একটি সরল নির্বাচনী বিশ্লেষণ



ফরিদুল আলম
ফরিদুল আলম, ছবি: বার্তা২৪.কম

ফরিদুল আলম, ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বলা যায় বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে রোববার। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অথচ সরকারি দল মনোনীত প্রার্থীদের একচেটিয়া প্রচারের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার প্রচারণা।। এই প্রচারণা চলাকালীন সময়ে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি সকলের দৃষ্টি কেড়েছে তা হচ্ছে মাঠের প্রচারে ব্যস্ত সময় ব্যয়ের চাইতে প্রধান বিরোধী পক্ষ ঐক্যফ্রন্টের নেতৃবর্গকে দফায় দফায় নির্বাচন কমিশনে গিয়ে নানা ধরণের অভিযোগ করতে, যার অনেকগুলোই ভিত্তিহীন বলে প্রমাণের পর সর্বশেষ ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের সাথে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) অনভিপ্রেত বাদানুবাদ ঘটে।

নির্বাচনের কাজে প্রসাসনের নানা স্তরের কর্মকর্তা এবং পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ড. কামাল হোসেনের অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দচয়ন কেবল নির্বাচন কমিশন নয়, সকলকেই বিস্মিত করেছে। ড. কামাল হোসেনের মত ব্যক্তি যখন তার জীবনের এই পর্যায়ে এসে এমন হতাশাজনক মন্তব্য করেন তখন সরকারি দলের বিকল্প শক্তি হিসেবে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থা আনতে কিছুটা ভাবনায় পড়তে হবে বৈকি।

ইতোমধ্যে মাঠে ময়দানের সর্বত্র একটি কথা ছড়িয়ে পড়েছে যে বিরোধী পক্ষের প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠে নামলেই হামলার শিকার হতে হচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করলেও বাস্তবিক অর্থে অপপ্রচার ভিন্ন কিছু নয়। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এই নির্বাচনী প্রচারের সময় ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ালেও কোথাও এমনটা প্রত্যক্ষ করিনি যে সরকারি দল মনোনীত প্রার্থীদের বিরোধী পক্ষ বিশেষতঃ ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীরা তাদের প্রচারে কোনো বাঁধার সম্মুখিন হয়েছেন। আমি বরং এই নির্বাচনকে ঘিরে তাদের প্রচারকার্যের নজিরবিহীন নীরবতা দেখে বিস্মিত এবং একই সাথে হতাশ হয়েছি।

একটি জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে আমরা সবসময় যে উৎসবের আবহ দেখে অভ্যস্ত ছিলাম, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপিসহ বেশ কিছু দলের নির্বাচন বর্জনের ফলে সেটি থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছিলাম। এবার যখন সকল দলের অংশগ্রহণ ঘটল, স্বাভাবিকভাবেই আমরা সেই উৎসবের আমেজটি আবার ফিরে পাব বলে প্রত্যাশা করেছিলাম। আমিই জানি না সত্যিকার অর্থে কোন কারণে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা এমন অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করল। তবে কিছুটা অনুমান করতে পেরেছি যে, নির্বাচনের সম্ভাব্য যে ফলাফলটা বর্তমানে আমাদের সকলের দৃষ্টির খুব কাছে সেটিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের একটা প্রক্রিয়া খুব নীরবে চলছে। আর এর সাথে যুক্ত হয়েছে দেশি-বিদেশী কিছু সংবাদমাধ্যম এবং গবেষণা সংস্থা।

গত ২৭ ডিসেম্বর লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্য গার্ডিয়ানের বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে করা এক প্রতিবেদনের শুরুতে বর্তমান সরকারের কিছু সাফল্যের বর্ণনা করা হলেও এই প্রতিবেদনে মূলতঃ বিরোধী নেতাকর্মীদের দমন এবং ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে সরকারকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এদিকে দেশের দুটি গবেষা সংস্থা বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিউট এবং অধিকার বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ধনী-দরিদ্র্যের মধ্যে প্রকট বৈষম্য এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে, যা গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনের সাথে অনেকটা সামঞ্জ্যস্যপূর্ণ।

এই দু’টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিশেষ কিছু না বলে শুধু এটাই বলব যে এদের পরিচালনার সাথে যারা সম্পর্কিত তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ঘেটে দেখলেই বিষয়টি সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। এদিকে নির্বাচনের ৪৮ ঘণ্টা আগ থেকে সকল ধরণের প্রচার-প্রচারণা বন্ধের বিষয়ে নির্দেশনা থাকলেও হঠাৎ করে নীরব থাকা বিরোধী প্রার্থীদের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের চরিত্রহননের মাধ্যমে নিজেদের পক্ষ্যে প্রচার চালানোর যে অভিনব কৌশল দেখা যাচ্ছে এ ধরণের বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণে এমনটা ধারনা করার সঙ্গত কারণ রয়েছে যে হয় ভোটারদের মধ্যে একধরণের ভীতি সৃষ্টি অথবা নানা ধরণের অপপ্রচারের মাধ্যমে নির্বাচনের পরিবেশকে নস্যাৎ করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা চলছে।

আমি ভেবে অবাক হচ্ছি যে, ২০১৪ সালে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার যে খেসারত বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দলকে দিতে হয়েছিল, এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সেটা কিছুটা পুষিয়ে নেবার ইচ্ছা এবং সে ধরণের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকলেও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই তারা এই নির্বাচনকে ঘিরে যেভাবে প্রতিনিয়ত তাদের নানা প্রকার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিচ্ছে সে জায়গা থেকে দেখলে তারা সত্যিকার অর্থে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইচ্ছায় এতে সামিল হয়েছে বলে মনে হয়না। এখানে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে তারা এই নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছে একটাই উদ্দেশ্যে যে এর মাধ্যমে সরকারকে কীভাবে বিপদে ফেলা যায়।

সম্প্রতি ফাঁস হওয়া বিএনপির কিছু নেতার টেলিসংলাপ পর্যালোচনা করলে সেটা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠে। গতকাল ফাঁস হওয়া ব্যারিস্টার মওদুদ এবং বরকত উল্লাহ বুলুর মধ্যে টেলিসংলাপ থেকে যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হচ্ছে নির্বাচন নিয়ে দলটির মহাসচিব এবং ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেনের কী পরিকল্পনা রয়েছে সে বিষয়ে তারা সন্দিহান অথচ তারা দাবী করছেন যে এই নির্বাচনে অংশ নেওয়া তাদের আন্দোলন কর্মসূচির অংশ হিসেবে দলীয় ফোরামের সিদ্ধান্ত ছিল। আবার এই সংলাপের একটি অংশে এমনটাও ধারণা পাওয়া যায় যে ব্যারিস্টার মওদুদের সঙ্গে লন্ডনে আত্মগোপনে থাকা তারেক রহমানের যে আলাপ হয় সেখানে তারেক রহমান এই নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়ার পক্ষে ছিলেন না।

আবার বিএনপির মধ্যে এই নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং না নেওয়ার বিষয়ে দু’টি মত ছিল বলে ধারণা পাওয়া যায় এমন আলাপ থেকে। এখানে স্বাভাবিকভাবেই একটি অংশ চাইছিল বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানের নিয়ন্ত্রণ থেকে দলটিকে একটি গণতান্ত্রিক ধারায় বের করে আনা, যে লক্ষে ড. কামাল হোসেনকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। আবার অপর অংশটি দলীয় বর্তমান নেতৃত্বের প্রতিই আস্থা রাখতে চাইছে। আর এই দুইয়ের সমন্বয়ের অভাব প্রকট পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যা টেলিসংলাপ থেকে ধারণা করা যায়।

কিছুদিন আগে বিএনপির অপর সিনিয়র নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সাথে পাকিস্তানের আইএসআই এর একজন শীর্ষ নেতার মধ্যে কথোপকথনে ড. মোশাররফকে আইএসআই এর উদ্দেশ্যে অনুরোধের সুরে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা খুব ঝামেলায় আছি, কিছু একটা করুন।’ এক পর্যায়ে বর্তমান সরকারকে চীনের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করতে অনুরোধ করতে শোনা যায়।

এদিকে ঐক্যফ্রন্ট শীর্ষ নেতা ড. কামাল সংবাদ মাধ্যমে দাবী করছেন যে বিএনপি তদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং জামায়াতে ইসলামের ২২ জন প্রার্থী ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন জানলে তিনি ঐক্যফ্রন্টের সাথে থাকতেন না এবং সরকার গঠনে জামায়াতের প্রতিনিধিদের নেওয়া হলে তিনি ভবিষ্যতের সেই সরকারে থাকবেন না। এর মধ্য দিয়ে তিনি জাতির কাছে কি বার্তা দিতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট না হলেও মনে করা যায় যে তিনি হয়ত ভাবছেন তার এই মন্তব্যে ভোটাররা সরল মনে ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।

আসলে ঐক্যফ্রন্ট কি চাইছে তা হয়ত তারা নিজেরাও জানেন না। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে এক পা এগিয়ে আবার দুই পা পিছিয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে তারা যাই হাসিল করতে চাননা কেন এর মধ্য গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ রয়েছে। তবে তাদের দুর্ভাগ্য যে তাদের সমস্ত কৃতকর্ম সহসাই ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তারা আসলে ভীষণ বেকায়দায় রয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে পা ফেলতে হবে গভীর সতর্কতার সঙ্গে। আমরা ইতোমধ্যে খেয়াল করেছি যে, নির্বাচনের মাঠে বিএনপির আত্মঘাতী সিদ্ধান্তগুলোকে পুঁজি করে কিছু সরকারী সংস্থার সরকারের প্রতি অতি মনোযোগী হয়ে নির্বাচনের ফলাফল অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের অবদানকে বড় করে দেখানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যার কোনো প্রয়োজন নেই। এধরণের অযাচিত কর্মকাণ্ডের প্রশ্রয়দান একটি স্বচ্ছ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে বিতর্কিত করে তুলতে পারে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত সকলের কাছে কেবল এই বার্তাই পৌঁছে যাক যে একটি সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তাদের যা করণীয় তারা যেন কেবল সেটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

   

ঈদের বদলে যাওয়া



মযহারুল ইসলাম বাবলা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

কালের বিবর্তনে কেবল ঈদই বদলে যায় নি। বদলেছে সমাজ, পরিবার, ব্যক্তি, পরিবেশ-প্রকৃতি, সামষ্টিক জীবনাচার হতে সমস্তই। একমাত্র ব্যতিক্রম রাষ্ট্র, শাসন ব্যবস্থা, শাসক চরিত্র। সেটি উপনিবেশিক আমলের ধারাবাহিকতায় আজও অনড় অবস্থানে। আমাদের সমাজজীবনে ঈদের এই বদলে যাওয়ার পেছনে সঙ্গত কারণ অবশ্যই রয়েছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার চরম প্রভাবে সামষ্টিক চেতনা-দৃষ্টিভঙ্গি বিলুপ্তির পথ ধরেই ঈদের এই বদলে যাওয়া। আমাদের সমাজ-জীবনে ধর্মীয় এবং জাতিগত উৎসব-পার্বণসমূহও আর পূর্বের ন্যায় নেই। কালের পরিক্রমায় সেগুলোর আচার-আনুষ্ঠানিকতাও বদলে গেছে। অতীতে দেখা ঈদের সঙ্গে এখনকার ঈদের বিস্তর ব্যবধান। একশত আশি ডিগ্রি বৈপরীত্য বললেও ভুল হবে না। ঈদের সামাজিকতার যে চিরচেনা ছবিটি আমাদের মনোজগতে স্থায়ীরূপে ছিল, বর্তমানের ঈদের সঙ্গে তা মেলানো যায় না। অতীতের ঈদের স্মৃতিকাতরতায় সংক্ষিপ্তভাবে তার চিত্র তুলে ধরবো। অনেকের কাছে এখনকার বাস্তবতায় সেটা রূপকথার ন্যায় মনে হতে পারে।

ঈদ উৎসবের প্রধান উপাদানটি সামাজিকতা। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পারস্পরিক সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যরে নির্মল প্রতীক। ঈদকে কেন্দ্র করে নজরকাড়া বৈষম্য আমরা এখন প্রবলভাবে প্রত্যক্ষ করি। অতিমাত্রায় ভোগ-বিলাসে মত্ত হবার প্রবণতাও দেখে থাকি; অতীতেও ছিল, তবে এরূপ মাত্রাতিরিক্ত ছিল না। ঈদের আনন্দ সবাই মিলে ভাগ-বাঁটোয়ারায় পালনের সংস্কৃতি ছিল। সেটি কালের গর্ভে এখন বিলীন হয়েছে। একটি শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শ্রেণিগত ব্যবধান-বৈষম্য অতীতেও ছিল। কিন্তু এত অধিক মাত্রায় প্রকটভাবে ছিল না। আমরা ক্রমেই যে ব্যবস্থার অধীন হয়ে পড়েছি, সেটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। এখানে পুঁজিই সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রকের চালিকা শক্তিরূপে রাষ্ট্রে-সমাজে, এমন কি পরিবারের অভ্যন্তরে পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। মানুষে মানুষে যে সহজাত সম্প্রীতির বন্ধনগুলো ছিল সেগুলো ছিন্ন এবং লুপ্ত হবার পথ ধরেছে। অথচ ঈদ উৎসবের প্রধান উপাদানটি সম্প্রীতির নির্মল সামাজিকতা। অতীত আর বর্তমানের ঈদের প্রধান পার্থক্য এখানেই। অতীতে সমষ্টিগতভাবে উৎসব পালনের রীতি-রেওয়াজ ছিল।

পারিবারিক এবং সামাজিক বাধ্যবাধকতাও এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করতো। এখন সেসবের বালাই নেই। এখন প্রত্যেকে যার-যার, তার-তার। অর্থাৎ ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার অদৃশ্য জালে সামাজিক চেতনা আটকে পড়েছে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় সেই জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসার উপায়-সম্ভাবনা নেই। এই জাল অর্থাৎ মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা পুঁজিবাদের মৌলিক দর্শনের অন্তর্গত। ব্যবস্থা না পাল্টানো অবধি ঐ জালে আমরা আরো বেশি জড়িয়ে পড়বো। পরষ্পর পরষ্পর থেকে আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো। তাই সর্বাগ্রে জরুরি ব্যবস্থার পরিবর্তন। সেটা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের জীবনে সমষ্টিগত বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটবে না। বরং উত্তরোত্তর সেটা বৃদ্ধি পাবে।

পূর্বেকার ঈদ কেমন ছিল? সেকালের ঈদের প্রধান উপাদানটিই ছিল সামষ্টিক সামাজিকতা। ঈদ মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ঈদে ধর্মীয় আচার বলতে দুই রাকাত ওয়াজেব নামাজ আদায় ব্যতীত আর কোনো ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নেই। ওয়াজেব নামাজ ফরজ নয়। ফরজ আদায়ের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা থাকে। ওয়াজেব-এর ক্ষেত্রে সেটি নেই। সকল সম্প্রদায়েরই ধর্মীয় উৎসব-পার্বণ রয়েছে। সে সকল উৎসবসমূহে ধর্মীয় আচারের তুলনায় উৎসবের আনুষ্ঠানিকতাই সর্বাধিক। উৎসবসমূহকে সম্প্রদায়গত সীমা অনায়াসে অতিক্রম করার বিস্তর সুযোগ রয়েছে। আমাদের ভূখ-ে এক সময়ে ধর্মীয় উৎসবে অন্য সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণের অজস্র নজির ছিল। ঈদ, পূজা, বড়দিনে বন্ধু, প্রতিবেশী হতে সামাজিক সম্পর্ক-সম্প্রীতিতে একে-অন্যের ধর্মীয় উৎসবে আমন্ত্রিত হত। যাওয়া-আসা, শুভেচ্ছা বিনিময় করতো। সম্প্রদায়গত ভিন্নতার পরও পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সামাজিকতার সংস্কৃতি ছিল। রক্তাক্ত দেশভাগে সেই সম্পর্কের বিনাশ ঘটে। আজাদ পাকিস্তানে ধর্মীয় জাতীয়তার চরম মাশুলের মুখে আবার জাগরণ ঘটে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার। সেই সুবাধে জাতিগত ঐক্য-সংহতির দুয়ার উন্মুক্ত হয়।

পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙ্গে নতুন রাষ্ট্র গঠনের পর এই বাংলাদেশে আবার সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দেবে; সেটা ছিল কল্পনার অতীত। সামরিক শাসকদের বদৌলতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দুয়ার উন্মোচনের পথ ধরে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাড়-বাড়ন্ত বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভবিতব্য এই যে, বেসামরিক তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনামলেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ঘটেনি। ভোটের রাজনীতির নিয়ামক শক্তিরূপে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সুরক্ষা ও বিকাশে যুক্ত দেশের এযাবৎ কালের প্রতিটি ক্ষমতাসীন সরকার। তুলনা বিচারে কম-বেশি হতে পারে কিন্তু ঐ ঘৃণিত পথটি কেউ পরিহার করে নি। উন্মুক্ত রেখেছে স্বীয় স্বার্থে।

কৈশোরে দেখেছি মাসব্যাপী রোজার শেষে ঈদের চাঁদ দেখতে মানুষ বাড়ির ছাদে, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ভীড় করতো। চাঁদ দেখামাত্র শুরু হয়ে যেত আনন্দের উল্লাস প্রকাশ। পটকা, বাজি ফুটিয়ে আগত ঈদের আনন্দ প্রকাশ করা ছিল গতানুগতিক। মসজিদে-মসজিদে সাইরেন বাজিয়ে আগামীকালের ঈদের সংবাদ প্রচার করত। মসজিদ সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তি অলিতে-গলিতে ঢুকে ঈদের নামাজের সময়সূচী চিৎকার করে বলে যেত। রেডিও-তে বেজে উঠতো কাজী নজরুল ইসলামের গান-রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদসহ বিভিন্ন ঈদকেন্দ্রিক গান। আজকে যেটা পুরান ঢাকা নামে খ্যাত। ঢাকা বলতে তখন ছিল এই পুরান ঢাকা’ই। নতুন ঢাকার গোড়াপত্তন শুরু হয়েছে। তবে তেমন জনবহুল হয়ে ওঠেনি। এই পুরান ঢাকার ঈদের সামাজিকতা একমাত্র গ্রামের সামাজিকতার সঙ্গেই তুলনা চলে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের দুঃখে-সুখে নিকট আত্মীয়ের ন্যায় সংলগ্ন হবার সামাজিক সংস্কৃতি ছিল। যেটি এখনও পুরোপুরি হারিয়ে যায় নি। তবে স্বীকার করতে হবে কমেছে।

ঈদের আগের দিনকে চাঁনরাত বলার রেওয়াজ ছিল। চাঁনরাতে পুরান ঢাকার যুবকেরা মাসব্যাপী রোজার সংযমের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে মদ্যপানে মাতলামিতে মত্ত হত। তাদের মাতলামিতে রাস্তা-সড়কে, বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী সিঁড়ি ঘাটের পরিবেশ ভয়ঙ্কর হত। রাতে তারা এদিক-সেদিক পড়ে থাকতো। কাকভোরে বাড়ি ফিরে গা-গোসল করে নতুন জামা-কাপড় গায়ে চড়িয়ে ঈদের নামাজে শামিল হত। মেয়েরা মেহেদী লাগাতো গভীর রাত অবধি। কম-বেশি প্রায় সকলের বাড়িতে মেহেদী গাছ ছিল। বাজার থেকে মেহেদী কিনে পাটায় বেঁটে মেহেদী লাগানোর সংখ্যা ছিল খুবই স্বল্প। ঘরে ঘরে শুরু হয়ে যেতো ঈদের বিশেষ রান্নার আয়োজন। এখনকার ন্যায় তিন-চার দফায় ঈদের জামাতের নজির ছিল না। মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার আধিক্য তখন ঘটেনি। একবারই ঈদের নামাজ হত মসজিদে।

নামাজ শেষে গণকোলাকুলি-শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে বাড়ি ফিরতে দীর্ঘক্ষণ অতিবাহিত হত। সবার সঙ্গে সবার আত্যন্তিক যোগসূত্রতা ছিল। ঈদের দিনে সেটা রক্ষা না করা ছিল অপরাধতুল্য। আমরা যারা কিশোর বয়সী ছিলাম। আমরাও পাড়া-মহল্লার সহপাঠিদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে অনেক সময় পরে বাড়ি ফিরতাম। গুরুজনদের সালাম করে সেলামি না পাওয়া পর্যন্ত নড়তাম না। বাড়ির আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ছুটতাম আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশীদের বাড়ির অভিমুখে। সালাম করা এবং সেলামি আদায়ই ছিল মূল লক্ষ্য। পাশাপাশি ছিল সামাজিকতার দায়ভার। কারো বাড়িতে ঈদের দিন না গেলে তীব্র কটু কথা শুনতে হত। সবার বাড়িতে সবার যাওয়ার সামাজিক রেওয়াজ পালন করা ছিল বাধ্যবাধকতার অন্তর্গত।

সড়কের পাশে হরেক খাবারের দোকানে নানা পদের আকর্ষণীয় খাবার কিনে খাওয়ার প্রবণতা কিশোরদের মধ্যে দেখা যেত। সেলামির কাঁচা পয়সা ঝনঝন করতো সবার পকেটে। চারআনা-আটআনায় তখন প্রচুর চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল। সহপাঠি বন্ধুরা এমন কি হিন্দু সম্প্রদায়ের বন্ধুরা পর্যন্ত দল বেঁধে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে চকবাজারের ঈদের মেলা দেখা, মেলার সামগ্রী কেনা, দূরে বসবাসরত আত্মীয়-পরিজনদের বাড়িতে যাওয়া-সেলামি সংগ্রহ এসব ছিল ঈদের দিনের গতানুগতিক বিষয়। দলভুক্তদের যে-কোন একজনের আত্মীয় বাড়িতে গেলে সবাই সমান সমাদর-সেলামি পেতাম। খাবারের জন্য জোর তাগিদ উপেক্ষা করতাম সময় ক্ষেপণের ভয়ে। দিনটি গত হলে তো সব সুযোগই হাতছাড়া হয়ে যাবে।

সব আত্মীয়দের বাড়িতে যাবার আনুষ্ঠানিকতায় বহুক্ষণ পেরিয়ে যাবে, সেই শঙ্কায় সালাম শেষে সেলামি নিয়েই এক প্রকার ছুটে অপেক্ষমান ঘোড়ার গাড়িতে উঠে পড়তাম। বিকেলের দিকে বর্তমানের সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে ঢাকার চিড়িয়াখানায় যেতাম। বর্তমানে যেখানে জাতীয় ঈদগা সেখানে ছিল ঢাকার চিড়িয়াখানা। সন্ধ্যে নাগাদ বাড়ি ফিরে আসতাম। পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্র চালু হবার পর স্থানীয় অনেকের বাড়িতে টিভি ছিল, তাদের বাড়িতে টিভি দেখতে যেত সবাই। উঠানে টেবিলে এনে টিভি বসিয়ে সবার জন্য টিভি দেখার ব্যবস্থা করত। ছোটরা মাদুরে এবং বড়রা চেয়ারে বসে অনেক রাত অবধি একত্রে টিভির অনুষ্ঠান দেখতো সবাই।

স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়েরা দল বেঁধে পাড়ার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করত। বান্ধবীদের সবার বাড়িতে সবাই যাওয়া-আসা করতো। অতিথি আপ্যায়নের জন্য সেমাই-পায়েস ইত্যাদি মিষ্টি জাতীয় খাবার ঘরে-ঘরে তৈরি করা থাকতো। কেনা সেমাইর প্রচলন ছিল না। হাতে ঘুরানো কলে ঈদের আগে বাড়িতে-বাড়িতে সেমাই তৈরি করতো। রোদে শুকিয়ে হালকা আঁচে ভেজে তুলে রাখতো ঈদের অপেক্ষায়। সবার বাড়িতে অভিন্ন প্রচলন। মহিলারাও বিকেলে আত্মীয়-প্রতিবেশীদের বাড়িতে শুভেচ্ছা বিনিময়ে যাওয়া-আসা করত। প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়িতে ঈদের দিন যাওয়া ছিল ঈদের অনিবার্য সামাজিকতা।

ঈদে কে কত দামি জামা কিনেছে সেসব নিয়ে তেমন কারো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল না। নতুন জামা-জুতা হলেই বর্তে যেতাম। বাহারি চটকদার পোশাকেরও তেমন প্রচলন ছিল না। ব্যতিক্রম যে ছিল না, তা নয়। তবে সংখ্যায় অতি নগণ্য। স্থানীয় যুবকদের ঈদের আনন্দ ছিল ভিন্নতর। সড়কে-বুড়িগঙ্গার পাকা সিঁড়ি ঘাটে মাইক বাজিয়ে আনন্দ করতো। সিঁড়ি ঘাটে যত্রতত্র তাস খেলতো। দল বেঁধে রূপমহল, তাজমহল, মুকুল (আজাদ), মানসী (নিশাত), শাবিস্তান, লায়ন, স্টার, মুন বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে ছুটতো ঈদে মুক্তি পাওয়া লাহোরে নির্মিত উর্দু ছবি দেখতে। স্থানীয় যুবকদের নিকট সাবিহা-সন্তোষ, মোহাম্মদ আলী-জেবা,ওয়াহিদ মুরাদ-রানী প্রমুখ পাকিস্তানি তারকারা ছিল জনপ্রিয়। এসবের বাইরেও তাদের পরস্পরের ঈদের সামাজিকতা ছিল। দূর-দূরান্তের বন্ধুরা ছুটে আসতো। আবার এখান থেকেও অনেকে দলবদ্ধভাবে যেত বন্ধুদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে।

ঈদের দিন উৎসব মুখর আনন্দ সর্বত্র বিরাজ করতো। হরেক প্রকারের আনন্দে মেতে থাকতো সবাই। ছাদে কিংবা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ঘুড়ি উড়ানোও ছিল ঈদের আনন্দের অংশ। বিভিন্ন রঙের ঘুড়িতে আকাশ ছেয়ে যেত। সম্প্রদায়গত ভিন্নতা এদিনে ম্লান হয়ে যেত। অনেক হিন্দু বন্ধুরাও আমাদের দলভুক্ত হয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতো। ঈদে ধর্মীয় আবেদনের চেয়ে সামাজিক আবেদন অধিক। পাকিস্তানি রাষ্ট্রে তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ক্রমেই বিকশিত হচ্ছিল। সে কারণে ধর্মীয় জাতীয়তা বাঙালিরা প্রায় পরিত্যাগে দ্বিধাহীন হয়ে উঠেছিল। এসকল কারণে ঈদ উৎসবে অসাম্প্রদায়িকতা বিকাশ লাভ করছিল। স্থানীয় যুবকদের নিকট যেমন লাহোরের ছবি জনপ্রিয় ছিল। পাশাপাশি তরুণ ও মাঝ বয়সী নারী-পুরুষদের নিকট ঢাকায় নির্মিত বাংলা ছবি অধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে পরিবারসহ বাংলা ছবি দেখার প্রবণতায় বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল। প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখার মধ্যেও এক ধরনের সামষ্টিক সামাজিকতা ছিল। যেটি এখন আর পাওয়া সম্ভব নয়।

একালের ঈদ মানেই বিলাস এবং ভোগবাদিতায় পূর্ণ। কে-কত মূল্যের কতটা এবং কোন বিখ্যাত শপিং মল থেকে ঈদের পোশাক কিনেছে, এনিয়ে গর্বে মশগুল থাকা। আর ঈদে সামষ্টিক সামাজিকতা বলে এখন আর অবশিষ্ট কিছু নেই। সময়টা এখন যার-যার, তার-তার বলেই সঙ্গত কারণে সবাই ঘরে ঘরে অনেকটা বন্দীদশায় ঈদ পালন করে। একের পর এক পোশাক বদল করে, নিজের পোশাক নিজেই দেখে। অন্য কেউ দেখে প্রশংসা করলে নিশ্চয় গর্বিত ও খুশির সুযোগ হত। কিন্তু কার পোশাক কে দেখে। যার যারটা নিয়ে সবাই ব্যস্ত। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে আত্মীয়-পরিজনদের বাড়িতে এখন আর কেউ যাওয়া-আসা করে না। বড় জোর মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠিয়ে সেই দায় থেকে পরিত্রাণ নেয়। মোবাইল-ফেইসবুক নামক প্রযুক্তির আগমনে দৈহিক যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে। অপর দিকে প্রযুক্তিগত বার্তা বিনিময়কে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম রূপে প্রচারণা করা হয়ে থাকে। বিষয়টি হাস্যকর রূপেই বিবেচনা করা যায়।

ঈদের নামাজ এখন মসজিদে-ঈদগাগুলোতে তিন-চার দফায় আদায় হয়ে থাকে। সকল টিভি মিডিয়াতে দেশব্যাপী ঈদের কয়েক দফা নামাজের সময়সূচী ও স্থানসমূহের নাম ঘন ঘন সম্প্রচারিত হয়। ঈদের দিন বেশিরভাগ মানুষই ঘরে বসে-টিভি দেখে ঈদ পালন করে। নিকট আত্মীয়দের বাড়িতে পর্যন্ত অনেকের যাওয়া-আসা নেই। একান্ত পারিবারিক সীমায় প্রায় প্রত্যেকে সীমাবদ্ধ। একই ভবনের পাশাপাশি ফ্ল্যাটে বসবাস অথচ কারো সাথে কারো সম্পর্ক-যোগাযোগ কিছুই নেই। অপরিচিতমাত্রই অবাঞ্ছিত বলে জ্ঞান করে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতার এই যুগে সামষ্টিক সামাজিকতার দৃশ্যমান কিছু নেই। ঈদকে কেন্দ্র করে সুপার মলগুলোতে যেরূপ রমরমা বেচা-বিক্রি, জনসমাগম ঘটে, ঈদের দিন তার প্রতিফলন আমরা দেখি না। বোকা বাক্স নামক টিভি মানুষকে গৃহে আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছে; মানুষ স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্নতাকে বরণ করার কারণেই।

ঈদে গ্রামে যাওয়া মানুষের পরিমাণ কিন্তু কম নয়। বাস, ট্রেন, লঞ্চে চেপে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রচুর মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটে যায়। সেটা ঐ সামষ্টিক সামাজিকতার টানে। গ্রামে এখনও সামাজিকতা বিলীন হয়ে যায়নি। ঈদে গ্রামে যাওয়া মানুষের সিংহভাগই হচ্ছে স্বল্প আয়ের নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি ক্ষুদ্র অংশও ঈদে গ্রামে যায়। আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপনে। তবে সংখ্যায় স্বল্পই বলা যাবে। বিত্তবান শ্রেণি আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে এমন কি দেশত্যাগে বিদেশে পর্যন্ত ঈদ উদ্যাপন করে। আমাদের বিত্তবান শ্রেণির মধ্যে এধরনের প্রবণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। অনেকে ঈদের কেনাকাটার জন্য ছুটে যায় বিদেশে।

লাগেজ বোঝাই করে ঈদের বাজার নিয়ে দেশে ফিরে আসে এবং গর্বে-গৌরবে সে কথা প্রচার করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। ঈদে বৈষম্য পূর্বেও ছিল। আজও আছে। তবে মাত্রাটা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একে অপরের বাড়িতে ঈদ উপলক্ষে যাওয়া আসায় প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়ির খাবারের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ পেতো। এখন সেটা তিরোহিত। সবার বাড়ির রান্না করা ঈদের খাবারও এক নয়, ভিন্নতর। এটা নির্ভর করে ব্যক্তির শ্রেণিগত অবস্থানের ওপর। শ্রেণি পার্থক্যে বর্তমান সময়ে সমশ্রেণির বাইরে কেউ কারো নয়। শ্রেণি সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক টিকে থাকা-না থাকা নির্ভর করে। এখনকার ঈদে শহরে উৎসব-আনন্দ চোখে পড়ে না।

স্বল্প আয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাবার কারণে ঈদের পূর্ব হতে পরবর্তী চার-পাঁচ দিন শহর ফাঁকা হয়ে যায়। গ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ততা শহরের আশিভাগ মানুষের অথচ বিত্তবান শ্রেণি গ্রামচ্যুত। পরিজন-সমাজ এবং সামষ্টিক সামাজিকতা বিচ্যুত। তারা যে গ্রাম থেকে এসেছে সে কথাও তাদের বোধকরি স্মরণে নেই। শ্রেণি উত্তোরণে অতীতের আত্মীয়-পরিজন, সামাজিকতা কেবল ভুলেই যায় নি। সচেতনভাবে পরিত্যাগ করে সমশ্রেণির মধ্যে বিলীন হয়ে পড়েছে। এই সকল বিচ্ছিন্নতাকে অতিক্রম করার ক্ষেত্রে ঈদ একটি সম্ভাবনাময় উপলক্ষ। যেটা নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষেত্রে আমরা দেখে থাকি। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের ক্ষেত্রে সেটা অবান্তররূপেই গণ্য করা যায়।

ঈদ নিশ্চয়ই আনন্দের উৎসব। কিন্তু বর্তমানে ঈদে আমরা কিন্তু সমাজ জীবনে সর্বাধিক বৈষম্য দেখে থাকি। সমাজের সুবিধাভোগী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সুবিধাবঞ্চিতদের ক্ষেত্রে তীব্র বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। এক কাতারে নামাজ আদায় করলেও সকলের পরিধেয় বস্ত্র এক তো নয়-ই, ভয়ানক মাত্রায় বৈষম্যপূর্ণ। কতিপয়ের বিত্ত-বৈভবে ভোগ-বিলাসিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের পোশাকে-আচরণে, খাওয়া-খাদ্যে ইত্যাদিতে।

আমাদের সমাজে ধনী-দরিদ্রের অর্থনৈতিক বৈষম্য আকাশপাতাল ব্যবধানসম। রোজার মাসে ধর্মীয় অনুশাসনে যাকাত প্রদানের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। অবশ্য যাকাত প্রদানের বিষয়টি সমাজে বৈষম্যকেই স্থায়ী করেছে। ধনীরা যাকাত দেবে আর দরিদ্ররা হাত পেতে নেবে। যাকাত আদান-প্রদানের ব্যবস্থাটি সমাজের শ্রেণি বৈষম্যকেই সু-নিশ্চিত করেছে। বিভিন্ন বস্ত্রের দোকানে ব্যানার টাঙিয়ে যাকাতের কাপড় (শাড়ি-লুঙ্গি ইত্যাদি) বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখা যায়। যাকাতের কাপড় মাত্রই অত্যন্ত নিম্নমানের এবং স্বল্পমূল্যের। সকল দোকানি ঐ স্বল্প মূল্যের এবং অতি নিম্নমানের যাকাতের বস্ত্র বিক্রি করে না। যে সমস্ত দোকানে তা বিক্রি হয়, সে সকল দোকানে বিজ্ঞাপন প্রচারের আবশ্যিকতার প্রয়োজন হয়।

সমাজের বিত্তশালী অংশ যাকাতের বস্ত্র বিলি বণ্টনে নিজেদের দাতারূপে জাহির করতে যে পন্থাটি অবলম্বন করে থাকে; এতে অসহায় মানুষের পদদলিত হয়ে মৃত্যুর প্রচুর ঘটনাও ঘটে থাকে। ঈদ নিশ্চয় আনন্দ-উৎসব। তবে সবার জন্য নয়। ঈদে নজরকাড়া বৈষম্য অত্যন্ত তীব্ররূপে দেখা যায়। রোজা-ঈদ যেন বিত্তবানদের আহার-ভোজন এবং সীমাহীন ভোগ বিলাসিতা মেটাতেই আসে। খাদ্য-দ্রব্য পণ্যের বাজার অধিক মাত্রায় চড়া হবার কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠদের নাকাল হতে হয়। ঈদের আনন্দের বার্তা সকলের জন্য সমানভাবে আসে না। আসা সম্ভবও নয়। বিদ্যমান বৈষম্যপূর্ণ সমাজে সেটা আশা করাও মূর্খতা।

সকল উৎসব-পার্বণে দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক, উৎসবকে অসাম্প্রদায়িক রূপে গড়ে তোলা। দুই, সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন করা। এই দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমাধান সম্ভব হলেই ঈদসহ সকল উৎসব-পার্বণ সর্বজনীন হবে এবং পরিপূর্ণরূপে সকলের জন্য উৎসবের আনন্দ নিশ্চিত করতে পারবে। নয়তো ঈদ আসবে-যাবে, কেউ কেউ ভোগবাদিতায় ভাসবে আর সংখ্যাগরিষ্ঠরা চেয়ে চেয়ে কেবল দেখবে। উপভোগে বঞ্চিত হবে। সেক্ষেত্রে ঈদ-পার্বণের আবেদনও পূর্ণতা পাবে না।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

;

পদোন্নতি-পদাবনতি: কেমন প্রভাব ফেলবে বিএনপিতে?



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
বিএনপি লোগো

বিএনপি লোগো

  • Font increase
  • Font Decrease

সরকারবিরোধী আন্দোলনে পিছু হটা বিএনপি এবার সংগঠনকে গতিশীল করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে বিএনপি ছাত্রদলের আট মহানগর কমিটিসহ জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার মতো আলঙ্কারিক পদও আছে এখানে। নতুন কমিটি দিয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলে। হঠাৎ দলে বড় ধরনের এই পরিবর্তনের কারণ, বিগত আন্দোলনে নেতাদের ভূমিকা, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয়তা।

বিএনপির নতুন এই সাংগঠনিক তৎপরতায় যেমন কমিটি ভেঙে দেওয়া, নতুন কমিটি দেওয়া যেমন আছে, তেমনি আছে নেতাদের পদোন্নতি ও পদাবনতি। এই পদাবনতি এবং কমিটি ভেঙে দেওয়া আন্দোলনে ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে, তবে পদোন্নতি ঠিক কীসের কারণে—এনিয়ে প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক। কারণ যে আন্দোলন ব্যর্থ, সেখান থেকে কারো পদোন্নতির সুযোগ ছিল না। দলের ব্যর্থতায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাফল্য খোঁজার কিছু থাকে না। এখানে সংগঠনের চাইতে ব্যক্তিকে প্রাধান্য সাংগঠনিকভাবে হওয়ার কথা না, তবু সেটাই করেছে বিএনপি। বিএনপি এখানে কি কাউকে পদ দিয়ে খুশি করে তবেই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে চাইছে?

বছরাধিক সময়ের ধারাবাহিক আন্দোলনের একটা পর্যায়ে দেশি-বিদেশি চাপ যখন সরকারের ওপর রাখতে সক্ষম হয়েছিল বিএনপি, তখন গত বছরের অক্টোবরে মাঠের আন্দোলন জোরদার করার নামে আদতে তাদের পিছুটান শুরু হয়। ২৮ অক্টোবরের বহুল আলোচিত সমাবেশ থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন নতুন গতি সঞ্চারের আশা দলটির কর্মীসমর্থকদের থাকলেও নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং আন্দোলনে অনভিজ্ঞতায় তাদের পিছু হটতে হয়। কর্মীসমর্থকদের অতি-উৎসাহসঞ্জাত বাড়াবাড়ি, আগুন, পুলিশে ওপর হামলা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় আশাবাদের বেলুন চুপসে যায়। বড় ধরনের জনসমাগম ঘটিয়েও রাজপথ ছাড়তে হয় তাদের। এরপর কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর সরকারের দমননীতি, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের কারাগমনে আন্দোলন শেষ হয়ে যায়। এরপর হরতাল-অবরোধ দিয়ে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিএনপি যে আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিল সেটা ছিল কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। সাধারণ নাগরিকদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে যেমন পারেনি তারা, তেমনি পারেনি নেতাকর্মীদেরও আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে।

আন্দোলনে ব্যর্থতার দায় এতদিন বিএনপি কেবলই সরকারের দমননীতিকে উল্লেখ করে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। এটা যে ছিল তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য, তা এবারের দলের ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আদতে স্বীকার করে নিয়েছে। এই স্বীকারে অবশ্য তাদের রাজনৈতিক পরাজয় নেই, আছে আত্মোপলব্ধির চেষ্টা। তবে কথা থাকে, পুনর্গঠন প্রক্রিয়া যদি হয় আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতাকে কেন্দ্র করে, সেখানে কীভাবে দলের কিছু নেতার পদোন্নতি হয়? পদোন্নতি পাওয়া এত নেতা আন্দোলনে কী ভূমিকা রেখেছিলেন? স্থানীয়ভাবে হয়ত চেষ্টা থাকতে পারে তাদের, তবে দল যখন সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ, সেখানে আলাদাভাবে ‘পরাজিত সৈনিকদের’ মূল্যায়ন করা কতখানি যৌক্তিক?

আন্দোলনে ব্যর্থ বলে বিএনপির কেউ পদোন্নতি পাবেন না, এমন বলছি না; তবে তাদের মূল্যায়ন হতে পারে যথাযথ প্রক্রিয়ায়। রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি বণ্টনের যৌক্তিক জায়গা হচ্ছে কাউন্সিল, স্রেফ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এখানে কাউকে পদপদবি দিলে এটা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। বিএনপির যখন বলছে, তারা দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফেরাতে আন্দোলন করছে, তখন নিজ দলের মধ্যে এ কেমন গণতন্ত্র চর্চা তাদের? রাজনৈতিক দলে করপোরেট সংস্কৃতি চর্চা কি শোভন?  

বিএনপির বর্তমান কমিটির বয়স ৮ বছরের বেশি। ২০১৬ সালের মার্চে সবশেষ কাউন্সিল করেছিল দলটি। এই কমিটি থাকাকালে দেশে দুইটা জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা জোটগতভাবে অংশ নিলেও, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। গত নির্বাচনের সময়ে দেশি-বিদেশি যে চাপের মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগ সরকার, তাতে তারা অংশ নিলে কী হতো এনিয়ে আছে নানা আলোচনা। তবে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত এবং নির্বাচন প্রতিহত করার নামে দিনশেষে পিছুটান দেওয়ায় সরকারবিরোধী সবচেয়ে বড় দলটি কোনোভাবেই লাভবান হয়নি। কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচনই নয়, বিএনপি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতেও অংশ নিচ্ছে না।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলটির তৃণমূল অংশ নিতে চাইলেও কেন্দ্র তাতে সম্মত হয়নি। ফলে অনেক জায়গায় দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে অনেকেই অংশ নিয়েছে, কেউ কেউ জয়ীও হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়া নেতাদের বহিস্কার করেছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে যে সিদ্ধান্ত, সেটা তারা যেমন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিয়েছিল, সে একই সিদ্ধান্ত আবার তাদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও। অথচ ইতিহাসে কখনই স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীন ছাড়া হয় না, এমনটা হওয়ারও সুযোগ নেই। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে সেই নির্বাচনকেই ‘না’ বলার এই পূর্ব-সিদ্ধান্তে দলটি আদতে লাভবান হচ্ছে না।

বিএনপির সাম্প্রতিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় যাদের পদাবনতি হয়েছে তারা বড় নেতা ছিলেন, এমন না। পাঁচ সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব কমিয়ে তাদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। কেন্দ্রে যাদের পদোন্নতি হয়েছে তাদের কেউ যে বিগত আন্দোলনে প্রভাব ফেলার মতো ভূমিকা রেখেছিলেন এমনও না। যাদের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলে নেওয়া হয়েছে আন্দোলনের সময়ে তারাও ছিলেন আলোচনার বাইরে, যদিও এটা দলের আলঙ্কারিক পদ। আন্দোলনের সময়ে ও সরকারের কঠোর অবস্থানের মুখে নেতারা কেমন ভূমিকা রাখার সামর্থ্য রাখেন, এটা নিকট অতীত দেখিয়েছে তাদের।

সাম্প্রতিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া বিএনপির মধ্যে ব্যাপক প্রভাব রাখতে পারবে কি? আন্দোলনে ব্যর্থতায় যেখানে দরকার ছিল কেন্দ্রে নতুন কমিটি, সেখানে কাউন্সিলের চিন্তা না করে নতুন নতুন পদায়ন দলের সংকটকে দূরীভূত করতে পারবে না। ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে বিশাল জনসমাগম ঘটিয়েও টিকে থাকার বিকল্প ব্যবস্থা না রেখে, নির্বাচনে বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং গণগ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে গিয়ে বিএনপি নেতারা যে সর্বনাশ করেছিলেন, পুনর্গঠনের নামে আলোচনায় ওঠে আসার এই চেষ্টায় তাদের খুব বেশি লাভ যে হবে তেমনটা মনে হচ্ছে না। 

;

কালো টাকা সাদা বলা- পাপকে ঘৃণা করছি না কেন?



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

নসর পেয়াদা গল্পে ভুলে মাছ রান্নার তেল কেনা হয়েছিল মদের বোতলে। সেজন্য সেই রান্না করা লোভনীয় মাছ কোন মুসলিম সে রাতে খাননি। স্কুলে পড়েছিলাম সেই গল্প। কারণ, মাদকদ্রব্য সেবন করাই মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ বা হারাম। এ গল্পে ধর্মীয় নৈতিকতার একটা মহান শিক্ষা মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। তখনকার দিনে মানুষ এতটা ধর্মপরায়ণতার চিন্তা করতো না-কিন্তু, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দের তফাৎ করাকে কায়মনোবাক্যে পালন করতো। যে যার ধর্মের বিধি-নিষেধগুলোকে শ্রদ্ধাভরে পালন করতো। এখন দিন পাল্টে গেছে। মানুষ দিন দিন বড্ড বেশি অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে।

আজকাল ব্যস্ত মানুষের সময় কেড়ে নিচ্ছে মোবাইল ফোন আর সংযুক্ত এন্তারজাল। যে মায়াজালে মানুষের চোখ-মন সব সময় আটকে থাকে। তাইতো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, অভিভাবক বা কারো সঙ্গে কোন কিছুর ভাল-মন্দ শেয়ার করার কোন সময় না পেয়ে ভুল করে বসে। এভাবে গায়ের চামড়ার রং আরও ফর্সা করার জন্য বিষাক্ত ক্রিমের ব্যবহার করতে গিয়ে দেহকে বিকৃত করেতে দ্বিধা করছে না!

এবারের জাতীয় বাজেটে কালো টাকা সাদা করার ঘোষণা নিয়ে একটি বিতর্কের কলামে চোখ আটকিয়ে গেল। টিআইবি মন্তব্য করেছেন-কালো টাকা সাদা করা অসাংবিধানিক, বৈষম্যমূলক, দুর্নীতিবান্ধব এবং প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণার পরিপন্থি।

দেশে একশ্রেণির মানুষ অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। এদের প্ররোচণায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্বরত নীতিবান মানুষগুলোর সৎ ও জনকল্যাণকর নীতিগুলো বার বার ভূলুন্ঠিত হয়ে পড়ে। বাধাগ্রস্থ হয় সততা। জিইয়ে থাকে মাদক ব্যবসা, অনৈতিক লেন-দেনের সিস্টেমগুলো। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অন্যায়-অবিচার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষিত জিরো টলারেন্স বা সহ্যের শূন্য সীমা- তাহলে কি তারা ভাঁওতাবজিতে পরিণত করতে চায়?

কালো টাকার জন্ম অন্ধকারের ঘুপচি গলিতে। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, জালিয়াতি, মিথ্যা, প্রতারণা, কর ফাঁকি, চুরি-ডাকাতি, প্রতারণা, চোরাচালানি, অবৈধ মাদক ব্যবসা, ব্যাংক লুন্ঠন, মানি লন্ডারিং, জমি জবরদখল, নদীদখল, ভেজালদ্রব্য তৈরি ও বিক্রি সর্বোপরি ধর্মীয় প্রতারণা, মাজার ব্যবসা, যাকাত ফাঁকি-ইত্যাকার নানা বাজে পন্থা হলো কালো টাকার আঁতুড় ঘর। এসব কালো টাকার মালিকরা সমাজের হোমড়-চোমড়া। নৈতিকার বালাই নেই এদের কাজে কর্মে ও নীতিতে। দেশের কর প্রদান করতে গেলে ধরা পড়তে পারে তাই এরা একদিকে সঠিক পরিমাণ কর দেয় না অন্যদিকে ধর্মীয় ও নৈতিকতাবোধ না থাকায় যাকাত প্রদানেও বিরত থাকে। তাই এদের দ্বারা রাষ্ট্রের আর্থিক কোন মর্যাদা বাড়ে না, দরিদ্র মানুষের কল্যাণও সাধিত হয় না।

রাসায়নিকভাবে কালো রংয়ের মধ্যে সাদা রং মেশালে তা সাদা থাকে না। ছাই বা এ ধরণের ভিন্ন রং ধারণ করে। যা অনেক সময় ছাই বা উৎকট পরিবেশ তৈরি করে বিশ্রি রূপ নেয়! কালো টাকা সাদা করতে গিয়ে যদি সমাজে কিছু ছাই জন্ম নেয় তাহলে মানুষের স্বাভাবিক মানসিক পরিস্থিতি খিঁচড়ে গিয়ে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

বাংলাদেশ মুসলিম রাষ্ট্র। এদেশের কর্ণধারগণ মোটামুটি সবাই হজ করে থকেন। কেউ কেউ কিছুদিন পর পর পবিত্র ওমরাহ পালন করতে মক্কা-মদিনায় গমণ করে থাকেন। সেখানে গিয়ে তারা পবিত্র দেহ-মন নিয়ে ফিরে আসেন, দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তারা নিশ্চই চাইবেন না- দেশে এখনও কালো টাকা থাকুক অথবা কালো টাকা জন্ম নিক। আমাদের ৯০ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশে সিংহভাগ মানুষই ন্যায়নীতির সাথে জীবন যাপন করতে ভালবাসে। তারা সেই পরিবেশ আরু ভালো হোক্ সেটাই কামনা করে। তবে কেন মাত্র ১০% কর দিয়ে মিথ্যার বেসাতী ? যারা কালো টাকা সাদা করার পক্ষে তার কি পর্যবেক্ষণ করেন না যে এর চেয়ে কত বেশি অর্থ প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে হারাতে হয়?

কালো টাকা সাদা করার সংবাদ দুর্নীতিকে বহু গুণে উস্কে দিবে। জাতি আর জেনেশুনে পাপী হতে চায় না। আমাদের লাখ-কোটি টাকার বাজেটে কালো টাকা সাদা করার অবদান যতই থাকুক না কেন তা অবৈধ, নাপাক! একজন হাজি সৎ রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে এই অবৈধ অর্থের পৃষ্ঠপোষকতা না করে বরং ঘৃণা প্রদর্শন করা উচিত। তা না হলে আমাদের উন্নয়নের বরকত কেন উধাও হয়ে যায়? আমাদের সোনার দেশের সোনার ছেলেরা বর্তমানে গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ছেড়ে কোন অশান্তিতে পিষ্ট হয়ে ভূ-মধ্যসাগরে রিফিউজি হয়ে বার বার সাগরডুবিতে মারা যায়?

সেজন্য লাগামহীন দুর্নীতি কমানোর জন্য জিরো টলারেন্স বা সহ্যের শূন্য সীমা নামক যে জোর প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে সেটাই থাক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন পিছু না আসে সেজন্য সবাই নিজ নিজ ধর্মমতে প্রার্থনা করুন। আশা করা যায়, কালো টাকা সাদা করার প্রচেষ্টা থেকে সরে এলে শান্তি আসতে পারে। আমাদের হতাশা ও অস্থিরতা বেড়েছে, শান্তি কমে যাচ্ছে দিন দিন। এদিকে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইপির প্রতিবছরের মত এবারের রিপোর্টে প্রকাশ- ২০১৮ সালে বিশ্ব শান্তি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯২ থাকলেও ২০১৯ সালের জুনে এসে তা ৯ ধাপ পিছিয়ে ১০১তম হয়েছে। বিশ্ব শান্তি সূচকে এক বছরে নয়ধাপ অবনমন আমাদের দেশের জন্য ভয়ংকর অশনিসংকেত।

কালো টাকা প্রতিবছর সাদা করার ঘোষণা দেওয়াটা আমাদের দেশের মানুষের ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা দেশে হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদেরকে আরও বেশি উৎসাহ দিচ্ছে এবং দুর্বৃত্তপরায়ণাতাকে শক্তিশালী করে তুলছে। তার প্রমাণ ২০২৪ সালে শুরুতে কেতাদুরস্ত সরকারি -বেসরকারি কুম্ভীলকদের ভয়ংকর রকম চুরি-ডাকাতির ঘটনা ফাঁস হওয়া ও তাদেরকে ক্ষমতাধর মহারথীদের যাদুমন্ত্রের কারসাজিতে দেশ থেকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেওয়া। এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনা আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধকে চপেটাঘাত করেছে, চরম আয়বৈষম্য, দ্রব্যমূল্যসন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে এবং গণদারিদ্র্যকে আরও বেশি ঘনীভূত করার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। এটা কোন কোন ভণ্ড মুসলিম নামধারীদের নীতি হলেও দেশের আপামর প্রকৃত মুমিন-মুসলিমদের আর্থিক নীতি হতে পারে না।

এবারের বাজেটে ডিভিএস বা ডাটা ভেরিফিকেশন সিস্টেম চালু করে অপ্রদর্শিত আয় বা দুর্নীতির কালো টাকা দিয়ে ফ্লাট, অ্যাপার্টমেন্ট, জমি কেনা ইত্যাদি বৈধ করার ঢালাও সুযোগ সত্যিই হতাশাজনক। এটা সুনাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের সরকারি নির্দেশনা যা সংবিধানের (২০) অনুচ্ছেদকে লঙ্ঘন করে। তাই এ বাজেট জনবান্ধবব না হয়ে দুর্বৃত্তবান্ধব বটে। এটা সুশিক্ষা, নৈতিকতা ও মানব উন্নয়নেরও পরিপন্থি। তাই আমাদের আগামীর চরিত্রবান প্রজন্মের তাগিদে এই ভিনদেশী অর্থনৈতিক সংস্কৃতির ধারক অশুদ্ধ-পাপী নীতি এখনই পরিহার করা প্রয়োজন।

কালো টাকা মানুষ ও রাষ্ট্রের অশান্তির মূল কারণ-সেটা ঘরে হোক বা বাইরে হোক। অর্থনীতির ভাষায় যিনি যতই জোর গলায় কালো টাকা সাদা করার সাফাই গেয়ে যুক্তি দিন না কেন- গোয়ালা গাভির দুধ দোহনের সময় এক বালতি দুধে এক ফোঁটা প্রস্রাব যদি অসাবধানতাবশত: ছিটকে পড়ে তাহলে একজন পবিত্র মানুষ কি জেনেশুনে সেটা পান করতে চাইবেন?

এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার ঘোষণা দেশের বৈধ করদাতাকে আরও বেশি নিরুৎসাহিত করবে, সৎ মানুষের সাদা মনকে ভেঙে চুরমার করে দেবে ও সামাজিক ভাঙনকে আরও ত্বরান্বিত করে তুলবে। তাই অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে দেশের সব মানুষের শান্তি ও কল্যাণের জন্য আত্মিক ও নৈতিকতা জোরদার করণ কর্মসূচি নিয়ে আজকেই নতুন সৎ ভাবনা শুরু করা দরকার। সভ্যতার ডিজিটাল ও গতিশীল জাগরণের যুগে মানুষ আর জেনেশুনে পাপী হতে চায় না।

দেশে একশ্রেণির মানুষ অবৈধভাবে কর্মকানণ্ডের জোয়ারে জিইয়ে আছে ভয়ংকর মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, অনৈতিক লেন-দেনের সিস্টেমগুলো। তারা রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অন্যায়-অবিচার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষিত জিরো টলারেন্স কি তারা নিছক ভাঁওতাবজিতে পরিণত করে আরও বেশি পাপ করতে চায়? নাকি তারা বরেরও মাসি কনেরও পিসি? এসবের উত্তর দেবার সময় এখনই ।

ইসলাম ধর্মে কালো টাকা পাপের সঙ্গে তুলনীয় কারণ, এটা ইসলামের মৌলিক নীতির বিরুদ্ধে যায়। ইসলামে নৈতিকতা ও সততার গুরুত্ব অপরিসীম। কালো টাকার ব্যবহার ও উপার্জন অসততা ও নৈতিকতার অভাবের পরিচায়ক। কালো টাকার ব্যবহারে কোন জীবনেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত কর বৈধ উপায় নেই। এ টাকা দিয়ে দান ও যাকাত কার্যকর হয় না। ইহকাল বা পরকালে কালো টাকা ব্যবহারকারীদের জন্য তা শুধু ঘৃণা ও পাপ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।

যেমনটি আজকাল আমরা বিভিন্ন মেগা দুর্নীতিবাজদের কথা পত্রিকার শিরোনামে লক্ষ্য করে যাচ্ছি ও ঘৃণা করছি। কারণ, কালো টাকা হলো সেই অর্থ যা অবৈধভাবে উপার্জিত বা কর ফাঁকি দিয়ে জমা করা হয়েছে এবং সরকারি আর্থিক নীতিমালা লঙ্ঘন করে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সাধারণত বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম, যেমন দুর্নীতি, কর ফাঁকি, অবৈধ ব্যবসা, মাদক পাচার, সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং অন্যান্য অনৈতিক কাজের মাধ্যমে কালো টাকা অর্জিত হয়। কালো টাকা সব সমাজেই দুর্নীতির আঁতুড় ঘর।

কালো টাকা সাদা টাকা-তা বললেই মেনে নেওয়া উচিত নয়। আমরা সবাই পাপীকে ঘৃণা করছি, পাপকে ঘৃণা করছি না কেন? তাই একটি ন্যায়ানুগ সরকার ও দেশের সাদা মনের নিষ্পাপ মানুষদের উচিত কালো টাকা থেকে দূরে থাকা এবং এই টাকার ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। E-mail: [email protected]

;

বিদায় প্রজ্ঞা ও প্রগতির বরপুত্র



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
-প্রয়াত মেজর জেনারেল (অবঃ) আবদুর রশীদ

-প্রয়াত মেজর জেনারেল (অবঃ) আবদুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

৭০ বছরের এক বর্ণাঢ্য জীবন অতিবাহিত করে আজ ভোরে (১৪ জুন, ২০২৪) ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইহলোক ত্যাগ করে অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন বিশিষ্ট নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুর রশীদ। এই বহুল পরিচয়ের বাইরে ব্যক্তি মানুষ হিসাবে তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে মনে হয়েছে তিনি প্রজ্ঞা ও প্রগতির এক বরপুত্র। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন শেষে অধিকাংশ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের আর সেভাবে প্রকাশ্যে সমাজিক পরিমণ্ডলে দেখা যায় না। সেই বিচারে জেনারেল আবদুর রশীদ ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম এক ব্যক্তিত্ব। আমরা জানি পেশাগত জীবনে প্রশিক্ষণ ও কমাণ্ড পরিচালনাসহ সকল ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বড় হয়ে যে দিকটি ধরা দিয়েছে তা হচ্ছে পেশাগত জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতা সমাজ এবং রাষ্ট্রের কল্যাণে সার্থকভাবে সদ্ব্যবহার করতে পেরেছেন আবদুর রশীদ।   

সমরজ্ঞান ও সমাজ-রাষ্ট্র তথা বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিকে একজন আবদুর রশীদ এতটাই গভীরভাবে অনুসরণ করতেন যে বাংলাদেশের জাতীয় গণমাধ্যমসমূহ অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তাঁর বিশ্লেষণ শোনার জন্য উদগ্রিব থাকতো। মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের প্রশ্নে আপোষহীন সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তার বিশ্লেষণে যে অসাধারণ বাগ্মিতা প্রকাশ পেত তা সমকালীন বিশ্লেষকদের মাঝে বিরল। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর তুলনামুলক অধ্যয়ন এতটাই বিস্তৃত ও গভীর  ছিল যা তাকে বহু বক্তার মাঝে ভিন্ন পরিচয়ে দাড় করিয়ে দিত। সাত দশকের যাপিত জীবনে আবদুর রশীদ কেবল নিজেই সমুজ্জ্বল করেননি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবকেও বৃদ্ধি করেছেন।

পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে তাঁর পরিচয় বহু পূর্বেই পেয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবের মানুষটিকে জানার সুযোগ হয়েছে মাত্র ১ বছর ধরে। এই সময়কালে মাত্র ৩ বার জেনারেল আবদুর রশীদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ ঘটেছে। দু’বার তাঁর মিরপুর ডিওএইচএস এর বাসায় আর একবার আমার আমন্ত্রণে তিনি এসেছিলেন মৈত্রী দিবসের আলোচনায় বক্তা হয়ে। এছাড়াও অন্ততঃ ১০-১৫ বার তাঁর সঙ্গে ফোনালাম হয়েছে। এই সময়ে জেনারেল আবদুর রশীদের প্রতি যে গভীর সন্মোহন সৃষ্টি হয়েছে তাঁর নিঃসন্দেহে জীবনস্মৃতির এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।

‘মিয়ানমার বিষয়ে বাংলাদেশের দ্বিমুখী কূটনীতি গ্রহণ করা উচিত’

বিশেষ করে তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে আবদুর রশীদের  ব্যক্তিমানস সম্পর্কে যে মূল্যায়ন সৃষ্টি হয়েছে তা সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। যে দু’বার তাঁর বাসায় গিয়েছি-সেখানে পেশাগত আলোচনা ছাপিয়ে তা ক্রমেই দীর্ঘ আলাপচারিতায় পর্যবসিত হয়েছে। আধঘণ্টার নির্ধারিত সাক্ষাত সাড়ে ৩ ঘণ্টায় গড়িয়েছে। সেখানে আলোচনার মূল সুর ছিল মূখ্যত আদর্শিক সংহতির অনুরণন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতিশীলতা, বাংলাদেশ নিয়ে বহির্বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি-বার বার তাঁর আলোচনার কেন্দ্রে আবর্তিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন জেনারেল আবদুর রশীদ। পেন্টাগনের লব্ধ সেই অভিজ্ঞতা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাকর্তাদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি। সেকারণে আমরা দেখব, জেনারেল রশীদের আলোচনায় পরিমিতিবোধের কি চমৎকার পরিচয়!

সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি বর্বরতা, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ, রোহিঙ্গা সংকট, চীনের কৌশলগত অবস্থান, মিয়ানমারে ভারতের কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্ট কিংবা বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উত্থান নিয়ে তাঁর নির্মোহ মূল্যায়ন ছিল অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও তথ্যবহুল।  সংবাদকর্মীদের সঙ্গে প্রজ্ঞাবান এই মানুষটির ব্যক্তিগত আচরণে যে বিনয় ও আন্তরিকতা প্রকাশ পেত তা আমাদের আপ্লুত করতো। আজ যখন তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে বসেছি তখন বহু কথা স্মৃতিতে ভিড় করছে। সামরিক কর্মকর্তা হয়েও বাংলা ভাষার প্রমিত ব্যবহারে তাঁর অসাধারণত্ব সব সময়ই  মুগ্ধ করেছে। দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে গিয়ে সম্প্রতি তাঁকে শ্বাসকষ্টে ভুগতেও দেখেছি, চিকিৎসকেরও বারণ ছিল কিন্তু তবু তিনি বাকহীন হয়ে থাকতে পারতেন না। কথা বলা ও লেখাকে নিয়ে রাষ্ট্রের প্রতি তাঁর আমৃত্যু কর্তব্য হিসেবে মনে করতেন।  

বিদেশনির্ভরতা ও বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতি

আমাদের রাজনীতিবিদদের বিদেশমূখিতা নিয়ে সরব ছিলেন জেনারেল আবদুর রশীদ। তিনি মনে করতেন আমাদের রাজনীতিবিদদের দেশপ্রেম না থাকায় তাঁরা বিদেশিদের মুখাপেক্ষী হন কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক চক্রান্তে তাঁরা ঠিক ততোটাই পিছিয়ে। বার্তা২৪.কম-কে সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যা আছে, তাই আমাদের একটি দ্বিমুখি কূটনীতি গ্রহণ করা উচিত। একদিকে আরাকান আর্মির সঙ্গে প্রকাশ্যে বা গোপনে হোক সংযোগ তৈরি করা উচিত। আর স্বভাবতই মিয়ানমারের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে তো আমাদের কুটনীতি আছেই।’-রোহিঙ্গা সংকট যাদের কারণে তাদের কাছেই বাংলাদেশ সমাধান খুঁজছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন আবদুর রশীদ।  

সমকালীন ভূ-রাজনীতির বিস্তৃত প্রসঙ্গে আবদুর রশীদের যে গভীর বিশ্লেষণ তা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করতে দেখেছি আমরা। সমর-কুটনীতিতেও তিনি সাম্প্রতিক দশকে অনবদ্য অবদান রেখে গেছেন। বর্তমানে বিশ্বে যুদ্ধ-বিগ্রহের এই সময়ে তাঁর চলে যাওয়া রাষ্ট্রের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

আদর্শিক নৈকট্যের কারণে পেশাগত প্রয়োজনের বাইরেও জেনারেল আবদুর রশীদের অপত্য স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি। সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা ‍নিয়ে ফিরে আসার পর শেষবার যখন কথা হল তখনও বেশ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে আমাকে বলেছিলেন, তিনি আশা করছেন অচিরেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন। কথা দিয়েছিলেন আমার সাংগঠনিক অফিসে আসবেন, মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণও গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সেই ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে গেল।

পরিশেষে এটুকুই বলবার যে, একজন আবদুর রশীদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা রাষ্ট্রের সম্পদ ছিলেন। তাঁর প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম এবং প্রগতির প্রতি অন্তহীন নিষ্ঠা সত্যিই অতুলনীয়। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন ও আদর্শের জন্য বহুদিন তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। তাঁর পারলৌকিক জীবন শান্তির হোক, এই কামনা আমাদের।

;