মেধাবীদের ‘ব্রেইন-ড্রেইন’ ও বৈষম্য ঠেকাতে উত্তপ্ত শিক্ষাঙ্গন!

  • প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

চাকরিতে বিদ্যমান কোটাপ্রথা নিরসন নিয়ে সারাদেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ক্রমান্বয়ে ফুঁসে উঠেছে। পাশাপাশি পেনশনে ‘প্রত্যয় স্কিম’ সংযোজন নিয়ে দেশের ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের অনির্দিষ্ট ধর্মঘটের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় নতুন যুক্ত হওয়া প্রত্যয় স্কিমের রূপরেখায় নানা বৈষম্যমূলক বিষয় আঁচ করে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা এ কর্মসূচির বিরোধিতা করে আসছেন।
নতুন ঘোষণায় নানা বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে বলে এটা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, অর্থমন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষকদের দাবি অযৌক্তিক! এটা ছড়িয়ে পড়ার পর তাঁর পদত্যাগ দাবি করে এই আন্দোলন আরো বেশি গতিবেগ পেয়েছে।

শিক্ষকেরা অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আপনি আপনার অফিসে যারা বসেন তাদের পেনশনকে স্কিমের আওতায় আনেন দেখবেন, তারাও আন্দোলনে নেমে যাবে।’

বিভিন্ন প্রতিবাদ সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা উল্লেখ করেছেন, ‘শিক্ষকদের জন্য যে প্রত্যয় স্কিম আরোপ করা হয়েছে, তা তাদের পারিবারিক সুরক্ষা নষ্ট করছে। এ প্রত্যয় স্কিমের ফলে মেধাবীরা আর শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হবেন না।’

সব থেকে বড় বিষয় ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদকাল ৬৫ থেকে কমিয়ে ৬০ বছর করা হয়েছে। মাসিক চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতা নতুন প্রত্যয় স্কিমে প্রদান করা হবে না। ...তারা ‘প্রত্যয় স্কিম’ থেকে শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন ও প্রতিশ্রুত সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায় না-হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন’।

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) একজন সাবেক সদস্য বলেছেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। তাই, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত সম্মানটুকু দিতে হবে। আমাদের কাজ আন্দোলন করা নয়, আন্দোলনকে প্রশ্রয়ও দিই না। আমরা টাকার জন্য লড়ি না। আমরা দাঁড়িয়েছি, আমাদের সম্মানের জন্য! টাকার জন্য দাঁড়াতে হলে আমরা বিদেশেই ভালো ভালো রিসার্চে থেকে যেতে পারতাম। কোটি কোটি টাকা উপার্জন করতে পারতাম। কিন্তু আমরা দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসি’! ‘আমাদের বড় বড় গাড়ি, বাড়ির দরকার নেই। আমরা খুবই সাধারণ জীবনযাপন করি। আমাদের ছাত্ররা আসে বড় বড় গাড়িতে অথচ লোকাল বাসে উঠি আমরা। বর্তমানে আমাদের দেশে ভালো ভালো ছাত্রদের ধরে রাখা যাচ্ছে না। শিক্ষকতাও করতে চাচ্ছেন না অনেক মেধাবী ছাত্র। অনেকেই পরবর্তী জীবনে পেনশনের দিকে তাকিয়ে শিক্ষকতা করতে আসেন। এটিও যদি চলে যায়, তবে ভালো মেধাবী ছাত্ররা শিক্ষকতায় আসবেন না’।

এদিকে, ১ জুলাই থেকে সার্বিক অচলাবস্থায় চরম ভোগান্তির শিক্ষার শিক্ষার্থীরা সেশনজটের আশঙ্কা করছেন।

তবে কোনো কোনো শিক্ষক নেতা বলেছেন, করোনাকালের মতো তারা পরবর্তীতে বিশেষ ব্যবস্থায় ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সেশনজট পুষিয়ে দেবেন।

যোগাযোগমন্ত্রী শিক্ষকদের সঙ্গে ৪ জুলাই বৈঠক করার কথা বললেও অজানা কারণে তা স্থগিত করা হয়েছে।

এদিকে, আন্দোলনের ছয়দিনেও সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ের কাউকে এই চলমান ধর্মঘট নিরসনে কোনো ধরনের উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।

দেশের শিক্ষাঙ্গনসহ বিভিন্ন রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের তুমুল আন্দোলনের মাধ্যমে। দেশের ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরাও এই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েছেন।

৭ জুলাই থেকে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। প্রয়োজনে হরতালের ডাক দেওয়া হতে পারে এবং অভিভাবকদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে- বলেছেন আন্দোলনকারীরা।

শিক্ষার্থী ও শিক্ষক একই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ইস্যু নিয়ে সারাদেশে শিক্ষাঙ্গন অচল করে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন অথচ কর্তৃপক্ষ সেটা আমলে না নিয়ে কালক্ষেপণ করছেন, এমন ঘটনাও বিরল।

‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা চার দফা দাবি উল্লেখ করেছেন।

দাবিগুলো হলো- ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখা; ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুতসময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে (সব গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দেওয়া এবং সংবিধান অনুযায়ী কেবল অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা; সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া এবং দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।’

অন্যান্য কোটায় বিভিন্ন ভাতা ও সুবিধাদি নিয়ে তেমন কোনো অসন্তোষের কথা না জানালেও শুধু সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি নিয়ে অনেক বিতর্ক দানা বেঁধেছে।

বিশ্বের বহু গণতান্ত্রিক ও উন্নত দেশে সরকারি-বেসরকারি চাকরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, প্লট-ফ্ল্যাট প্রাপ্তি, বিদেশি নাগরিক, পরিবহনের টিকিট ইত্যাদিতে কোটা পদ্ধতি সংরক্ষিত থাকে।

সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমতা সৃষ্টি ও বৈষম্য দূরীকরণের জন্য কোটা রাখা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে চাকরিতে নানা কোটার আড়ালে প্রায় ৬৩ ভাগ চাকরি বণ্টন করা হচ্ছে, যা মেধাবী ও বঞ্চিতদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক ও অমানবিক।

প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে এদের টিকে থাকতে হলে এবং এদেশকে সত্যিকারভাবে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশের কাতারে এগিয়ে নিতে হলে প্রকৃত মেধাবীদেরকে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়ে আসতে হবে এটাই বাস্তবতা!

সুতরাং সরকারের উচিত আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া ও চলমান সংকটের সমাধান দ্রুত নিশ্চিত করা।

এছাড়া বর্তমানে আমাদের দেশে ভালো ভালো ছাত্রদের ধরে রাখা যাচ্ছে না। দেশে তাদের জন্য উত্তম কর্মক্ষেত্র ও উপযুক্ত বেতন নেই। এজন্য বুয়েটসহ সব নামি-দামি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিদেশে গিয়ে আর দেশে ফেরত আসতে চান না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বিদেশে ডিগ্রি অর্জন করতে গিয়ে দেশে ফেরত আসতে চান না। কারণ, দেশে গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। দেশে তাদের বেতন এত কম যে, একটি মানসম্পন্ন জীবন-যাপন করা খুব কষ্টকর। তার ওপর ছাত্র ও দলীয় রাজনীতির অনৈতিক চাপ শিক্ষাঙ্গনের সার্বিক শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশকে কলুষিত করে রেখেছে। এজন্য মেধাবী ব্রেইনগুলো বিদেশের ড্রেইনে (মেধা পাচার) গড়িয়ে যায়।

এভাবে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে, নিজের মেধাবী সন্তানদের উন্নত সেবা থেকে। অথচ বাংলাদেশে হাজার হাজার বিদেশি এসে উচ্চপদে চাকরি করে বিরাট অংকের অর্থ নিয়ে চলে যাচ্ছে। তারা ঠিকমতো রাষ্ট্রীয় করও দিচ্ছেন না বলে জানা গেছে।

আমাদের নীতি-নির্ধারকদের বিশেষ করে জানা থাকা দরকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্পর্শকাতর জায়গা যেগুলো সব সময় আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দেশকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে থাকে। সেখানে এমন বৈষম্যমূলক প্রকল্প নিয়ে শিক্ষকদেরকে অসন্তষ্ট করার দরকার কী ছিল! বেশ কয়েকবছর ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো শান্ত থাকায় কোনো সেশনজট চোখে পড়েনি। সেখানে এমন বৈষম্যমূলক প্রকল্প চাপিয়ে দিয়ে ক্যাম্পাস অশান্ত করার ঘটনা জাতির বিবেককে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে।

কোন কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কাজ ফেলে রেখে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে যেতে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের পথে নামতে বাধ্য করা হলো! এই আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে আরো সময়ক্ষেপণ বা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হলে শিক্ষাঙ্গনে যে জট ও নতুন ক্ষতির দাগ তৈরি হবে, তার দায়ভার কে বহন করতে আসবে!

সে কারণে আর দেরি না করে এই বৈষম্যমূলক প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করা উচিত সরকারের। ভবিষ্যতের মেধাবীদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করে ধরে রাখা, বাংলাদেশে বিদেশীদের অবৈধ চাকরি করা কমানো এবং ক্রমাগত আমাদের ‘ব্রেইন-ড্রেইন’ঠেকাতে ‘প্রত্যয় প্রকল্প’ প্রত্যাহার করে সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক এবং এভাবে দেশের শিক্ষা ও গবেষণাকে আমরা সবাই মিলে বাঁচাতে সচেষ্ট থাকি!

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। E-mail: [email protected]