বিয়ার পরে আর ইস্টিশন মাস্টাররে দেহি নাই
‘তহন আমি ছোড। টেরেইনের বাঁশি হুনলেই দৌইড়্যা (বোকাইনগর) ইস্টিশনে আইতাম। দাঁড়াইয়্যা দাঁড়াইয়্যা টেরেইন দেখতাম। গেরামের মানুষজন টিকিট কাইট্যা টেরেইনে কইর্যা শহরে যাইতো। টেরেইন গেলেগা ইস্টিশনে আমরা কানামাছি খেলতাম। ইস্টিশন মাস্টার আমগোরে কইতো- ‘ওই পোলাপান এইডা ইস্টিশন, খেলোনের জায়গা না, যা বাড়িত যা, কোন সময় যে অঘটন ঘটাস।’ বড় হওনের পর আমার বিয়া অইয়্যা গেল। হেরপর আর ইস্টিশন মাস্টাররে এইহানে দেহি নাই। ইস্টিশনের ঘরডাও তালা মারা থাহে।’
কথাগুলো বলছিলেন বোকাইনগর ইউনিয়নের বাসাবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা রানু আরা (৪০)। গতকাল সোমবার (২৮ জানুয়ারি) দুপুরে নিজের শৈশবকালের স্মৃতিচারণ করে বোকাইনগর রেলওয়ে স্টেশন বন্ধের ঘটনাটা এভাবেই বার্তা২৪.কমের কাছে তুল ধরেন তিনি।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহ-ভৈরব রেলসড়কের গৌরীপুর ও ঈশ্বরগঞ্জ স্টেশনের মধ্যবর্তী স্টেশনটি বোকাইনগর। প্রতিদিন এই স্টেশন হয়ে আন্তনগর, নাসিরাবাদ মেইল, ঈশা খান এক্সপ্রেসসহ ৩টি ভৈরবের লোকাল ট্রেন চলাচল করে। কিন্তু প্রায় ২০ বছর ধরে এই স্টেশনের দাপ্তরিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তাই এই রুটে চলাচলকারী যাত্রীদের ট্রেনের টিকিট, সময়সূচি, মালপত্র বুকিং করতে গিয়ে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
অপরদিকে এখানকার শতশত যাত্রী প্রতিদিন বিনা টিকিটে ট্রেনে যাতায়াত করে। এতে করে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সরেজমিনে বোকাইনগর স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, স্টেশনের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত জরাজীর্ণ টিনশেডের ঘরটির বিভিন্ন অংশ খসে পড়েছে। নারী বিশ্রামাগারের ছাউনি ভেঙে গেছে। স্টেশন মাস্টার ও বুকিং সহকারীর কক্ষ তালাবদ্ধ। ঘরের পেছনের অংশের টিন না থাকায় মানুষ যত্রতত্র আবর্জনা ফেলে ও মলমূত্র ত্যাগ করে নোংরা পরিবেশ তৈরি করেছে।
ক্যামেরা বের করে ছবি তোলার সময় স্টেশনে ছুটে আসে বাসাবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা রানু আরা, রজব আলী, আব্দুল হামিদ সহ অনেকেই। ছবি তুলতে তুলতে গ্রামবাসীর সঙ্গে বার্তা২৪.কমের গল্প জমে উঠে। গল্পের ফাঁকে আব্দুল হামিদ বলেন, ‘এরশাদ সরকারের সময় আমরা টিকিট কাইট্যা টেরেইন দিয়া শহরে যাইতাম। পরে কেমনে কেমনে জানি ইস্টিশনডা বন্ধ অইয়্যা গেল। তয় ইস্টিশনে অহনো টেরেইন চলে।’
কথার রেশ টেনে রজব আলী বলেন, ‘টেরেইন চললেও লাভ কী? ইন্টারসিটি (আন্তনগর) তো ইস্টিশনে থামে না। লোকাল টেরেইন কোন সময় আহে কেউ জানে না। আর যহন আহে তহন একটু থাইম্যাই ছাইর্যা দেয়। যাত্রীরা উডা-নামা করবার পারে না।’
এ প্রতিনিধির কাছে আক্ষেপ নিয়ে রজব আলী বলেন, ‘জানেন মিয়া ভাই, ক্যাপ্টেন মুজিব সাব শেষবার এমপি হওনের পর কইছিন ইস্টিশনডা চালু করবো। কিন্তু হেইল্যা মরণের পর কেউ আর ইস্টিশন লইয়্যা কথা কয় না।’
এরই মাঝে দূর থেকে ভেসে আসে ট্রেনের হুইসেল। কিছুক্ষণ পরেই ধুলা উড়িয়ে দ্রুতগতিতে বোকাইনগর স্টেশন অতিক্রম করে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ময়মনসিংহগামী আন্তনগর ট্রেন বিজয় এক্সপ্রেস। ট্রেনের দিকে ইশারা দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রানু আরা বলেন, ‘এই ইন্টারসিটি টেরেইনডা অহন গৌরীপুর ইস্টিশনে যাইবো। হুনছি আমরার ইস্টিশনের কাজ-কাইম সব গৌরীপুরের ইস্টিশন মাস্টার করে। হেইলা মনে অয় কইতারবো আমরার ইস্টিশনডা কবে চালু অইবো?’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৌরীপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার আব্দুর রশিদ বার্তা২৪.কমকে জানান, বোকাইনগর রেলওয়ে স্টেশনটি ডি শ্রেণির স্টেশন। জনবল সংকটের কারণে এই স্টেশনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি জনবল নিয়োগ করে তাহলে এই স্টেশনের দাপ্তরিক কার্যক্রম পুনরায় চালু হতে পারে।