আস্থা নেই পাঠ্যবইয়ে, নিষিদ্ধ গাইডে নির্ভরশীল শিক্ষার্থীরা

  • কাজল সরকার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, হবিগঞ্জ, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আস্থা নেই পাঠ্যবইয়ে, নিষিদ্ধ গাইডে নির্ভরশীল শিক্ষার্থীরা। ছবি: বার্তা২৪.কম

আস্থা নেই পাঠ্যবইয়ে, নিষিদ্ধ গাইডে নির্ভরশীল শিক্ষার্থীরা। ছবি: বার্তা২৪.কম

শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। নতুন চ্যালেঞ্জ, স্বপ্ন আর প্রত্যাশা নিয়ে শিক্ষার্থীরা শুরু করেছে কঠোর অধ্যবসায়। শিক্ষার্থীদের চ্যালেঞ্জ, স্বপ্ন আর প্রত্যাশা পূরণের সহযোগিতায় পিছিয়ে নেই সরকারও। শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে বছরের প্রথম দিনই (১ জানুয়ারি) তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় নতুন বই। প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় এই পাঠ্যবই।

মনে করা হয় এ দিনটি শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দের ও উৎসবের। নতুন বই হাতে পেয়ে খুশিতে ভরে উঠবে তাদের মন। ডান, বাম কিংবা পেছনের দিকে না তাকিয়ে পাঠ্যবইয়ের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রেখে এগিয়ে যাবে স্বপ্ন পূরণের পথে। কিন্তু বইয়ের বাজারে গেলে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। দোকানে দোকানে সাজানো আছে নিষিদ্ধ নোট-গাইড। পাঠ্যবই থেকে মুখ ফিরিয়ে এসব নিষিদ্ধ নোট-গাইডের ওপর নির্ভর করছে শিক্ষার্থীরা। আবার কমিশন পাওয়ার লোভে শিক্ষার্থীদের ভুল পথে হাটতে বাধ্য করছেন মহান পেশায় নিয়োজিত থাকা অসাধু কিছু শিক্ষকও।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের নোট বা গাইড বই মুদ্রণ ও বিক্রয় নিষিদ্ধ। ১৯৮০ সালের নোট বই (নিষিদ্ধকরণ) আইনে এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। আইন লঙ্ঘনের দায়ে সর্বোচ্চ সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে এই আইনে। এছাড়া ২০০৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগের এক আদেশে নোট বইয়ের পাশাপাশি গাইড বইও নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের এই আদেশ বহাল রাখে। কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। যার ফলে লিফলেট বিতরণসহ প্রকাশ্যে দোকানগুলোতে নোট-গাইডের পসরা সাজিয়ে বিক্রি করছে ব্যবসায়ীরা।

হবিগঞ্জ শহরের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে (বইয়ের দোকান) গিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের নোট ও গাইড বইয়ের পসরা সাজিয়ে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। শহরের ঘাটিয়া বাজার ও তিন কোণা পুকুর পাড় এলাকার শাহজালাল লাইব্রেরির দুটি শাখা, সিনেমা হল রোড এলাকার স্কুল লাইব্রেরি, সুলতানিয়া লাইব্রেরি, সবুজবাগ এলাকার আনুয়ার লাইব্রেরি, স্টুডেন্ট লাইব্রেরিসহ বইয়ের দোকানে ১ম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবগুলো পাঠ্যবইয়ের নোট ও গাইড পাওয়া যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

লেকচার, জুপিটার, দিগন্ত, দ্বীপশিখা, জ্ঞানগৃহ, পপি, পাঞ্জেরি, পুথি নিলয় ও জননী পাবলিকেশনের নোট ও গাইডে ভরে রয়েছে শহরের বইয়ের দোকানগুলো। আবার অনেক শিক্ষকরা কমিশন পাওয়ার লোভে এসব নোট ও গাইড কিনতে নির্দেশ দিচ্ছেন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। এই নির্দেশের পেছনে চলে মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন। নামীদামি স্কুল ও কলেজগুলোতে শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উপঢৌকন দিয়ে গাইড ও নোটবই তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সচেতন মহল বলছে, নোট-গাইডের প্রভাবে শিক্ষার্থীরা বোর্ডের বই পড়ছেই না। বিভিন্ন স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় শিক্ষকরা গাইড বইয়ের অনুশীলনীর প্রশ্ন ব্যবহার করছেন। এতে শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যার দিকে ঝুঁকছে। গাইড বইয়ের ওই উত্তরটি মুখস্থ করলেই পরীক্ষায় পাস করা যাবে। ফলে প্রশ্নফাঁসে ঝুঁকে পড়ছে তারা, যা কোনো ভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। নোট-গাইডের ওপর নির্ভরশীল থেকে পরীক্ষার ফল খারাপ হচ্ছে। পরীক্ষার প্রশ্নও অনেক শিক্ষকরা নোট-গাইড থেকে বের করে দেন।

এ ব্যাপারে কয়েকজন শিক্ষার্থী বলে, ‘আমরা জানি পাঠ্যবই আমাদের জন্য অনেক ভালো। কিন্তু পাঠ্যবই থেকে বুঝতে আমাদের সমস্যা হচ্ছে। শিক্ষকরা স্কুলে আমাদের ঠিকভাবে পাঠদান দিচ্ছে না। যার ফলে আমাদেরকে নোট-গাইডের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়।’

তারা বলছে- ‘অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে ভালো মানের শিক্ষক নেই। আবার যারা ভালো মানের শিক্ষক তারা স্কুলের চেয়ে কোচিং কিংবা প্রাইভেট পড়ানো নিয়ে বেশি ব্যস্ত। এ অবস্থায় নোট-গাইড ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই।’

অভিযোগ করে শিক্ষার্থীরা বলে, ‘অনেক শিক্ষকই আমাদেরকে বিভিন্ন প্রকাশনীর নোট-গাইড কিনতে বলেন। না কিনলে আমাদেরকে স্কুলে গেলে বিভিন্নভাবে অপমান করা হয়। পরীক্ষায় নাম্বার দেয়া হয় না।’

একই অভিযোগ অভিভাবকদেরও। তারা বলছেন, ‘প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে পাঠ্যসূচির তালিকায় নিষিদ্ধ নোট-গাইড রাখা হয়েছে। শিক্ষকদের কড়া নির্দেশনায় ওই নোট-গাইড কিনতে বাধ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। নোট-গাইড না কিনলে শ্রেণিকক্ষে প্রতিদিন চাপ দিচ্ছেন শিক্ষকরা।’

এ ব্যাপারে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আব্দুল আহাদ চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ শতভাগ সঠিক নয়। আবার ভুলও নয়। অনেক শিক্ষক বিভিন্ন নোট-গাইড ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ সুবিধা নিয়ে শিক্ষার্থীদের তা কিনতে বাধ্য করছেন। তবে সব শিক্ষক এটা করে না।’

তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা মনে করে নোট-গাইডের মাধ্যমে তাদের অনেক উপকার হয়। তাই তারা এসব নোট-গাইড কিনে। কারণ শিক্ষার্থীরা এখন মুখস্থ বিদ্যায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অথচ এই মুখস্থ বিদ্যা তাদেরকে মেধাবী হতে দিচ্ছে না।’

তবে নিষিদ্ধ এসব নোট-গাইড বিক্রির বিষয়ে কথা বলতে সব বিক্রেতাদেরই অনীহা। তাদের দাবি, শিক্ষার্থীরা কিনে, তাই তারা বিক্রি করেন।

এ ব্যাপারে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অনিল চন্দ্র মজুমদার জানান, নোট-গাইড সরকার থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ ব্যবসায়ীরা এসব নোট-গাইড প্রকাশ্যে বিক্রি করছে।

তিনি জানান, বিভিন্ন কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তবে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।