কাজ থাকলে দেখতি বাহাদুরের বাহাদুরি!
'প্রায় ৫০ বছর আগের কথা। তখন আমি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। পড়াশোনা বাদ দিয়ে সারাক্ষণ খাতা-কলম নিয়ে এটা-সেটার ছবি আঁকতাম। একদিন বার্ষিক পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর না লিখে নানা রকম ছবি আঁকা শুরু করি। বিষয়টি এক স্যার দেখে ফেলে ধমক দিয়ে খাতা টেনে নিলেন। রাগান্বিত কণ্ঠে স্যার বললেন, সবাই খাতায় উত্তর লিখছে, আর তুই খাতায় ছবি আঁকিস?। পরে শাস্তি স্বরূপ স্যার আমাকে কান ধরিয়ে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে রাখলেন। পরীক্ষা শেষে ঘণ্টা বাজলে স্যার আমাকে বললেন- তোর শাস্তি শেষ, এখন বাড়ি যা, মন দিয়ে পড়াশোনা করবি, আঁকা-আঁকি করতে যেনো না দেখি। কিন্তু স্যারের শাসনেও অভ্যাসটা ছাড়তে পারিনি। উল্টো খাতা-কলমের সাথে সাথে রঙ-তুলির কৌশলটা আয়ত্ত করে ফেলি।'
নিজের আঁকা-আঁকির শুরুর দিকের গল্পটা বার্তা২৪.কমের সাথে বলছিলেন গৌরীপুর পৌর শহরের প্রবীণ চিত্রশিল্পী আফজাল হোসেন বাহাদুর (৬৬)। রঙ-তুলি ও হস্তশিল্পে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও নিজের চেষ্টায় তিনি হয়ে উঠেছেন একজন গুণী শিল্পী। গত চার দশকে বাহাদুরের দেখাদেখি অনেকেই এই পেশায় এসেছেন। তবে ডিজিটাল প্রিন্টিংয়ের দাপটে তারা একসময় ছিটকে পড়েছেন। তবে বাহাদুর টিকে রয়েছেন সগৌরবে।
শনিবার (২ ফেব্রুয়ারি) বাহাদুরের সাথে কথা হয় পৌর শহরের মধ্যবাজার এলাকায় তার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে। তিনি বলেন, 'অভাবের কারণে অষ্টম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করতে পারিনি। কিন্তু আঁকা-আঁকির প্রতি আমার যে নেশা ছিল। পরবর্তীতে সেটাই আমার পেশা হয়ে যায়। ১৯৭৭ সালে গৌরীপুরে রঙ-তুলির পেশাদার হস্ত শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করি। এরপর কেটে গেছে ৪২ বছর।'
আলপনা, কুঞ্জ, সাইনবোর্ড, দেয়াল লিখন ও সুন্দর হাতের লেখার পাশাপাশি বাহাদুর রঙ-তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলতে পারেন অসাধারণ সব চিত্রকর্ম। আঁকতে পারেন মানুষের অবিকল ছবিও। রঙের মিশেলে তৈরি করতে পারেন ক্যানভাস, বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি, প্রাকৃতিক দৃশ্য অন্যান্য চিত্রকর্ম ও অসাধারণ সব চিত্রকর্ম। তবে এসব কাজের জন্য অতিরিক্ত পারিশ্রমিক নেন তিনি।
বাহাদুর জানান, নব্বই দশকে তার কাজের চাহিদা ব্যাপক ছিল। তখন প্রতিদিন দেয়াল লিখন, সাইনবোর্ড ও অন্যান্য হাতের কাজ তার আয় হতো ২ হাজার টাকার মতো। তবে ২০০৭ সালের দিকে ডিজিটাল প্রিন্টিং প্রেসের আগমন ঘটায় তাদের কাজে ভাটা পড়ে। এখন প্রতিদিন ছোট-খাটো কাজ করে ৫ থেকে ৬শ টাকা আয় হয়। তাই রোজগার বাড়াতে তিনি ডিশ ব্যবসায় সংযুক্ত হয়েছেন।
দাম্পত্য জীবনে বাহাদুরের স্ত্রী ও দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। পরিবার নিয়ে তিনি পৌর শহরের কলাবাগান এলাকায় বসবাস করেন। তবে সন্তানরা কেউ বাবার প্রতিভার ছিটেফোঁটাও পায়নি।
তবে নিজের প্রতিভা ছড়িয়ে দিতে বাহাদুর পৌর শহরে একটি আর্টস্কুল খুলেছেন। সেখানে তিনি শিক্ষার্থীদের ছবি আঁকা সম্পর্কে হাতে-কলমে শিক্ষা দেন। হস্তশিল্পীর পাশাপাশি একজন খ্যাতিমান ফুটবলার ও হাডুডু ক্রীড়াবিদ হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছেন বাহাদুর।
খেলাধুলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, 'একবার গৌরীপুর বাইরের গ্রামে কাজে যাই। ওই গ্রামে সেদিন হাডুডু টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলার প্রস্তুতি চলছিল। লোকজন খোঁজ পায় আমি এখানে এসেছি। পরে তারা কাজ বন্ধ করে আমাকে মাঠে নামিয়ে দেয়। ওই খেলায় একক নৈপুণ্যে ফাইনাল ট্রফি জিতে আনি।'
এরই মাঝে বিকেলে গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। শহরের সড়কে জ্বলে উঠেছে নগরবাতি। এমন সময় আগমন ঘটে বাহাদুরের শিষ্য ফারুক আহামেদের।
তিনি বলেন, 'ওস্তাদের নাম যেমন বাহাদুর, তিনি কামেও বাহাদুর। কাম দেখলে চাইয়্যা থাকবার মন চায়। অহন যে প্রাইমারি ইশকুলগুলা লাল-সবুজ রঙে সাইজ্যা উঠছে। ওইটা আমগোর ওস্তাদের হাতের জাদুতেই। কাম দেখলেই বুঝবেন ওস্তাদের হাতে কত বাহাদুরি?।'
শিষ্যের কথার রেশ টেনে বাহাদুর বলেন, 'এখন তো আগের মতো কাজ নাই রে ফারুক। কাজ থাকলে দেখতি বাহাদুরের বাহাদুরি কত?'