‘চেহারা দেখলেই কইতারি, কে চোর আর কে ভদ্রলোক’
‘ছোটবেলায় বাপ-মা মইর্যা গেছে। লেহাপড়া কিচ্ছু করি নাইক্যা। মাইনষের বাড়িত কাইজ-কাম কইর্যা বড় অইছি। অহন বয়স অইছে। গায়ে-গতরে আগের মতো খাঁটতাম পারি না। কিন্তু ঘরে বইয়্যা থাকলে খাওয়াইবো কেডা? হেরলেইগ্যা ৭ বৎস্যর আগে নাইটগার্ডের (নৈশ প্রহরী) চাকরি লইছি। তহন থেইক্যা আমার রাইতের ঘুম হারাম। একলা একলা হজাগ (সজাগ) থাইক্যা শহর পাহারা দেই। তয় আল্লার রহমতে এই ৭ বৎসরে আমারে কিনু বালা-মুছিবতে পায় নাই।’
বার্তা২৪.কম-এর সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন গৌরীপুর পৌর শহরের ‘নৈশ প্রহরী’ জহুর আলী (৬৬)। তার বাড়ি পৌর শহরের গাওগৌরীপুর মহল্লায়। বাবার নাম মৃত বাবর আলী।
মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাত ১টার দিকে জহুর আলীর দেখা মেলে পৌর শহরের মধ্যবাজার এলাকায়। তার পরনে খাকি প্যান্ট-শার্ট। গায়ে জড়ানো ময়লা ওয়েস্ট কোর্ট। মুখ মাফলারে বাধা। এক হাতে বর্শা ও আরেক হাতে টর্চ লাইট। সড়কের একমাথা থেকে আরেক মাথায় আসা-যাওয়া করছেন। অপরিচিত কাউকে দেখলেই টর্চেল আলো ফেলে গতিরোধ করে নাম-পরিচয় জানতে চাইছেন তিনি।
সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে জহুর আলীর সঙ্গে হয়। তিনি বার্তা ২৪.কমকে বলেন, ‘নাইটগার্ডের চাকরি অত সহজ না। মেলা মাইনষের জান-মাল দেইখ্যা-হুইন্যা রাখতে হয়। লোকজন আমার ওপরে বিশ্বাস কইরা দোহান-ঘরে মালামাল রাইখ্যা ঘুমাইতে যায়। আমি জানবাজি রাইখ্যা পাহারা দেই। রাইতের বেলায় কত কিছিমের মানুষ রাস্তা-দিয়া আনাগোনা করে। তয় আমরা চেহারা দেখলেই কইতারি কে চোর আর কে ভদ্রলোক।’
দাম্পত্য জীবনে জহুরের স্ত্রী ও তিন ছেলে রয়েছে। এর মধ্যে বড় দুই ছেলে ইজিবাইক চালায়। ছোট ছেলে মাদরাসায় পড়ে।
রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত পৌর শহরের মধ্যবাজার, সিনেমা হল রোড, গোবিন্দবাড়ি সড়ক ও হারুন পার্ক এলাকায় নৈশ প্রহরীর দায়িত্ব পালন করেন জহুর। অন্ধকার রাতে তিনি একা একা সড়কের অলি-গলি দিয়ে ঘুরলেও ভয়-ডর তাকে স্পর্শ করে না। তবে মাস শেষে বেতন তিনি যে ৪ হাজার টাকা বেতন পান, সেটা দিয়ে সংসার ও ছোট ছেলের পড়াশোনার খরচ চালাতে তার কষ্ট হয়।
বার্তা২৪.কমকে জহুর আলী বলেন, ‘৭ বৎস্যর চাকরি কইরাও বেতন বাড়লো না। আমরার কাছে অহন চইত-কার্তিক বারো মাসই হমান। মেঘের মইধ্যে বৃষ্টিত ভিইজ্যা, শীতের মইধ্যে কুয়াশাত ভিইজ্যা পাহারা দেই। কয়দিন কমান্ডার সাবরে কইলাম রাইতে ম্যালা শীত পড়ে, আমরারে একটা কইরা কম্বল দেইন। কমান্ডার সাব কয়, কম্বল দিলে ঝামেলা আছে, পরে আর ঠিকঠাক পাহারা দিবার পারবা না। অহন শীত লাগলে কাগজ টুহাইয়্যা আগুন জ্বালাইয়্যা শইল গরম করি।’
ধীরে ধীরে ঘড়ির কাঁটা এগুচ্ছে। শহর এখন অনেকটাই জনশূন্য। ফাঁকা হয়ে গেছে সড়ক ও অলিগলিগুলো। এমন সময় মধ্যবাজার সড়কের মরিচমহলে লুঙ্গি পরিহিত এক যুবককে দেখে তার গতিরোধ করে জহুর। মুখে টর্চ মেরে ধমকের সুরে জানতে চান, ‘অই তোমার বাড়ি কই? রাইতের বেলা এনো ঘুরাঘুরি করতাছো কে?’ জহুরের কথায় থমকে গিয়ে ওই যুবক বলেন, ‘আমার বাড়ি কোনাপাড়া। গাড়িত কইর্যা মাল আনছি, নামানির জায়গা খুঁজতাছলাম।’