স্বাধীনতার ৪৮ বছর

এখনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি মৌলভীবাজারের জয়গুন নেছা

  • তোফায়েল পাপ্পু, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, মৌলভীবাজার, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

জয়গুন নেছা খানম / ছবি: বার্তা২৪

জয়গুন নেছা খানম / ছবি: বার্তা২৪

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষা শেষ করেছেন মাত্র। কিন্তু ওই সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লালসায় টানা ৬ মাস বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। হয়েছেন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। বহু কষ্টে পালিয়ে আসলেও পাকিস্তানি সেনার ঔরসের সন্তান নিয়ে সামাজিক নানা বিড়ম্বনা যেন এখনো তাকে খামচে ধরে।

বলছি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ষাটোর্ধ জয়গুন নেছা খানমের কথা। শেষ বয়সে এসে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও তিনি পাননি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শমসের নগর বাজার সংলগ্ন ভাদাইর-দেউল গ্রামের সুঞ্জর খানের মেয়ে জয়গুণ স্থানীয় রামচিজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সবে পঞ্চম শ্রেণিতে পরীক্ষা দিয়েছেন। আনন্দে উল্লাসে ছিল তার শৈশব, আবার দেখতেও ছিলেন সুন্দরী।

রাজাকার বাড়ির (বিটি বারী নামে পরিচিত) নেতৃত্বে তখন থমথমে শমশের নগর। একদিন ভোর বেলা তাকে তুলে নেওয়া হয় শমশের নগরের বন্দী শিবিরে। সেখানে পাকিস্তানি সেনা সুবেদার লালখান, মেজর আজিজ, ক্যাপ্টেন রফিক ও ক্যাপ্টেন দাউদের টানা ছয়মাস পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন।

বিজ্ঞাপন

যুদ্ধ শেষের দিকে একদিন ক্যাম্প থেকে তিনি প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসেন। কিন্তু ততদিনে জয়গুন নেছা তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গর্বে থাকা সেই শিশুর জন্ম হয়। নাম রাখা হয় নিমসানা আক্তার। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে নিমসানার বাবার পরিচয় না থাকায় বিপাকে পড়েন জয়গুন। এরপর কুলাউড়ার শরিফপুর ইউপির লালারচক গ্রামের ভূমিহীন ও সহজ-সরল মারুফ আহমদকে ‘ঘরজামাই’ করে বিয়ে দেওয়া হয় তার সঙ্গে। পরবর্তীতে নিমসানাকে মারুফের পিতৃ পরিচয়ে বিয়ে দেন তিনি।

নিমসানার বাবার পরিচয়ের জন্য যার কাছে বিয়ে দেওয়া হয় সেই সংসারে তার এক ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম দেন জয়গুন নেছা। এরপর স্বামীও অকালে মারা যান। বছরখানেক আগে একমাত্র ছেলেও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরপারে চলে যান। এখন তিনি এক মেয়েকে নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।

বার্তা২৪.কম এর সঙ্গে কথা হলে সে সময়ের নির্যাতনের বর্ণনা দেন জয়গুন নেছা খানম। তিনি বলেন, ‘ছোট একটি ঘরে আমাকে রাখা হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনারা সেই ঘরে আমার ওপর নির্যাতন চালাত। একটা সময় শুধু রক্ত দেখেছি। মাটিতে পড়ে গেলে ওরা চারজন আমাকে চেপে ধরত। আমি বাঁচার জন্য চিৎকার করলে একজন বাইরে থেকে কালো আঠা জাতীয় রাবার এনে আমার ঠোঁটে-মুখে লাগিয়ে দিতো। এভাবে ছয়মাস সহ্য করেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন আগে সেখান থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হই। সে সময় হানাদার বাহিনীর ধারাবাহিক নির্যাতনের কারণে আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যাই। বাড়ি ফিরে দেখি সবকিছু ধ্বংস। আত্মহত্যার জন্য হাতে ইঁদুর মারার ওষুধ নেই। তখন মা-বাবা বলেন, তুমি একলা না। আরও অনেক মেয়ে আছে। কিন্তু মানুষ বলতে থাকে, পেট হইছে। লজ্জায় ঘরে বসে থাকি। মা বলেন, যদি তুমি মর তবে বেহেশত পাইতায় নায়।’

জয়গুন নেছা বলেন, ‘অবশেষে ফাল্গুন মাসে আমার মেয়ের জন্ম হয়। নাম রাখা হয় নিমসানা আক্তার। এ মেয়ে বড় হতে থাকলে- লোকে বলতে থাকে, লালখানের পুড়ি। তখন কতো মানুষ যে আমাকে ঘৃণা ও অবজ্ঞা করেছে তা বলে শেষ করা যাবে না।’

আফসোস করে তিনি বলেন, ‘আমার এখন থাকার মতো একটি ভিটে নাই। অন্যের জায়গায় আশ্রয় নিয়ে আছি। এ অবস্থায় হয়তো চলে যাব পরপারে। কিন্তু মরার আগে আমি চাই রাষ্ট্র যেন আমাকে স্বীকৃতি দেয়। সমাজের মানুষ আমাকে যেভাবে ঘৃণা করেছে তাদের মুখে কালি দিয়ে যেন আত্মতুষ্টি নিয়ে মরতে পারি।’

বীরাঙ্গনাদের নিয়ে গবেষণা করে আসছেন মৌলভীবাজার টিচার্স ট্রেনিং ইনসটিটিউটের ইন্সট্রাক্টর দীপঙ্কর মোহান্ত। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘জয়গুন নেছার জীবনী সবার আড়ালেই ছিল। নানা বঞ্চনা নিয়ে তিনি লড়াই করে যাচ্ছেন। আমি বহু কষ্টে তার কাছে পৌঁছাই। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পিটিআইতে আমাদের একটি অনুষ্ঠানে তাকে পরিচয় করিয়ে দেই। আমি আশা করি রাষ্ট্র তাকে স্বীকৃতি দিয়ে পরবর্তী জীবনে গর্ব করে বাঁচার অধিকার দেবে।’