হাওর জুড়ে ধানে চিটা, দিশেহারা কৃষক
ফাগুনের মাঝামাঝি সময়। হাওরজুড়ে তাকালে যতদূর চোখ যায় যেন সবুজ জলরাশির এক মহাসমুদ্র। দক্ষিণা বাতাসে সবুজ ধান ক্ষেতের দোলানো দেখে দোল খায় কৃষকের হৃদয়ও।
হাজারো স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন কৃষকরা। কিন্তু কে জানত সেই স্বপ্ন দেখা দেবে দুঃস্বপ্ন হয়ে। মাত্র কয়েক দিন আগে যে কৃষক তার জমির পাশে দাঁড়িয়ে নির্ভাবনার স্বপ্ন বুনতেন, তারা আজ কাঁধের গামছা দিয়ে চোখের পানি মুছছেন। তার পুরো ধানক্ষেত পরিণত হয়েছে চিটায়। আগাম জাতের ধান রোপণ করেও বিপাকে পড়েছেন কৃষক।
হবিগঞ্জের প্রতিটি হাওরে কৃষকদের রঙিন স্বপ্নকে মলিন করে দিয়েছে এবারের ধানে চিটা। স্বপ্নগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে এখন দিশেহারা কৃষক।
জানা যায়, হাওর অধ্যুষিত এলাকা হবিগঞ্জের কৃষকরা সব সময়েই আগাম বন্যার ঝুঁকিতে থাকেন। পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে প্রায় প্রতি বছর আগাম বন্যায় তলিয়ে যায় কৃষকের সোনার ফসল।
গত বছরও ধান কাটার শেষের দিকে আগাম বন্যা এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। সে অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এবছর বোরো মৌসুমে অনেক কৃষক স্বল্পজীবী আগাম জাতের ৭৪ ও ২৮ ধান আবাদ করেন। কিন্তু ধানে ব্যাপক হারে চিটা দেখা দেয়ায় কৃষকের মাথায় হাত পড়েছে।
জেলার বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ ও লাখই উপজেলার কৃষকরা সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ওই সব এলাকার কৃষক ধানে চিটা দেখা দেয়ায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ১৮ হাজার ১৯৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। গেল দুই বছর ধরে আগাম বন্যায় অনেক কৃষকের স্বপ্ন পানিতে তলিয়ে যায়। এ বছর আগাম বন্যা থেকে রক্ষা পেতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরামর্শে অনেক কৃষকই স্বল্পজীবী আগাম জাতের ৭৪ ও ২৮ ধান আবাদ করেন। কিন্তু এতেও দেখা দিয়েছে বিপত্তি। ধানে ব্যাপক হারে চিটা দেখা দেয়ায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন অনেক কৃষকই।
সারা বছর কি করে চলবেন তার হিসেবে মেলাতেই ব্যস্ত কৃষকরা।
এ ব্যাপারে আজমিরীগঞ্জ উপজেলার নজরা কান্দা গ্রামের কৃষক রব উল্লাহ্ বলেন, ‘ধানের গাছগুলো অনেক ভালো হয়েছিল। কিন্তু ধান আসার পর এগুলোতে অর্ধেকের চেয়ে বেশি চিটা হয়ে গেছে।’
দরপুর গ্রামের কৃষক আশীষ সূত্রধরও জানালেন একই কথা। তিনি বলেন, ‘বন্যার হাত থেকে রক্ষার জন্য আগাম জাতের ধান চাষ করেছি। কিন্তু ধানে ব্যাপক হারে চিটা পড়েছে। এখন কি করব বুঝতে পারছি না।’
বানিয়াচং উপজেলার বাগাহাতা গ্রামের মকার হাওরের কৃষক খাজা হোসেন প্রায় ৭ একর জমিতে ৭৪ ধানের আবাদ করেছিলেন। তার সম্পূর্ণ জমিতে চিটা হয়েছে।
চমকপুর গ্রামের কৃষক আজিজ মিয়া জানান, ‘আমি ৭ কের (২৮ শতকে ১ কের) জমিতে ৭৪ ধান আবাদ করেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি ধানে কোনো চাল নেই।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দাবি, কৃষকের ভুলের কারণেই ৭৪ জাতের ধানে চিটা দেখা দিয়েছে। আর ২৮ জাতের ধানে কোনো চিটা পড়েনি বলে দাবি তাদের।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘৭৪ জাতের ধান নভেম্বরের পরে বোনা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কৃষকরা এর আগেই এগুলো রোপণ করে নিয়েছেন। এছাড়া মার্চ মাসের শুরুর দিকে ধানের ফুল আসে। এ বছর ওই সময়ে আবহাওয়ায় শীতের প্রভাব ছিল। যার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’
কি পরিমাণ ধানের ক্ষতি হয়েছে ? এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন- ‘বেশি না সামান্য’!