ভোটে বর্জন বনাম অংশগ্রহণের রাজনীতি: ভোটেরই জয় হোক
ভোট এলো, এলো ভোটসাম্প্রতিক দশকে জাতীয় নির্বাচনসহ যে কোনো নির্বাচনেই একটি সাধারণ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে সংবাদকর্মীদের। তা হচ্ছে- ভোটের দিন মাঝামাঝি সময়ে এসে ভোট বর্জনের ঘোষণা। এবারের নির্বাচনে সে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে না মিডিয়া কর্মীদের। দুপুরেই ছুটতে হচ্ছে না একটি দল কিংবা পক্ষের ভোটবর্জনের সংবাদ সম্মেলনে। সাধারণ চিত্রটা এমন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীদের কেউ কেউ ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। যদিও প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী একে বর্ণনা করেন ‘পরাজয় আঁচ করতে পেরেই এমন সিদ্ধান্ত’।
এটা বাঁচোয়া যে, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোটের দিন ভোট বর্জনের নাটক থাকছে না। তবে বর্জনবিহীন ভোট এটা নয়। এবার আগেভাগেই ভোট বর্জন করেছে দেশের প্রধান রাজনৈতিকদল বিএনপিসহ আরও প্রায় দেড় ডজন দল। দেশের ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বাকি ১৬ টি দলই রয়ে গেছে ভোটের বাইরে।
তবে দেশবাসী ভোটের আর ভোট বর্জনের রাজনীতির মধ্যে ফারাক দেখার সুযোগ পেলো এই নির্বাচনে।
একটা বড় বর্জনের পরেও এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছে ১৯৭০ জন। যাদের মধ্যে কেউ কেউ উচ্চ আদালতের আদেশে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। অর্থাৎ ভোটের জন্য লড়তে যেয়ে তারা আইনি লড়াইও লড়েছেন। ফলে ভোটে লড়াই করছেন দলীয় প্রার্থী ১৫৩৪ জন, অপরদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন ৪৩৬ জন।
ভোট বর্জন না করে বিএনপি নির্বাচনে এলে হয়তো ৩০০ প্রার্থী বাড়তো। জোটের হয়েই তারা প্রার্থী দিতেন। অন্য যে অগুরুত্বপূর্ণ দলগুলো ভোট বর্জন করে বড় হাক ছাড়ছেন তারা হয়তো ভোট করলে সব আসনে দূরের কথা দুডজন আসনেও প্রার্থী দেওয়ার যোগ্য নেতা পেতেন না। একটি বড় দলের বর্জনের ফলে প্রার্থীর তালিকা হ্রস্ব হয়ে আসার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। ৪৩৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী সেই ফাঁকা স্থান পূরণ করেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন ওঠেই ভোট বর্জনের মধ্যে অর্জন বড়? নাকি ভোট করার মধ্য দিয়েই হতে পারে অর্জন?
নিশ্চয়ই ভোটের মধ্যেই বড় অর্জন। ভোটের দিন প্রথম ৪ ঘণ্টায় ভোট পড়েছে ১৮ শতাংশ। তার মানে ভোট পড়ছে। ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে আসছেন। এমনটাই প্রত্যাশা। নির্বাচনের মধ্যে একটা উৎসবের বিষয় রয়েছে। দেশের মানুষ সে উৎসবে অংশ নিতে চায়। কিন্তু দলের বর্জনের সিদ্ধান্তে তাদের দলের সমর্থকরা এই উৎসব আয়োজন থেকে বঞ্চিত হন।
ভোট দেওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. এএসএম মাকসুদ কামালের বক্তব্যটি প্রণীধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ভোট দিয়েই সরকার পরিবর্তন করতে হয়।
সেটাই সত্য। ভোট বর্জন নয়। ভোটে অংশগ্রহণের মধ্যেই জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সবচেয়ে বড় সুযোগ নিহিত।
ভোট বর্জন যেমন কাম্য নয়। ভোটের দিনে সহিংসতাও কাম্য নয়। কিন্তু বাংলাদেশের ভোট সংঘাতবিহীন হবে তেমন ভাবনার বাস্তবায়ন হয়তো সুদুর পরাহতই থেকে যাবে।
ভোটের দিন দুপুর পেরিয়ে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মুন্সীগঞ্জে নৌকা প্রার্থীর এক সমর্থক নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে গণমাধ্যম। এছাড়া দেশের অপরাপর জায়গাগুলিতে বিচ্ছিন্নভিাবে সহিংসতার কিছু খবর আসছে। তবে এর মধ্যেও ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে কেন্দ্রগুলোতে যাচ্ছেন। যদিও বিএনপি ও সমমনা অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সংগঠনসমূহ এই নির্বাচন অনুষ্ঠানকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে জনগণকে ভোট বর্জনের আহ্বানসহ গতকাল শনিবার ও আজ রোববার ২ দিনের হরতাল ডেকেছেন। কিন্তু বিএনপি আহুত এই হরতালকে উপেক্ষা করেই ভোটাররা ভোটকেন্দ্রগুলোতে যাচ্ছেন তাদের নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে।
এবারের বাংলাদেশের ভোটের উপর নজর রয়েছে বিশ্বের। আজকের ভোট পর্যবেক্ষণে বিভিন্ন দেশ থেকে ২০০ বিদেশি পর্যবেক্ষক বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখছেন। কমনওয়েলথ নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জ্যামাইকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওরেট ব্রুস গোল্ডিং। এই দলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাঘা বাঘা ব্যক্তিত্ব প্রতিনিধিত্ব করছেন। পর্যবেক্ষকরা এই নির্বাচন নিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ অভিজ্ঞতাও ইতিমধ্যে তুলে ধরেছেন গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে। তারা ভোটের পরিবেশ সুষ্ঠু ও ভালো বলেই মত দিয়েছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ এবং ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলের উৎকণ্ঠার মাঝেই নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সন্তোষের কথা জানিয়েছেন পর্যবেক্ষকরা। বার্তা২৪.কম এর খবর অনুযায়ী, বেলা ১২টা পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অনিয়ম কিংবা দুর্নীতির কথা বলছেন না বিদেশি পর্যবেক্ষকরা। তাদের মতে বাংলাদেশের চলমান নির্বাচনী পরিবেশ সন্তোষজনক এবং সুসংগঠিত। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিচ্ছেন ভোটাররা। ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে দুপুরের আগে পর্যন্ত তাদের মন্তব্য ছিলো ভোটার কম। তবে বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভোটারও বাড়ছে।
ইউএস এসটিও’র ডেপুটি হেড অব মিশন টেরি এল. ইসলে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ভোটের পরিবেশ ভালো। মানুষ ভোট দিতে আসছে। সবকিছু ভালো মনে হয়েছে।’ তাঁর প্রত্যাশা, শতকরা ৫০ ভাগ ভোট পড়বে। আয়ারল্যান্ড’র পলিটিক্যাল এডিটর নিকোলাস হুপাওয়াল বলেন, ‘ভোটের পরিবেশ যতটা দেখেছি, শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ। রাজনৈতিক অফিসের তুলনায় পোলিং স্টেশনের সংখ্যা কম মনে হয়েছে। পোলিং স্টেশন মাত্র ৪ হাজার, যেটা খুব নগন্য মনে হয়েছে। সব মিলিয়ে আমার মনে হচ্ছে, সবকিছু শান্তিপূর্ণ।’
কিন্তু নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, এমনকি বিএনপি’র অনেক নেতারাও নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার অবস্থানকে ভুল হিসেবে আখ্যা দিয়ে এটি নেতৃত্বের দুর্বলতা বলে বর্ণনা করছেন। তাদের বক্তব্য, বর্তমানে লড়াইয়ের মাঠে যে শক্তি নিয়ে বিএনপি রয়েছে, নির্বাচনে অংশ নিলে আন্দোলনে জায়গাটি আরও বিস্তৃত হতে পারতো এবং শেষ বিচারে বিএনপি-ই এ থেকে সুবিধা নিতে পারতো। কিন্তু নির্বাচনবিমূখিতা এই দলটিকে দীর্ঘমেয়াদী যে সংকটের মধ্যে ফেললো তার উত্তরণ খুব সহজ হবে না বলেই তাদের মত। মাঠ পর্যায়ে সমর্থক ও অনুসারী থাকায় দলটির এই অবস্থান স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিতে যে বিভাজনের রেখা টেনে দেবে তা কার্যতঃ অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডকেই উসকে দিতে পারে।
ভোট বর্জনের সংস্কৃতির উত্তরণ ঘটিয়ে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন যদি সুষ্ঠু ও সন্তোষজনক সংখ্যায় ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয় তবে তা আগামী দিনের গণতান্ত্রিক অচলাবস্থা থেকে বের হতে ভোটই সবচেয়ে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। জনগণের সত্যিকারের ক্ষমতায়নের যে আকাঙ্খা এই দেশে বহুদিনের, সেই পথে আমাদের অনেকদূর যেতে হবে। রাজনীতিবিদদের জনআকাঙ্খার প্রতি আরও অনেক সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এই সব প্রত্যাশাপূরণের জন্য হলেও আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই হাঁটতে হবে। দেশে ফিরবে ভোটের সংস্কৃতি। ভোটে সব পক্ষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই যার উত্তরণ ঘটবে। ৭ জানুয়ারি নির্বাচন সেই পথে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে আগামীই তা বলে দেবে।