গরিবের স্বপ্ন অতো সহজে পূরণ হয় না
‘মাইনষ্যের কত কিছু করার স্বপ্ন থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্য, গাড়ি-বাড়ি, টেকা-পয়সা বাড়ানো আরও কত কি। তয় আমার স্বপ আছিন বাড়িতে একটা টিনের ঘর করার। কিন্তু চা, পান, সিগারেট বেইচ্যা যে টেকা কামাই করি সবডা সংসারের পিছে লাইগ্যা পড়ে। ঘর করার টেকা আর জমাইতে পারি না। কয়েক বৎস্যর আগে চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে সরকারি একটা ঘর চাইছিলাম। কইছে কইর্যা দেবে। কিন্তু পরে আর দেয় নাই। বুজলেন মিয়া ভাই, গরিবের স্বপ্ন অতো সহজে পূরণ হয় না। তয় অহন চেষ্টায় আছি গেরামে একটা চায়ের দোকান দিবার। কেরে জানি হেইডার টেকাও জমাইতে পারতাছি না।’
বার্তা২৪.কমের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলছিলেন ভ্রাম্যমাণ হকার তোতা মিয়া (৫৫)। তার বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের রামগোপালপুর ইউনিয়নের নওয়াগাও গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মৃত মল্লিক মিয়ার ছেলে। জীবিকার তাগিদে শহরের অলি-গলিতে ঘুরে ঘুরে চা, পান ও সিগারেট বিক্রি করেন তিনি।
গতকাল শুক্রবার (১৫ মার্চ) বিকেলে তোতা মিয়ার দেখা মিলে গৌরীপুর শহরের হাতেম আলী সড়কে। তার এক হাতে ২টি চায়ের ফ্লাক্স ও বালতি, অন্য হাতে ঝুলানো চায়ের কাপ ও পান-সিগারেটের ব্যাগ। ‘এই চা গরম, চা গরম’ পান-সিগারেটও সঙ্গে আছে’ এভাবে কথাগুলো বলে ছুটে চলেছেন সড়কের পথ ধরে। কেউ ডাক দিলে থামছেন তিনি। চা কিংবা পান, সিগারেট বিক্রি শেষে আবারো হেঁটে চলেছেন সড়কের পথ ধরে।
দূর থেকে হাতের ইশারায় ডাক দিতেই থেমে গেলেন তোতা মিয়া। কাছে এসে জিজ্ঞাস করেন কী চা দিমু? দুধ চা নাকি লাল চা? লাল বলতেই দ্রুত চা নিয়ে আসেন তিনি। চা খেতে খেতে তোতার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প হয় এ প্রতিনিধির।
বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, ‘অভাবের কারণে লেহাপড়া করি নাই। ছোড থাকতেই মাইনষ্যের কাজ-কাম কইর্যা পেট চালাইছি। অহন বয়স অইছে। শইলে মেলা রোগ-বালাই। আগের মতো খাটা-খাটনি করবার পারি না। তয় ঘরে বইয়্যা থাকলে ভাত-ওষুধ কে দিবো? সেই জন্য এই ব্যবসায় নামছি।’
প্রতিদিন শহরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে চা, পান ও সিগারেট বিক্রি করেন তোতা। চা প্রতি কাপ ৫ টাকা, পান প্রতি পিস ৫ টাকা, সিগারেট রয়েছে বিভিন্ন দামের। দিন শেষে বিকিকিনি করে তার লাভ হয় ২শ থেকে ২২০ টাকার মতো। তবে এই সামান্য টাকায় তার সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।
সহায়-সম্বলহীন তোতা মিয়ার নিজ ভিটেতে জরাজীর্ণ একটি ঘর ছাড়া আর কিছুই নেই। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী, এক ছেলে, ছেলের বউ ও দুই নাতি রয়েছে। কিন্তু একমাত্র ছেলে প্রতিবন্ধী হওয়ায় কোনো কাজ করতে পারে না। তবে ছেলের বউ একটি ফ্যাক্টরিতে সামান্য বেতনে কাজ করে সংসারের হাল ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে।
তোতা মিয়ার সঙ্গে গল্প করতে করতে সন্ধ্যা গড়ায়। মসজিদে বেজে ওঠে আজানের ধ্বনি। এমন সময় মিলন মিয়া নামে এক পথচারী তোতার সামনে এসে এক চা দিতে বলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মিলন বলেন, ‘মুরব্বি আপনি এই বয়সে ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করেন কেন? আপনার সন্তানরা কী ভাত-কাপড় দেয় না? কথার রেশ টেনে তোতা বলেন, ‘সন্তান তো প্রতিবন্ধী। হে আর কী ভাত-কাপড় দিবো। তাই পেটের দায়ে ঘুরি গো বাজান। তয় গেরামে একটা ছোড দোকান দিতে পারলে আমার শইলডা জিরান পাইতো। কিন্তু টেকার অভাবে পারি না।’