ঘরে আলো নেই, বিদ্যালয়ের বারান্দার সৌরবিদ্যুতই ভরসা
নির্জন রাত। চারদিকে অন্ধকার। ঝিঁঝি পোকা ডাকছে বিরামহীন। বিদ্যালয়ের বারান্দায় জ্বলছে সৌরবিদ্যুতের আলো। হঠাৎ বই হাতে এক যুবকের আগমন ঘটে বিদ্যালয়ে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বারান্দায় আলোর নিচে বসে বই পড়তে শুরু করেন তিনি। রাতের নির্জনতা ভেদ করে সেই পড়ার শব্দ ছড়িয়ে যেতে থাকে খানিকটা দূরে।
রোববার (২১ এপ্রিল) রাত পৌনে ১১টায় ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার পাইকুড়া নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বারান্দায় এ চিত্র দেখা যায়।
হাতে ইশারা দিতেই বই পড়ায় ছন্দ পতন ঘটে যুবকের। কাছে গিয়ে কথা বলে জানা যায় যুবকের নাম হুমায়ুন কবীর। বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বড়হিত ইউনিয়নের পাইকুড়া গ্রামে। তার বাবা শরাফত আলী। মা আজিজা খাতুন। দুই ভাই বোনের মধ্যে হুমায়ুন ছোট।
চলতি বছর ঈশ্বরগঞ্জ আইডিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেন হুমায়ুন। বাড়িতে আলো নেই তাই বিদ্যালয়ের বারান্দার সৌরবিদ্যুতের আলোতে পরীক্ষার প্রস্ততি নিচ্ছেন এই পরীক্ষার্থী।
বার্তা২৪.কমকে হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। জরাজীর্ণ বাড়িতে থাকি। ঘরে আলোর স্বল্পতা আছে। তাই নির্বিঘ্নে পড়াশোনা করতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গত এক বছর ধরে রাতের বেলা বিদ্যালয়ের বারান্দার আলোর নিচে বসে পড়াশোনা করছি। আগামী বুধবার আমার উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বিপণন বিষয়ের পরীক্ষা রয়েছে। তাই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে এখানে এসে পড়তে বসেছি। তবে শেয়াল ডাকায় কিছুটা ভয় করছে।’
হুমায়ুন কবীর ২০১১ সালে পাইকুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনী, ২০১৪ সালে পাইকুড়া নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে জেএসসি ও ২০১৭ সালে বড়হিত উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। এরপর ঈশ্বরগঞ্জ আইডিয়াল কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ভর্তি হন।
হুমায়ুনের বাবা একজন দিনমজুর। মা গৃহিণী। অভাবের তাড়নায় বড় বোন শরীফাকে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় বিয়ে দেয়া হয়। তবে শতকষ্টের মাঝেও দিনমজুর বাবা হুমায়ুনকে শিক্ষক হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। তাই ছেলেকে কাজে না পাঠিয়ে পড়াশোনায় উৎসাহিত করছেন।
হুমায়ূন কবীর বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘অভাবের তাড়নায় সময় মতো বই কিনতে পারিনি। ভালো প্রাইভেট পড়তে পারিনি। তাই পড়াশোনা অনেক বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন নিজে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছি। পাশাপাশি স্থানীয় সাংবাদিক ও শিক্ষকরাও আমাকে সহযোগিতা করছে।’
পড়াশোনা শেষ করে হুমায়ূন শিক্ষক হয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়াতে চান। কিন্তু নিজ ঘরে আলো না থাকায় তার নিজেরই পড়াশোনা করতে সমস্যা হয়। তবে হৃদয়বান কোনো ব্যক্তি যদি তার ঘরে একটা সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে তাকে রাতে বারান্দায় এসে আর পড়তে হতো না।
হুমায়ুনের মা আজিজা বেগম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘গরিব বইল্যা আমার পোলাডা ইশকুলের বারান্দাত গিয়া লেহাপড়া করে। আমরা মূর্খ মানুষ। তারপরেও পোলাডারে পড়ালেহা করাইয়ে মানুষ করবার চাইতাছি। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে ১০ টাকা কেজি চালের একটি কার্ড ছাড়া কোনো সহযোগিতা পাই নাই।’
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার উম্মে রুমানা তুয়া বার্তা২৪.কমকে জানান, প্রতিকূলতার মাঝেও পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া হুমায়ূনকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করা হবে।