‘মেথরের ছেলে বইল্যা ইশকুলে পড়তে পারি নাই’
ইশকুলে (ইস্কুলে) গেলে কেলাসের (ক্লাসের) কেউ কথা কয় না। একলগে বেঞ্চে বইতে দেয় না। কিছু জিগাইলে ‘মেথর’ বইলা গালি দেয়। হুদাই আমার লগে কাইজ্জ্যা (ঝগড়া) করে, মারতে চায়। স্যারের কাছে কইলেও বিচার করে না। বিস্কুট দিয়া বাড়িত পাডাইয়া দেয়। ঠিকমতো পড়াইতো না। আমরাতো গরিব। ভালা ইশকুলে পড়নের টেকা নাই। তাই টু পর্যন্ত পইড়া ইশকুল ছাইড়া দিছি। অহন পেটের দায়ে রিকশা চালাই”।
বার্তা২৪.কমের কাছে কথাগুলো বলছিল হরিজন সম্প্রদায়ের রিকশাচালক নয়ন বাশফোড়(১৩)। তার বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌর শহরের গো-হাটা সংলগ্ন হরিজন কলোনিতে। তার বাবা মৃত মিন্টু বাশফোড়।
স্থানীয় ঘোষপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নের সময় বর্ণবৈষ্যমের শিকার নয়নের পড়াশোনার ইতি ঘটে।
সোমবার বিকালে রিকশাচালক নয়নের দেখা মেলে গৌরীপুর পৌর শহরের হাতেম আলী সড়কে। রিকশা নিয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিল নয়ন। ইশারায় ডাক দিতেই জিজ্ঞাসা করেন কই যাইবেন বাবু।
যাত্রীর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে গল্প হয় নয়নের।
বার্তা২৪.কমকে নয়ন বলেন, আমি ছোট থাকতেই বাবা মইরা গেছে। হেরপর মা পৌরসভার কাম কইর্যা (পরিচ্ছন্নতা কর্মী) অনেক কষ্ট কইর্যা আমগো সংসারডা চালাইছে। আমরাও অভাবে মইধ্যে খাইয়্যা-না খাইয়্যা বড় অইছি। ইচ্ছা ছিলো লেহাপড়া কইর্যা চাকরি করমু। তয় মেথরের ছেলে বইলা ইশকুলে পড়তেই পারলাম না। ইশকুল ছাড়নের পর মা কইতো বাড়িত বইয়্যা থাকলে খাইবি কি। টেকা কামানির একটা পথ বাইর কর। হেরপর থেইক্যা ভাড়ায় রিকশা চালানি ধরছি। তয় এই ছোড শইল লইয়্যা রিকশা চালাইতে মেলা কষ্ট অয়।
নয়নের মা মালতী বাশফোড় পেশায় পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা কর্মী। তার পরিবারের চার ভাই-বোনের মধ্যে বড় ভাই ফকিরা বাশফোড় ও বড় বোন রাধা বাশফোড় বিয়ে করে আলাদা হওয়ার পর পরিবারকে সাহায্য করে না। দ্বিতীয় ভাই রাখাল বাশফোড় পৌরসভায় পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করে। ছোট ভাই মুন্না বাশফোড় ইশকুলে না পড়তে পেরে বাড়িতেই থাকে।
প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত উপজেলার শহরের বিভিন্ন প্রান্তে রিকশায় যাত্রী নিয়ে ছুটে চলেন নয়ন। দিনশেষ তার আয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। সেখান থেকে রিকশার মালিককে ১৫০ টাকা দিতে হয়। বাকি যে টাকা থাকে সেখান ৫০ টাকা নিজের জন্য রেখে বাকিটা মায়ের হাতে তুলে দেন নয়ন।
বার্তা২৪.কমকে নয়ন বলেন, রিকশা চালানির সময় ইশকুলের পোলাপাইন আমারে দেখলেই টিটকারি মাইরা কয় ‘মেথরের ছেড়া রিকশা চালায়’। আবার আমি ছোড (ছোট) বইল্যা অনেক পেসেঞ্জার (যাত্রী) ধমক দিয়া ভাড়া কম দেয়। তহন খুব খারাপ লাগে। মনে মনে ভাবি কেউ যদি আমারে লেহাপড়ার খরচ দিতো, তাইলে আমি সত্যিই রিকশা চালানি ছাইড়্যা ইশকুলে ভর্তি হইতাম।
নয়নের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সূর্যটা তখন অস্ত যাওয়ার অপেক্ষায়। এমন সময় একযাত্রী এসে বললেন, ‘এই ছেলে রিকশা চালক কোথায় গেছে বলতে পারো? কথার রেশ টেনে নয়ন বলেন, আমিই চালক, কোথায় যাবেন বাবু? বিস্মিত হয়ে যাত্রী নয়নকে বললেন, তোমার তো এই বয়সে স্কুলে যাওয়ার কথা। তুমি রিকশা চালাও কেনো বাবা?। নয়নের সোজাসাপটা জবাব ইশকুলে তো মা ভর্তি করছিল। তয় মেথরের ছেলে বইল্যা ইশকুলে পড়তে পারি নাই। অহন পেটের দায়ে রিকশা চালাই”।