ইশকুল আমি মেলা আগেই ছাড়ছি!
ছেলেটির বয়স আনুমানিক ১২। পরনে ময়লা শার্ট-প্যান্ট। ছোট ছোট বাহারি পণ্যসামগ্রী বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে হেঁটে চলেছে সড়কের পাশ দিয়ে। মাঝে মাঝে হেঁকে উঠছে, ‘‘এই ক্লিপ,আয়না, চিরুনি, চুল বাঁধার ফিতা, চুরি, টিপ আছে, লাগবে নাকি?, পোলাপাইনের খেলনা, তসবিহ আছে, লজেন্সও বেঁচি’’।
পথে কোনো ক্রেতা ডাক দিলে থামছে ছেলেটি। তাদের কাছে জিনিসপত্র বিকিয়ে আবার হেঁটে চলে; নতুন ক্রেতার আশায়।
সোমবার (১১ ফেব্রুয়ারি) বিকালে ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌর শহরের ধানমহাল এলাকায় দেখা মেলে এই শিশুহকারের। নাম তার আকাশ মিয়া। ইশারায় ডাক দিতেই সে বলে ওঠে, “কী লাগবো মামা?”। সাংবাদিক পরিচয় দিলে ভুল ভাঙে তার। বার্তা২৪.কমের সাথে কিছুক্ষণের জন্য গল্প জমে ওঠে ছেলেটির।
আকাশ জানায়, তার বাবা হাদিস মিয়া, তিনি পেশায় কাঠুরে। তাদের বাড়ি কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নে। তিন ভাইয়ের মধ্যে আকাশ বড়। জীবিকার তাগিদে সংসারের হাল ধরতে এই পেশা বেছে নিয়েছে।
আকাশ বলে, ‘‘ছোটবেলা আব্বায় লেহাপড়ার লেইগ্যা ইশকুলে ভর্তি করছিলো। কিন্তু আমি ইশকুলে যাইতাম না। আব্বায় ইশকুলে যাওয়ার লেইগ্যা বকাবাইদ্য করলেও আমি হুনতাম না। তহন আব্বায় কইলো, আমার তো জমিদারি নাই, ঘরে বইয়্যা থাকলে তোরে খাওয়াইবো কেডা?। তাই প্যাটের দায়ে দুই বৎসর আগে এই ব্যবসায় নামছি। তয় কয়েক মাস আগে ব্যবসাডা ছাইড়্যা দিছিলাম। কিন্তু কয়েকদিন আগে গাছ কাটতে গিয়া পা কাইট্যা ফেইল্যা আব্বা বিছনায় পইড়্যা যায়, তাই আবার ব্যবসায় নামছি।”
গৌরীপুর পৌর শহরের একটি বাড়ির ছোট কক্ষ ৮০০ টাকায় ভাড়া নিয়ে দুই চাচাতো ভাইকে সাথে নিয়ে থাকে আকাশ। তার ওই দুই ভাইও এই ব্যবসা করে। প্রতিদিন পৌর শহর ও ইউনিয়নে ঘুরে ঘুরে বাঁশের পণ্যসামগ্রী ঝুলিয়ে বিক্রি করে আকাশ। তার কাছে সর্বোচ্চ দামের জিনিস হচ্ছে ৪০ টাকা মূল্যের তসবিহ, সর্বনিম্ন দামের জিনিস ২৫ পয়সা মূল্যের লজেন্স। এছাড়ার তার এখানে ৫ থেকে ২০ টাকার মধ্যে তরুণীদের মাথার ক্লিপ, চুল বাঁধার ফিতা, মাথার বেন, চিরুনি, কলম, বাচ্চাদের খেলনা সামগ্রীসহ হরেকপণ্য আছে। এছাড়াও পণ্যসামগ্রীর বিনিময়ে আকাশ গ্রামের মহিলাদের ঝড়ে যাওয়া মাথার চুল সংগ্রহ করে ময়মনসিংহ শহরে বিক্রি করে।
আকাশ জানায়, প্রতিদিন ৩০০ টাকার মতো বিক্রি করলে অর্ধেক লাভ হয়। আর মাসে চুল বিক্রি করেও ১০ হাজার টাকা পায় সে। এক কেজি চুলের দাম পাঁচ হাজার টাকা। মাসে পাঁচ হাজার টাকা সে বাড়িতে পাঠায়।
আকাশের মা কল্পনা বেগম, তিনি গৃহিণী। এক ভাই আশিক, তার বয়স নয় বছর। সবচেয়ে ছোট ভাই সোহেলের বয়স চার বছর। তারা কেউ লেখাপড়া করে না।
আকাশের সাথে কথা বলতে বলতেই সন্ধ্যা নেমে আসে। সড়কে জ্বলে ওঠে নগরবাতি। এমন সময় কয়েকজন ক্রেতা এসে হাজির হন আকাশের কাছে। তাদের একজন হারুন অর রশিদ। চিরুনি কিনে টাকা দেয়ার সময় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কী ভাই, তুমি এই বয়সে লেখাপড়া না করে ব্যবসায় নেমেছ কেন? লেখাপড়া করলে তো চাকরি-বাকরি করে অনেক বড় হতে পারতে!’’
আকাশের জবাব, ‘‘ইশকুল আমি মেলা আগেই ছাড়ছি। তাই লেহাপড়া কইর্যা আমার বড় অওনের সুযোগ নাই। তয় দোআ কইরেন, ব্যবসার টেকাটা জমাইয়্যা যেন বড় একখান বাড়ি করতে পারি, ভাঙা ঘরে থাকতে ভাল্লাগে না!”