অবৈধ দখলে বারীণ মজুমদারের জন্মভিটা
বারীণ মজুমদার। শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রখ্যাত পণ্ডিত হিসেবে খ্যাত। পাবনা শহরের রাধানগর মজুমদার পাড়ায় মুজুমদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সংগীত শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে আজীবন সংগ্রামী এই শিল্পীর জন্মভিটা এখন ভূমিগ্রাসীদের অবৈধ দখলে। আর অযত্ন অবহেলায় ধ্বংস হচ্ছে তার সব স্মৃতি চিহ্ন। তাই স্মৃতি ধরে রাখতে শিগগিরই সংগ্রহশালা ও সংগীত একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবি স্থানীয়দের।
তথ্যানুসারে, ১৯১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পাবনা পৌর এলাকায় রাধানগর মজুমদার পাড়ায় প্রখ্যাত জমিদার বংশ মজুমদার পরিবারে জন্ম নেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী ওস্তাদ বারীণ মজুমদার। জমিদার বাবা নীশেন্দ্রনাথ মজুমদার শাস্ত্রীয় সংগীতের ভক্ত ছিলেন। দেশ বিদেশের প্রখ্যাত শিল্পীদের নিয়ে বাড়িতে নিয়মিত বসত আসর। সেখান থেকেই সংগীতের প্রতি আসক্তি বারীণের। চর্চায় বাদ সাধেনি পরিবারও।
১৯৩৯ সালে লক্ষ্মৌ’র মরিস কলেজ থেকে সংগীতে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। দেশবিভাগের সময় ১৯৪৭ সালে ফিরে আসেন বাংলাদেশে। জমিদারির বিষয় সম্পত্তি ফেলে মন প্রাণ সপে দেন শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রসারে। তাঁর প্রচেষ্টাতেই ১৯৬৩ সালে ঢাকার কাকরাইলে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম সংগীত মহাবিদ্যালয়। তালিম দিয়েছেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতেও। সংগীত সাধনায় তাঁর খ্যাতি ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো উপমহাদেশে।
অবদানের স্বীকৃতিতে পাকিস্তান আমলেই পেয়েছেন ‘তমঘায়ে ইমতিয়াজ’ খেতাব, ১৯৮৩ সালে একুশে পদক, ২০০২ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার।
পাবনার খ্যাতিমান সংগীত শিল্পী, আওয়ামী শিল্পগোষ্ঠীর সভাপতি প্রলয় চাকী বার্তা২৪.কমকে জানান, ছোটবেলা থেকে জমিদারির বিত্ত বিলাসেই বড় হয়েছেন বারীণ মজুমদার। বেদখলে থাকা রাধানগরের পুকুর ঘাটের জমিদার বাড়িতে তিনি আসলে আশেপাশের জেলা থেকে গুণী শিল্পী ও যন্ত্রীরা ছুটে আসতেন। মজুমদার পরিবারের দান করা জমিতেই গড়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, রাধানগর মজুমদার একাডেমিসহ আরও নানা স্থাপনা।
তিনি বলেন, ‘সুর সাম্রাজ্যে নিমগ্ন থাকায় বিষয় সম্পত্তি নিয়ে ভাবনা ছিল না বারীন মজুমদারের। এমন উদাসীনতায় সমস্ত সম্পদ চলে যেতে শুরু করে ভূমিদস্যুদের দখলে। লজ্জায়, অভিমানে প্রতিবাদটুকু করেননি তিনি। এক সময় মাথা গোঁজার শেষ ঠাঁইটুকুও বেহাত হলে তিনি মৃত্যুর আগপর্যন্ত আর পাবনায় আসেননি।
বারীন মজুমদারের জেষ্ঠ্য পুত্র সংগীত পরিচালক পার্থ সারথি মজুমদার বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘পাবনায় আমাদের পূর্বপুরুষের বাড়ি। আমাদের ওইসব জমি ভূমিগ্রাসীরা জাল কাগজ তৈরি করে দখল করে নেয়। যাদেরকেই বাবা আশ্রয় দিয়েছেন, তারাই বাবার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।’
বারীন মজুমদারের কনিষ্ঠ পুত্র জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী বাপ্পা মজুমদার বলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষের মাটিতে আমাদের দাঁড়ানোর জায়গা নেই। আইনি লড়াইয়ে প্রতারণা প্রমাণিত হয়েছে। তারপরও অবৈধ দখলদাররা আমাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দিচ্ছেন না। এ ব্যপারে আমরা প্রশাসন ও স্থানীয়দের সহযোগিতা চাইছি।’
পাবনার জেষ্ঠ্য আইনজীবী পুলক কুমার চক্রবর্তী জানান, ১৯৭৮ সালে বারীন মজুমদারের মা মৃত কমলা রাণী মজুমদারকে জীবিত দেখিয়ে ২০০৫ সালে শোলে সূত্রে ডিক্রি করে বারীণ মজুমদারের সম্পত্তি নিজেদের করে নিতে চেষ্টা করে একটি চক্র। পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত জালিয়াতির প্রমাণ পেয়ে এ সম্পত্তি বারীণ মজুমদারের উত্তরাধিকারীদের বলে রায় দিয়েছেন।
অভিযুক্তরা নির্ধারিত সময়ে দখল না ছাড়ায়, প্রথম সাব জজ আদালতে একটি উচ্ছেদ মামলা চলমান রয়েছে বলেও জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আদালতের নির্দেশনা পেলে বারীণ মজুমদারের সম্পত্তি উত্তরসূরিদের ফিরিয়ে দিতে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
স্মৃতি ধরে রাখতে যে কোনো উদ্যোগে সরকারি সহযোগিতার আশ্বাসও দেন তিনি।
এদিকে পাবনাবাসীর প্রত্যাশা বারীণ মজুমদার তথা তার উত্তরাধিকাররা পাবনার সম্পদ। তাদেরকে পাবনামুখি করতে, পাবনায় তাদের পদচারণার দাবিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া প্রয়োজন।