পানি শূন্যতায় ভুগছে জমিদারের দ্বীপ
চারপাশে বাহারি ফুলের বাগান গোলাকৃতির দীঘিটিকে ঘিরে রেখেছে। সেই দীঘির মাঝখানে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ছোট একটি দ্বীপ। তার উপরিভাগে দুর্বা ঘাসের চাদরসহ রয়েছে সারি সারি সবুজ বৃক্ষরাজি। নিচের ভাগে দ্বীপের স্বচ্ছ পানিতে ভাসছে লাল পদ্ম, ছোটাছুটি করছে বাহারি রঙের মাছের দল। দর্শনার্থীরা ঝুলন্ত সেতু পাড়ি দিয়ে আসা-যাওয়া করেছে ছোট ওই দ্বীপে।
সংস্কারের পর বৃক্ষরাজি ও জলের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এই দৃশ্য গৌরীপুর জমিদারের স্মৃতিচিহ্ন ‘ছোট দ্বীপটিকে’ আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে গোলপুকুরের এই আকর্ষণ দর্শনার্থীদের কাছে বেশিদিন স্থায়িত্ব পায়নি।
স্থানীয়রা জানায়, একযুগ আগে সংস্কারের পর গৌরীপুর জমিদারের শেষ চিহ্ন ছোট এই কৃত্রিম দ্বীপটি তার হারানো সৌন্দর্য ফিরে পেয়েছিল। কিন্তু অযত্ন আর অবহেলায় দ্বীপটি আবারো তার ফিরে পাওয়া সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে। মুক্ত প্রকৃতির এই স্থানটিকে এখন তরুণ-তরুণীরা বেছে নিচ্ছে একান্তে সময় কাটানোর জন্য। সন্ধ্যা হলে আনাগোনা দেখা যায় ভ্রাম্যমাণ মাদকসেবীদেরও। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ‘উপজেলা পরিষদ ক্যাম্পাসে অযথা ঘোরাফেরা নিষেধ’ এই মর্মে সাইনবোর্ড টাঙিয়েই শুধু দায় সেরেছে।
জানা গেছে, গৌরীপুর উপজেলা পরিষদ ক্যাম্পাসের সংরক্ষিত এলাকার ভেতরে দ্বীপটির অবস্থান। শতবছর পূর্বে গৌরীপুরের তৎকালীন জমিদার বজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী জমিদারবাড়ির নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সাগরদীঘির পূর্ব পাশে গোলাকৃতির বড় দীঘি খনন করে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করেন। কিন্তু জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর সেই দ্বীপ অযত্ন অবহেলায় পড়ে থেকে ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছিল।
২০০৭ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইহসানুল হক গোলাকৃতির দীঘি ও দ্বীপটি সংস্কার করেন। এ সময় দ্বীপের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য গোলাকৃতির দীঘির চারপাশ মাটি দিয়ে ভরাট করে লাগানো হয় দুর্বা ঘাস ও বাহারি ফুলের চারা। দ্বীপের উপরিভাগে রোপণ করা হয় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। দ্বীপের পানিতে অবমুক্ত করা হয় দেশি-বিদেশি মাছ। পানি ধরে রাখা ও বের হয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবস্থা করা হয় সেচের। সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও দর্শনার্থীদের চলাচলের জন্য স্থাপন করা হয় ঝুলন্ত সেতু। স্থাপন করা হয় আলোকসজ্জা।
এদিকে সংস্কারের পর দ্রুত সময়েই স্থানটি ভ্রমণপিপাসুদের বিনোদনের স্থানে পরিণত হয়। দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষজন ছুটে আসত দ্বীপে অবকাশ যাপনের জন্য। সবুজ গাছ-পালার নির্মল বাতাসে জুড়িয়ে নিত প্রাণ। কিন্তু সংস্কারের নতুনত্ব কাটতে না কাটতেই কয়েক বছরের মাথায় দ্বীপ তার আকর্ষণ হারাতে শুরু করে।
শনিবার (২ ফেব্রুয়ারি) সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জমিদার বজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর কৃত্রিম দ্বীপের চারপাশ শুকিয়ে চৌচির। এক কোণে কিছু অংশে পানি থাকলেও সেখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পাড়ের মাটি ভেঙে গাছ উপড়ে পড়ছে। ঝুলন্ত সেতুর চিহ্ন নেই। দ্বীপের উপরিভাগে ও নিম্নভাগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ময়লা-আবর্জনা। ফুলের গাছগুলোও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অরক্ষিত থাকায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করে পরিবেশ নষ্ট করছে।
বিশিষ্ট লেখক ও প্রাবন্ধিক রণজিৎ কর বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘জমিদার বজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর উদ্যোগে নির্মিত শতবর্ষী পুরানো কৃত্রিম দ্বীপটি এখনো দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঐতিহাসিক এই নিদর্শনটি তার সৌন্দর্য হারাতে শুরু করেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া জরুরি বলে মনে করছি।’
গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারহানা করিম বার্তা২৪.কমকে জানান, জমিদারের শেষ চিহ্ন দ্বীপের হারানো সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। দ্বীপ সংস্কার করে এখানে ঝুলন্ত সেতু স্থাপন করা হবে। দ্বীপের দীঘির পানি ধরে রাখতে সেচ ব্যবস্থা চালু করা হবে। আলোকসজ্জার পাশাপাশি দর্শনার্থীদের বিশ্রামের ব্যবস্থাও করা হবে। বরাদ্দ এলেই কাজ শুরু হবে।