কাঠগোলাপের ছাঁয়ায় চিরনিদ্রায় মুঘল শাসনামলের সখিনা বিবি
ভারত উপমহাদেশে মুঘল শাসনামলের ঐতিহাসিক ঘটনার জন্য বীরাঙ্গনা সখিনা বিবির বীরত্বের কথা কারোরই অজানা নয়। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মাওহা ইউনিয়নে রয়েছে এই নারীর সমাধিস্থল। সুনসান নিবিড় প্রকৃতির মাঝে কাঠগোলাপ গাছের ছাঁয়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সখিনা বিবি।
সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ঐতিহাসিক এই স্থানটি হতে পারে সম্ভাবনাময় একটি পর্যটন নগরী। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঐতিহাসিক এই স্থানটি বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে।
গৌরীপুর উপজেলা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার পূর্বে মাওহা ইউনিয়নের কেল্লাতাজপুর গ্রামের কুমড়ী নামক স্থানে সখিনা বিবির সমাধিস্থল। তবে গ্রামের লোকজন এটাকে মাজার বলেই জানে। সমাধিস্থলের চারপাশে নিচু সীমানা প্রাচীরের কারণে এর ভেতরকার ইট-সিমেন্টের বাঁধানো সমাধি ও দৃষ্টিনন্দন কাঠগোলাপ গাছগুলো নজরে পড়ে। আশপাশে বাড়িঘর কম থাকায় পুরো এলাকাতেই অদ্ভুত নীরবতা।
সখিনা বিবির সমাধিস্থলের ফটকের সীমনা প্রাচীরে শ্বেতপাথরে লেখা আছে বিবি সখিনার কাহিনী। কাহিনী অনুসারে কুমড়ী গ্রামকে অনেকে ‘কেল্লাতাজপুর’ নামেও চেনেন। এই কেল্লাতাজপুরের মুঘল দেওয়ান উমর খাঁর কন্যা সখিনা ছিলেন অপরূপ সুন্দরী ও সর্ববিদ্যায় পারদর্শী। তার রূপ-গুণের খ্যাতি আশপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি ৫০-৬০ মাইল দূরের বারো ভূঁইয়ার অন্যতম কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ির স্বাধীন শাসক ঈশা খাঁর দৌহিত্র ফিরোজ খাঁর কানেও পৌঁছে যায়। নানা কৌশলে বিবি সখিনার সঙ্গে যোগাযোগ হয় ফিরোজ খাঁর। অতঃপর দুজনের মধ্যে প্রণয় গড়ে উঠে।
কিন্তু উমর খাঁ মুঘল পক্ষীয় ছিলেন। অপরদিকে ঈশা খাঁর দৌহিত্র ফিরোজ খাঁ বংশানুক্রমে মুঘলদের শত্রু ছিলেন। তাই ফিরোজের পরিবার থেকে উমর খাঁয়ের দরবারে সখিনার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসলে তা প্রত্যাখান করা হয়।
এদিকে বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে বিশাল বাহিনী নিয়ে কেল্লাতাজপুরে অভিযান চালান ফিরোজ খাঁ। জয়ী হয়ে বিবি সখিনাকে নিয়ে জঙ্গলবাড়ি ফিরে যান।
এরপর পরাজিত উমর খাঁ মুঘলদের সহায়তায় বিশাল যুদ্ধ-বাহিনী নিয়ে জঙ্গলবাড়ি আক্রমণ করতে অগ্রসর হয়। ফিরোজ খাঁ পথিমধ্যে মুঘল বাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ করলে শুরু হয় প্রবল যুদ্ধ। বিশাল মুঘল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ফিরোজ খাঁ পরাজিত হয়ে বন্দী হন। সখিনাকে তালাক দেওয়ার জন্য তার ওপর চাপ দেন। কিন্তু ফিরোজ খাঁ তালাক দিতে রাজি হননি।
স্বামী বন্দী হবার সংবাদ সখিনার কাছে পৌঁছালে তিনি যুবকের ছদ্মবেশে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হন। ছদ্মবেশে সখিনা সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকলে পুনরায় ফিরোজের বিপর্যস্ত বাহিনী ঘুরে দাঁড়ায়।
নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে উমর খাঁ কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে মিথ্যা প্রচার করেন যে, যার জন্য এই যুদ্ধ সেই সখিনা বিবিকে ফিরোজ খাঁ তালাক দিয়েছে। আলামত হিসেবে ফিরোজের জাল করা স্বাক্ষর দেখানো হলো যুদ্ধক্ষেত্রে।
এরপর মুহূর্তে পাল্টে গেল যুদ্ধের ভাবগতি। যুবক (সখিনা) সেনাপতির মাথা ঘুরছে, দেহ কাঁপছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, ঘোড়ার লাগাম খসে পড়ছে আর তরবারির হাত হয়ে গেছে স্থবির। ধীরে ধীরে সেই যুবকের নিথর দেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শিরোস্ত্রাণ খসে গিয়ে বের হয়ে পড়ে তার মেঘ বরণ চুল। সবাই দেখল এতক্ষণ যে যুবক বীর বিক্রমে যুদ্ধ করছিলেন, তিনি আর কেউ নন, উমর খাঁর আদরের দুলালী সখিনা। বীরাঙ্গনা নারী সখিনা যে জায়গায় প্রাণত্যাগ করেন, সেই কুমড়ী নামক স্থানেই গড়ে উঠেছে তার সমাধি।
স্থানীয় বেখৈরহাটি নরেন্দ্র কান্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহ আলম বার্তা২৪.কমকে জানান, সখিনা বিবির সমাধিস্থলের অদূরেই ছিল বড় নদী। সেই নদী দিয়েই সৈন্যরা এসেছিল। ওই সময় গ্রামটি উঁচু মাটির সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। কিন্তু সময়ের স্রোতে সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও জানান, এক সময় ঐতিহাসিক এই স্থানটি উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে থাকলেও ২০০৭ সালে এর সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। তবে এই সমাধিস্থলকে ঘিরে যদি উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা, আবাসন সুবিধা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয় তাহলে এখানে পর্যটন নগরী গড়ে উঠবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারহানা করিম বার্তা২৪.কমকে জানান, সখিনা বিবির সমাধিস্থল সংস্কারের পাশাপাশি এখানে কীভাবে পর্যটন নগরী গড়ে তোলা যায় সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।