হইতে চাইছিলাম সাংবাদিক, ভাগ্যদোষে চা দোকানদার
‘লেহাপড়া কইর্যা হইতে চাইছিলাম সাংবাদিক। কিন্তু ভাগ্যদোষে হইলাম চা দোকানদার। ক্যামেরা লইয়্যা সংবাদ খুঁজনের বদলে অহন আমি চায়ের কাপ লইয়্যা দৌড়ি। বন্ধু-বান্ধব যহন বই-খাতা লইয়্যা কলেজে যায়, তহন মন চায় দোকানদারি ফালাইয়্যা আবারো লেহাপড়া করি লই। কিন্তু আমি লেহাপড়া করলে দোহান চালাইবো কেডা, আমার পরিবার খাইবো কী?’
বার্তা২৪.কমের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন গৌরীপুর পৌরশহরের চা বিক্রেতা হারুন অর রশিদ (২০)। তিনি পৌর শহরের সতীষা মহল্লার আব্দুল জব্বারের ছেলে। তিন ভাই, তিন বোনের মধ্যে হারুন পঞ্চম। হারুন টি স্টল নামে একটি চায়ের দোকান রয়েছে তার।
গতকাল রোববার (৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ‘হারুন টি স্টলে’ বসে কথা হয় চা বিক্রেতা হারুনের সঙ্গে। সেখানে চা খেতে খেতেই হারুনের সঙ্গে গল্প জমে এ প্রতিনিধির।
হারুন বলেন, ‘৯ বৎস্যর আগের কথা। তহন আমি সিক্সে পড়ি। বাবা তরকারি বেইচ্যা সংসার চালাইতো। কিন্তু অভাবের সংসারে বাবার রোজগারে তিনবেলা ভাত জুটত না। বাবা আমার লেহাপড়ার খরচ দিতে পারত না। তাই সংসারের হাল ধরতে ইশকুলে যাওয়া বাদ দিয়া বড় ভাই ফারুকরে লইয়্যা গেরামে চায়ের দোকান দিলাম। কয়েক বৎস্যর বাদে ভাই বিয়া কইর্যা আলাদা হইল। হেরপর আমি বাজারে আইয়্যা ভাই ভাই হোটেলে কাম নেই। হেই কামের টেকা ব্যাংকে জমাইয়্যা ২ বৎস্যর পর ওই হোটেলের সামনে ‘হারুন টি স্টল’ নামে আলাদা চায়ের দোকান দেই।’
পৌর শহরের পাটবাজার এলাকার ভাই ভাই হোটেলের বারান্দার একটি কোন ভাড়া নিয়ে চায়ের দোকান বসিয়েছেন হারুন। দোকান ছোট হলেও সেবার মানে হারুন অনেক এগিয়ে। হারুন টি স্টলে চা খেতে আসা নিয়মিত গ্রাহকদের প্রতিদিন মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে দোকান খোলা ও বন্ধের সময়সূচি জানিয়ে দেন হারুন। সংবাদপ্রেমী গ্রাহকদের সুবিধার্থে দোকানে একাধিক জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্র রাখার ব্যবস্থাও আছে। কোনো কারণে দোকান খোলা না হলে সেটাও গ্রাহকদের মুঠোফোনের মাধ্যমে জানিয়ে দেন হারুন। এছাড়াও প্রতিবছর হারুন টি স্টলের পক্ষ থেকে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান করে সেরা চা গ্রাহকদের সম্মাননা দেয়া হয়।
হারুনের ছয় ভাই-বোনের মধ্যে বড় দুই ভাই ও দুই বোন বিয়ে করে আলাদা সংসার করছে। তবে বাবা-মা ও স্কুলপড়ুয়া ছোট বোন তার সঙ্গেই রয়ে গেছে।
হারুন বলেন, ‘৪ বৎস্যর আগে ৫শ টেকা পুঞ্জি লইয়্যা চায়ের দোকানের ব্যবসায় নামছিলাম। এহন সারাদিন বেচা-কিনা কইর্যা ৭ থেইকা ৮শ টেকা কামাই হয়। হেই টেকা দিয়াই চলে সংসার ও এসএসসি পরীক্ষার্থী ছোট বইনোর পড়াশোনার খরচ। তবে বাবা এহনো কিছু সহযোগিতা করে। আর আমিও ব্যবসা বড় করার লেইগ্যা কিছু টেকা জমাইতাছি।’
এরই মাঝে বিকেলের সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। সড়কে জ্বলে উঠেছে বাতি। এমন সময় গল্পে যোগ দেন ভাই ভাই হোটেলের মালিক সোহেল রানা শেখ। তিনি বলেন, ‘হারুন চা বেচলেও তার মেধা আছে। প্রতিদিন সে ৩-৪টা জাতীয় পত্রিকা কিইন্যা পড়ে। একবারতো পত্রিকায় বানান ভুল দেইখ্যা হারুন ঢাকা অফিসে ফোন দিয়া তা ধরাইয়্যা দেয়। আমি তো ওরে প্রায়ই বলি, তুই আবার লেহাপড়া শুরু কর।’
কথার রেশ টেনে হারুন বলেন, ‘ঠিকই কইছো সোহেল ভাই, লেহাপড়া ছাড়া জীবনে দাম নাই। আমারে রিস্ক একটা নিতেই অইবো। আমি আবার লেহাপড়া শুরু করমু। কিন্তু সংসারডা চালাইবো কেডা?’