোলনে প্রভাব ফেলার মতো ভূমিকা রেখেছিলেন এমনও না। যাদের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলে নেওয়া হয়েছে আন্দোলনের সময়ে তারাও ছিলেন আলোচনার বাইরে, যদিও এটা দলের আলঙ্কারিক পদ। আন্দোলনের সময়ে ও সরকারের কঠোর অবস্থানের মুখে নেতারা কেমন ভূমিকা রাখার সামর্থ্য রাখেন, এটা নিকট অতীত দেখিয়েছে তাদের।

সাম্প্রতিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া বিএনপির মধ্যে ব্যাপক প্রভাব রাখতে পারবে কি? আন্দোলনে ব্যর্থতায় যেখানে দরকার ছিল কেন্দ্রে নতুন কমিটি, সেখানে কাউন্সিলের চিন্তা না করে নতুন নতুন পদায়ন দলের সংকটকে দূরীভূত করতে পারবে না। ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে বিশাল জনসমাগম ঘটিয়েও টিকে থাকার বিকল্প ব্যবস্থা না রেখে, নির্বাচনে বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং গণগ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে গিয়ে বিএনপি নেতারা যে সর্বনাশ করেছিলেন, পুনর্গঠনের নামে আলোচনায় ওঠে আসার এই চেষ্টায় তাদের খুব বেশি লাভ যে হবে তেমনটা মনে হচ্ছে না। 

;

কালো টাকা সাদা বলা- পাপকে ঘৃণা করছি না কেন?



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

নসর পেয়াদা গল্পে ভুলে মাছ রান্নার তেল কেনা হয়েছিল মদের বোতলে। সেজন্য সেই রান্না করা লোভনীয় মাছ কোন মুসলিম সে রাতে খাননি। স্কুলে পড়েছিলাম সেই গল্প। কারণ, মাদকদ্রব্য সেবন করাই মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ বা হারাম। এ গল্পে ধর্মীয় নৈতিকতার একটা মহান শিক্ষা মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। তখনকার দিনে মানুষ এতটা ধর্মপরায়ণতার চিন্তা করতো না-কিন্তু, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দের তফাৎ করাকে কায়মনোবাক্যে পালন করতো। যে যার ধর্মের বিধি-নিষেধগুলোকে শ্রদ্ধাভরে পালন করতো। এখন দিন পাল্টে গেছে। মানুষ দিন দিন বড্ড বেশি অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে।

আজকাল ব্যস্ত মানুষের সময় কেড়ে নিচ্ছে মোবাইল ফোন আর সংযুক্ত এন্তারজাল। যে মায়াজালে মানুষের চোখ-মন সব সময় আটকে থাকে। তাইতো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, অভিভাবক বা কারো সঙ্গে কোন কিছুর ভাল-মন্দ শেয়ার করার কোন সময় না পেয়ে ভুল করে বসে। এভাবে গায়ের চামড়ার রং আরও ফর্সা করার জন্য বিষাক্ত ক্রিমের ব্যবহার করতে গিয়ে দেহকে বিকৃত করেতে দ্বিধা করছে না!

এবারের জাতীয় বাজেটে কালো টাকা সাদা করার ঘোষণা নিয়ে একটি বিতর্কের কলামে চোখ আটকিয়ে গেল। টিআইবি মন্তব্য করেছেন-কালো টাকা সাদা করা অসাংবিধানিক, বৈষম্যমূলক, দুর্নীতিবান্ধব এবং প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণার পরিপন্থি।

দেশে একশ্রেণির মানুষ অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। এদের প্ররোচণায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্বরত নীতিবান মানুষগুলোর সৎ ও জনকল্যাণকর নীতিগুলো বার বার ভূলুন্ঠিত হয়ে পড়ে। বাধাগ্রস্থ হয় সততা। জিইয়ে থাকে মাদক ব্যবসা, অনৈতিক লেন-দেনের সিস্টেমগুলো। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অন্যায়-অবিচার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষিত জিরো টলারেন্স বা সহ্যের শূন্য সীমা- তাহলে কি তারা ভাঁওতাবজিতে পরিণত করতে চায়?

কালো টাকার জন্ম অন্ধকারের ঘুপচি গলিতে। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, জালিয়াতি, মিথ্যা, প্রতারণা, কর ফাঁকি, চুরি-ডাকাতি, প্রতারণা, চোরাচালানি, অবৈধ মাদক ব্যবসা, ব্যাংক লুন্ঠন, মানি লন্ডারিং, জমি জবরদখল, নদীদখল, ভেজালদ্রব্য তৈরি ও বিক্রি সর্বোপরি ধর্মীয় প্রতারণা, মাজার ব্যবসা, যাকাত ফাঁকি-ইত্যাকার নানা বাজে পন্থা হলো কালো টাকার আঁতুড় ঘর। এসব কালো টাকার মালিকরা সমাজের হোমড়-চোমড়া। নৈতিকার বালাই নেই এদের কাজে কর্মে ও নীতিতে। দেশের কর প্রদান করতে গেলে ধরা পড়তে পারে তাই এরা একদিকে সঠিক পরিমাণ কর দেয় না অন্যদিকে ধর্মীয় ও নৈতিকতাবোধ না থাকায় যাকাত প্রদানেও বিরত থাকে। তাই এদের দ্বারা রাষ্ট্রের আর্থিক কোন মর্যাদা বাড়ে না, দরিদ্র মানুষের কল্যাণও সাধিত হয় না।

রাসায়নিকভাবে কালো রংয়ের মধ্যে সাদা রং মেশালে তা সাদা থাকে না। ছাই বা এ ধরণের ভিন্ন রং ধারণ করে। যা অনেক সময় ছাই বা উৎকট পরিবেশ তৈরি করে বিশ্রি রূপ নেয়! কালো টাকা সাদা করতে গিয়ে যদি সমাজে কিছু ছাই জন্ম নেয় তাহলে মানুষের স্বাভাবিক মানসিক পরিস্থিতি খিঁচড়ে গিয়ে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

বাংলাদেশ মুসলিম রাষ্ট্র। এদেশের কর্ণধারগণ মোটামুটি সবাই হজ করে থকেন। কেউ কেউ কিছুদিন পর পর পবিত্র ওমরাহ পালন করতে মক্কা-মদিনায় গমণ করে থাকেন। সেখানে গিয়ে তারা পবিত্র দেহ-মন নিয়ে ফিরে আসেন, দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তারা নিশ্চই চাইবেন না- দেশে এখনও কালো টাকা থাকুক অথবা কালো টাকা জন্ম নিক। আমাদের ৯০ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশে সিংহভাগ মানুষই ন্যায়নীতির সাথে জীবন যাপন করতে ভালবাসে। তারা সেই পরিবেশ আরু ভালো হোক্ সেটাই কামনা করে। তবে কেন মাত্র ১০% কর দিয়ে মিথ্যার বেসাতী ? যারা কালো টাকা সাদা করার পক্ষে তার কি পর্যবেক্ষণ করেন না যে এর চেয়ে কত বেশি অর্থ প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে হারাতে হয়?

কালো টাকা সাদা করার সংবাদ দুর্নীতিকে বহু গুণে উস্কে দিবে। জাতি আর জেনেশুনে পাপী হতে চায় না। আমাদের লাখ-কোটি টাকার বাজেটে কালো টাকা সাদা করার অবদান যতই থাকুক না কেন তা অবৈধ, নাপাক! একজন হাজি সৎ রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে এই অবৈধ অর্থের পৃষ্ঠপোষকতা না করে বরং ঘৃণা প্রদর্শন করা উচিত। তা না হলে আমাদের উন্নয়নের বরকত কেন উধাও হয়ে যায়? আমাদের সোনার দেশের সোনার ছেলেরা বর্তমানে গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ছেড়ে কোন অশান্তিতে পিষ্ট হয়ে ভূ-মধ্যসাগরে রিফিউজি হয়ে বার বার সাগরডুবিতে মারা যায়?

সেজন্য লাগামহীন দুর্নীতি কমানোর জন্য জিরো টলারেন্স বা সহ্যের শূন্য সীমা নামক যে জোর প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে সেটাই থাক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন পিছু না আসে সেজন্য সবাই নিজ নিজ ধর্মমতে প্রার্থনা করুন। আশা করা যায়, কালো টাকা সাদা করার প্রচেষ্টা থেকে সরে এলে শান্তি আসতে পারে। আমাদের হতাশা ও অস্থিরতা বেড়েছে, শান্তি কমে যাচ্ছে দিন দিন। এদিকে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইপির প্রতিবছরের মত এবারের রিপোর্টে প্রকাশ- ২০১৮ সালে বিশ্ব শান্তি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯২ থাকলেও ২০১৯ সালের জুনে এসে তা ৯ ধাপ পিছিয়ে ১০১তম হয়েছে। বিশ্ব শান্তি সূচকে এক বছরে নয়ধাপ অবনমন আমাদের দেশের জন্য ভয়ংকর অশনিসংকেত।

কালো টাকা প্রতিবছর সাদা করার ঘোষণা দেওয়াটা আমাদের দেশের মানুষের ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা দেশে হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদেরকে আরও বেশি উৎসাহ দিচ্ছে এবং দুর্বৃত্তপরায়ণাতাকে শক্তিশালী করে তুলছে। তার প্রমাণ ২০২৪ সালে শুরুতে কেতাদুরস্ত সরকারি -বেসরকারি কুম্ভীলকদের ভয়ংকর রকম চুরি-ডাকাতির ঘটনা ফাঁস হওয়া ও তাদেরকে ক্ষমতাধর মহারথীদের যাদুমন্ত্রের কারসাজিতে দেশ থেকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেওয়া। এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনা আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধকে চপেটাঘাত করেছে, চরম আয়বৈষম্য, দ্রব্যমূল্যসন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে এবং গণদারিদ্র্যকে আরও বেশি ঘনীভূত করার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। এটা কোন কোন ভণ্ড মুসলিম নামধারীদের নীতি হলেও দেশের আপামর প্রকৃত মুমিন-মুসলিমদের আর্থিক নীতি হতে পারে না।

এবারের বাজেটে ডিভিএস বা ডাটা ভেরিফিকেশন সিস্টেম চালু করে অপ্রদর্শিত আয় বা দুর্নীতির কালো টাকা দিয়ে ফ্লাট, অ্যাপার্টমেন্ট, জমি কেনা ইত্যাদি বৈধ করার ঢালাও সুযোগ সত্যিই হতাশাজনক। এটা সুনাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের সরকারি নির্দেশনা যা সংবিধানের (২০) অনুচ্ছেদকে লঙ্ঘন করে। তাই এ বাজেট জনবান্ধবব না হয়ে দুর্বৃত্তবান্ধব বটে। এটা সুশিক্ষা, নৈতিকতা ও মানব উন্নয়নেরও পরিপন্থি। তাই আমাদের আগামীর চরিত্রবান প্রজন্মের তাগিদে এই ভিনদেশী অর্থনৈতিক সংস্কৃতির ধারক অশুদ্ধ-পাপী নীতি এখনই পরিহার করা প্রয়োজন।

কালো টাকা মানুষ ও রাষ্ট্রের অশান্তির মূল কারণ-সেটা ঘরে হোক বা বাইরে হোক। অর্থনীতির ভাষায় যিনি যতই জোর গলায় কালো টাকা সাদা করার সাফাই গেয়ে যুক্তি দিন না কেন- গোয়ালা গাভির দুধ দোহনের সময় এক বালতি দুধে এক ফোঁটা প্রস্রাব যদি অসাবধানতাবশত: ছিটকে পড়ে তাহলে একজন পবিত্র মানুষ কি জেনেশুনে সেটা পান করতে চাইবেন?

এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার ঘোষণা দেশের বৈধ করদাতাকে আরও বেশি নিরুৎসাহিত করবে, সৎ মানুষের সাদা মনকে ভেঙে চুরমার করে দেবে ও সামাজিক ভাঙনকে আরও ত্বরান্বিত করে তুলবে। তাই অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে দেশের সব মানুষের শান্তি ও কল্যাণের জন্য আত্মিক ও নৈতিকতা জোরদার করণ কর্মসূচি নিয়ে আজকেই নতুন সৎ ভাবনা শুরু করা দরকার। সভ্যতার ডিজিটাল ও গতিশীল জাগরণের যুগে মানুষ আর জেনেশুনে পাপী হতে চায় না।

দেশে একশ্রেণির মানুষ অবৈধভাবে কর্মকানণ্ডের জোয়ারে জিইয়ে আছে ভয়ংকর মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, অনৈতিক লেন-দেনের সিস্টেমগুলো। তারা রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অন্যায়-অবিচার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষিত জিরো টলারেন্স কি তারা নিছক ভাঁওতাবজিতে পরিণত করে আরও বেশি পাপ করতে চায়? নাকি তারা বরেরও মাসি কনেরও পিসি? এসবের উত্তর দেবার সময় এখনই ।

ইসলাম ধর্মে কালো টাকা পাপের সঙ্গে তুলনীয় কারণ, এটা ইসলামের মৌলিক নীতির বিরুদ্ধে যায়। ইসলামে নৈতিকতা ও সততার গুরুত্ব অপরিসীম। কালো টাকার ব্যবহার ও উপার্জন অসততা ও নৈতিকতার অভাবের পরিচায়ক। কালো টাকার ব্যবহারে কোন জীবনেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত কর বৈধ উপায় নেই। এ টাকা দিয়ে দান ও যাকাত কার্যকর হয় না। ইহকাল বা পরকালে কালো টাকা ব্যবহারকারীদের জন্য তা শুধু ঘৃণা ও পাপ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।

যেমনটি আজকাল আমরা বিভিন্ন মেগা দুর্নীতিবাজদের কথা পত্রিকার শিরোনামে লক্ষ্য করে যাচ্ছি ও ঘৃণা করছি। কারণ, কালো টাকা হলো সেই অর্থ যা অবৈধভাবে উপার্জিত বা কর ফাঁকি দিয়ে জমা করা হয়েছে এবং সরকারি আর্থিক নীতিমালা লঙ্ঘন করে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সাধারণত বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম, যেমন দুর্নীতি, কর ফাঁকি, অবৈধ ব্যবসা, মাদক পাচার, সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং অন্যান্য অনৈতিক কাজের মাধ্যমে কালো টাকা অর্জিত হয়। কালো টাকা সব সমাজেই দুর্নীতির আঁতুড় ঘর।

কালো টাকা সাদা টাকা-তা বললেই মেনে নেওয়া উচিত নয়। আমরা সবাই পাপীকে ঘৃণা করছি, পাপকে ঘৃণা করছি না কেন? তাই একটি ন্যায়ানুগ সরকার ও দেশের সাদা মনের নিষ্পাপ মানুষদের উচিত কালো টাকা থেকে দূরে থাকা এবং এই টাকার ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। E-mail: [email protected]

;

বিদায় প্রজ্ঞা ও প্রগতির বরপুত্র



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
-প্রয়াত মেজর জেনারেল (অবঃ) আবদুর রশীদ

-প্রয়াত মেজর জেনারেল (অবঃ) আবদুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

৭০ বছরের এক বর্ণাঢ্য জীবন অতিবাহিত করে আজ ভোরে (১৪ জুন, ২০২৪) ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইহলোক ত্যাগ করে অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন বিশিষ্ট নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুর রশীদ। এই বহুল পরিচয়ের বাইরে ব্যক্তি মানুষ হিসাবে তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে মনে হয়েছে তিনি প্রজ্ঞা ও প্রগতির এক বরপুত্র। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন শেষে অধিকাংশ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের আর সেভাবে প্রকাশ্যে সমাজিক পরিমণ্ডলে দেখা যায় না। সেই বিচারে জেনারেল আবদুর রশীদ ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম এক ব্যক্তিত্ব। আমরা জানি পেশাগত জীবনে প্রশিক্ষণ ও কমাণ্ড পরিচালনাসহ সকল ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বড় হয়ে যে দিকটি ধরা দিয়েছে তা হচ্ছে পেশাগত জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতা সমাজ এবং রাষ্ট্রের কল্যাণে সার্থকভাবে সদ্ব্যবহার করতে পেরেছেন আবদুর রশীদ।   

সমরজ্ঞান ও সমাজ-রাষ্ট্র তথা বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিকে একজন আবদুর রশীদ এতটাই গভীরভাবে অনুসরণ করতেন যে বাংলাদেশের জাতীয় গণমাধ্যমসমূহ অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তাঁর বিশ্লেষণ শোনার জন্য উদগ্রিব থাকতো। মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের প্রশ্নে আপোষহীন সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তার বিশ্লেষণে যে অসাধারণ বাগ্মিতা প্রকাশ পেত তা সমকালীন বিশ্লেষকদের মাঝে বিরল। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর তুলনামুলক অধ্যয়ন এতটাই বিস্তৃত ও গভীর  ছিল যা তাকে বহু বক্তার মাঝে ভিন্ন পরিচয়ে দাড় করিয়ে দিত। সাত দশকের যাপিত জীবনে আবদুর রশীদ কেবল নিজেই সমুজ্জ্বল করেননি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবকেও বৃদ্ধি করেছেন।

পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে তাঁর পরিচয় বহু পূর্বেই পেয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবের মানুষটিকে জানার সুযোগ হয়েছে মাত্র ১ বছর ধরে। এই সময়কালে মাত্র ৩ বার জেনারেল আবদুর রশীদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ ঘটেছে। দু’বার তাঁর মিরপুর ডিওএইচএস এর বাসায় আর একবার আমার আমন্ত্রণে তিনি এসেছিলেন মৈত্রী দিবসের আলোচনায় বক্তা হয়ে। এছাড়াও অন্ততঃ ১০-১৫ বার তাঁর সঙ্গে ফোনালাম হয়েছে। এই সময়ে জেনারেল আবদুর রশীদের প্রতি যে গভীর সন্মোহন সৃষ্টি হয়েছে তাঁর নিঃসন্দেহে জীবনস্মৃতির এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।

‘মিয়ানমার বিষয়ে বাংলাদেশের দ্বিমুখী কূটনীতি গ্রহণ করা উচিত’

বিশেষ করে তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে আবদুর রশীদের  ব্যক্তিমানস সম্পর্কে যে মূল্যায়ন সৃষ্টি হয়েছে তা সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। যে দু’বার তাঁর বাসায় গিয়েছি-সেখানে পেশাগত আলোচনা ছাপিয়ে তা ক্রমেই দীর্ঘ আলাপচারিতায় পর্যবসিত হয়েছে। আধঘণ্টার নির্ধারিত সাক্ষাত সাড়ে ৩ ঘণ্টায় গড়িয়েছে। সেখানে আলোচনার মূল সুর ছিল মূখ্যত আদর্শিক সংহতির অনুরণন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতিশীলতা, বাংলাদেশ নিয়ে বহির্বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি-বার বার তাঁর আলোচনার কেন্দ্রে আবর্তিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন জেনারেল আবদুর রশীদ। পেন্টাগনের লব্ধ সেই অভিজ্ঞতা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাকর্তাদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি। সেকারণে আমরা দেখব, জেনারেল রশীদের আলোচনায় পরিমিতিবোধের কি চমৎকার পরিচয়!

সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি বর্বরতা, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ, রোহিঙ্গা সংকট, চীনের কৌশলগত অবস্থান, মিয়ানমারে ভারতের কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্ট কিংবা বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উত্থান নিয়ে তাঁর নির্মোহ মূল্যায়ন ছিল অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও তথ্যবহুল।  সংবাদকর্মীদের সঙ্গে প্রজ্ঞাবান এই মানুষটির ব্যক্তিগত আচরণে যে বিনয় ও আন্তরিকতা প্রকাশ পেত তা আমাদের আপ্লুত করতো। আজ যখন তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে বসেছি তখন বহু কথা স্মৃতিতে ভিড় করছে। সামরিক কর্মকর্তা হয়েও বাংলা ভাষার প্রমিত ব্যবহারে তাঁর অসাধারণত্ব সব সময়ই  মুগ্ধ করেছে। দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে গিয়ে সম্প্রতি তাঁকে শ্বাসকষ্টে ভুগতেও দেখেছি, চিকিৎসকেরও বারণ ছিল কিন্তু তবু তিনি বাকহীন হয়ে থাকতে পারতেন না। কথা বলা ও লেখাকে নিয়ে রাষ্ট্রের প্রতি তাঁর আমৃত্যু কর্তব্য হিসেবে মনে করতেন।  

বিদেশনির্ভরতা ও বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতি

আমাদের রাজনীতিবিদদের বিদেশমূখিতা নিয়ে সরব ছিলেন জেনারেল আবদুর রশীদ। তিনি মনে করতেন আমাদের রাজনীতিবিদদের দেশপ্রেম না থাকায় তাঁরা বিদেশিদের মুখাপেক্ষী হন কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক চক্রান্তে তাঁরা ঠিক ততোটাই পিছিয়ে। বার্তা২৪.কম-কে সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যা আছে, তাই আমাদের একটি দ্বিমুখি কূটনীতি গ্রহণ করা উচিত। একদিকে আরাকান আর্মির সঙ্গে প্রকাশ্যে বা গোপনে হোক সংযোগ তৈরি করা উচিত। আর স্বভাবতই মিয়ানমারের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে তো আমাদের কুটনীতি আছেই।’-রোহিঙ্গা সংকট যাদের কারণে তাদের কাছেই বাংলাদেশ সমাধান খুঁজছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন আবদুর রশীদ।  

সমকালীন ভূ-রাজনীতির বিস্তৃত প্রসঙ্গে আবদুর রশীদের যে গভীর বিশ্লেষণ তা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করতে দেখেছি আমরা। সমর-কুটনীতিতেও তিনি সাম্প্রতিক দশকে অনবদ্য অবদান রেখে গেছেন। বর্তমানে বিশ্বে যুদ্ধ-বিগ্রহের এই সময়ে তাঁর চলে যাওয়া রাষ্ট্রের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

আদর্শিক নৈকট্যের কারণে পেশাগত প্রয়োজনের বাইরেও জেনারেল আবদুর রশীদের অপত্য স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি। সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা ‍নিয়ে ফিরে আসার পর শেষবার যখন কথা হল তখনও বেশ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে আমাকে বলেছিলেন, তিনি আশা করছেন অচিরেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন। কথা দিয়েছিলেন আমার সাংগঠনিক অফিসে আসবেন, মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণও গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সেই ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে গেল।

পরিশেষে এটুকুই বলবার যে, একজন আবদুর রশীদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা রাষ্ট্রের সম্পদ ছিলেন। তাঁর প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম এবং প্রগতির প্রতি অন্তহীন নিষ্ঠা সত্যিই অতুলনীয়। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন ও আদর্শের জন্য বহুদিন তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। তাঁর পারলৌকিক জীবন শান্তির হোক, এই কামনা আমাদের।

;

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে দুই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা



এম. খালিদ মাহমুদ
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে দুই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে দুই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা

  • Font increase
  • Font Decrease

সরকার দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে অভূতপূর্ব ভূমিকা রেখে চলেছে। সড়ক নেটওয়ার্ক বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোডক্র্যাশ/ সড়ক দুর্ঘটনা। আর সেই সাথে বাড়ছে সড়কে হতাহতের সংখ্যা। দেশের সড়ক দুর্ঘটনার ৭০-৮০ শতাংশই ঘটে দ্রুত ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। অন্যদিকে মোটরসাইকেলের অনিয়ন্ত্রিত গতি প্রতিনিয়তই দেশের কর্মক্ষম তরুণসহ অনেকের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় কর্তৃক সম্প্রতি (৫ মে ২০২৪) জারি করা মোটরযানের ‘গতিসীমা নির্দেশিকা’ রোডক্র্যাশ ও প্রতিরোধযোগ্য অকালমৃত্যু কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। উল্লেখ্য, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ ও সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২-এ গতিসীমা মেনে গাড়ি চালানোর কথা বলা হলেও এই নির্দেশিকার মাধ্যমে দেশের জন্য প্রথমবারের মতো প্রতিটি সড়কে মোটরযানভিত্তিক সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারিত হলো।

একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, গত ৫ মে ২০২৪ সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ মোটরযানের ‘গতিসীমা নির্দেশিকা’ প্রণয়ণকালে গ্রামাঞ্চল ও শহরের জন ঘনত্বের মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েছে। রাস্তার ধরন ও প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন মোটরযানের গতি ভিন্ন ভিন্ন করা হয়েছে যা সড়ক নিরাপত্তার জন্য বৈশ্বিক মান অনুসরণে করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বিদেশের মতো বাংলাদেশের সড়কে পর্যাপ্ত লেন থাকলে গতিসীমা নির্দেশিকাটি বাস্তবায়ন করা সহজ হতো। আশার কথা, সরকার ধীরে ধীরে সকল মহাসড়ককে ছয় লেনে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তখন এ গতিসীমা নির্দেশিকাটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং রোডক্র্যাশ ও সড়কে অকাল মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। বিশেষত সড়কে নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ ঝুঁকিপূর্ণ পথচারীদের নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত হবে।

সাম্প্রতিককালে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, সড়কে ব্যাপক হারে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধি ও বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালনা, যাতে রোডক্র্যাশ/ সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদ্বেগের মাত্রাকে দ্বিগুণ করে দিচ্ছে অধিকাংশ মোটরসাইকেল আরোহীর মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার না করা। বিশেষত ঢাকার বাইরে মোটরসাইকেল আরোহীদের হেলমেট না পরার সংখ্যা আশংকাজনক। আশার কথা, গতিসীমা নির্দেশিকার পাশাপাশি সরকার ‘নো হেলমেট নো ফুয়েল’ নির্দেশিকাও জারি করেছে। এর ফলে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীগণ মানসম্মত হেলমেট পরার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত গতিতে মোটরসাইকেল চালাবেন বলে আশা করছি।

আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে সড়ক-মহাসড়কে গাড়ি ও মোটরসাইকেলের সংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধি পাবে। তাই এ সময়ে সড়কে দুর্ঘটনা/ রোডক্র্যাশ সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনতে জারিকৃত নির্দেশিকা দুটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত। এক্ষেত্রে বিআরটিএ ও পুলিশসহ সকল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান কঠোরভাবে ‘গতিসীমা নির্দেশিকা’ ও ‘নো হেলমেট নো ফুয়েল’ আদেশ দুটি বাস্তবায়ন করবে বলে আশা করছি।

নির্দেশিকা দুটি যথাযথ বাস্তবায়ন হলে সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি): ৩.৬ অর্জন তথা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে যাবে এবং বার্ষিক ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা (জিডিপি’র ২.০-২.৫%) অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারবে। পাশাপাশি সড়কে পূর্ণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সরকার অবিলম্বে বৈশ্বিক মান অনুযায়ী একটি ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করবে বলে আমরা আশাবাদী।

এম. খালিদ মাহমুদ, রোড সেফটি প্রোগ্রাম, ব্র্যাক।

;