২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা
প্রায় দুইশ বছরের ঐতিহ্যের ধারায় পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুরে মাছের মেলা শুরু হয়েছে। এছাড়া জেলার কমলগঞ্জ, বড়লেখা ও শ্রীমঙ্গল উপজেলায় চলছে মাছের মেলা।
এর আগে শনিবার (১২ জানুয়ারি) বড়লেখা উপজেলার কানুনগো বাজারে হাকালুকি মৎস্য পরিচালনা কমিটির উদ্যোগে ও মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সদর উপজেলার শেরপুর বাজারে শুরু হয় এ মাছের মেলা।
ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের শেরপুর-মৌলভীবাজার সড়কের পাশে এই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলা উপলক্ষে আশপাশের গ্রামগুলোতে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মাছের মেলায় বাঘাইড়, আইড়, বোয়াল, বাউশ, কালি বাউশ, পাবদা, গুলসা, গলদা চিংড়ি ইত্যাদি মাছ স্থান পেয়েছে। এ বছর প্রায় ৫০ জন জেলে ও মাছ ব্যবসায়ী মাছ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছেন।
সরেজমিনে জেলার শেরপুরে মাছের মেলায় গিয়ে দেখা যায়, মাছের মেলা বেশ জমে উঠেছে। প্রায় ২০০ বছর আগে জেলার মনুমুখে শুরু হয় এই মেলা। তবে গত ৮০ বছর ধরে এটি শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর তীর জুড়ে বসছে। মেলাটি এখন সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে।
মূল মেলার আগে ও পরে সময় বাড়িয়ে এটিকে তিন দিনের আয়োজনে রূপ দেয়া হয়েছে। দুদিনব্যাপী দেশি মাছের মেলায় নানা জাতের বড় বড় মাছের দুশতাধিক দোকান নিয়ে বসেছেন স্থানীয় এবং দূর দূরান্ত থেকে আগত বিক্রেতারা। শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সের হাজারো মানুষের ঢল নেমেছে সেখানে। মাছের মেলা বলেই মাছের দিকে জনতার স্রোত।
বিভিন্ন দোকানে নানা আকারের বোয়াল, রুই, কাতলা, চিতল, বাঘাইড় (বাঘ মাছ) নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। ঐতিহ্যবাহী এ মেলা এখন এলাকার অন্যতম উৎসবে পরিণত হয়েছে।
মাছের মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি অলিউর রহমান বার্তা২৪-কে বলেন, ‘মাছ, আসবাবপত্র, খেলনা, মিষ্টি ও অন্যান্য খাবার-দাবারের আয়োজন মিলে তিনদিনের এই মেলায় ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার বেচাকেনা হবে।’
মাছের মেলায় আসা ক্রেতা এম.এ মতিন বলেন, ‘মেলায় বড় বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উঠেছে। মাছের দাম এ বছর কিছুটা কম থাকায় আমি ৪০ হাজার টাকায় দুটি বোয়াল মাছ কিনেছি।’
মাছ ক্রেতা সাইফুর রহমান ও জাহিদ হাসান জানান, হাওর ও নদী থেকে আসা তরতাজা মাছ কিনতে প্রতি বছর মাছের মেলায় আসেন তারা।
সিরাজগঞ্জ থেকে আসা মাছ বিক্রেতা মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘যমুনা নদী থেকে ধরা বাঘাইড়, বোয়াল মাছ ও আইড় মাছ মিলে প্রায় ২৫ লাখ টাকার মাছ মেলায় নিয়ে এসেছি। মেলার প্রথম দিন রাতে ১০ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করেছি।’
মেলার আয়োজক সূত্র জানায়, এই মেলাটি প্রথম অনুষ্ঠিত হতো সদর উপজেলার মনু নদীর মনুমুখ এলাকায়। স্থান সংকুলান না হওয়ায় এখন হয় শেরপুরে। মেলাস্থল শেরপুর হলো মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার একেবারে শেষ প্রান্তে। পশ্চিমে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলা, উত্তরে কুশিয়ারা নদী।
নদী পার হলেই সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলা শুরু। হবিগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজার এই তিনটি জেলার মাঝখানে শেরপুর। মৎস্য ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে বড় মাছের মেলা এটি। এটি যদিও মাছের মেলা নামে পরিচিত। তবে মাছ ছাড়াও বিভিন্ন পসরার কয়েক হাজার দোকান বসে।
মেলায় এখন মাছ ছাড়াও ফার্নিচার, গৃহস্থালি সামগ্রী, খেলনা, নানা জাতের দেশীয় খাবারের দোকানসহ গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী পণ্যের দোকান স্থান পায়। এছাড়া শিশুসহ সব শ্রেণির মানুষকে মাতিয়ে তোলার জন্য রয়েছে বায়োস্কোপ ও চরকি খেলা।
এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা মো. মোতালিব মিয়াসহ অনেকেই মেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘সেই ছোটবেলা থেকে এই মাছের মেলা দেখে আসছি। তবে কীভাবে মেলা শুরু হয়েছিল কেউই তার সঠিক ইতিহাস জানে না।’
মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল আলম খান বলেন, 'শেরপুরের মেলায় এবার জুয়া ও অশ্লীল নৃত্য চলবে না। গতবছরও জুয়া ও যাত্রার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। মেলায় নিরাপত্তা রক্ষায় পুলিশের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।'