শিক্ষক হতে চান রিকশাচালক জালাল

  • রাকিবুল ইসলাম রাকিব, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ)
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মাদরাসা শিক্ষার্থী মো. শাহজালাল ওরফে জালাল। ছবি: বার্তা২৪.কম

মাদরাসা শিক্ষার্থী মো. শাহজালাল ওরফে জালাল। ছবি: বার্তা২৪.কম

পরিবারে অভাব থাকায় ছোটবেলায় অন্যের বাড়িতে কাজ নেন ময়মনসিংহের গৌরীপুর বোকাইনগরের বাঘবেড় গ্রামের মো. শাহজালাল ওরফে জালাল। ওই সময় সারাদিন কাজ শেষে রাতের বেলায় পড়তে বসতেন তিনি। কিন্তু এটা তার মালিক পছন্দ করত না। তারপরও লুকিয়ে পড়াশোনা করতেন তিনি। একদিন মালিক বিষয়টি টের পেয়ে বই-খাতা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে জালালকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়।

কিন্তু ইচ্ছা শক্তির কাছে কোনো বাধাই বাধা না। তাই রিকশা চালিয়েই এতদিন লেখাপড়া চালিয়ে এসেছেন তিনি। চলতি বছর আলিম (এইচএসসি সমমান) পরীক্ষাও দিয়েছেন। এখন তার একমাত্র স্বপ্ন লেখাপড়া শেষ করে শিক্ষক হবেন।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি বার্তা২৪.কমের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা জানান ময়মনসিংহের গৌরীপুর বোকাইনগর ফাজিল মাদরাসার শিক্ষার্থী মো. শাহজালাল ওরফে জালাল। মিয়া (৭০) ও আল্পনা বেগম দম্পতির তৃতীয় সন্তান তিনি।

জালাল বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বাবা ছিলেন দিনমজুর। তার আয়ে সংসার চলত না। তাই পেটের দায়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রতিবেশীর বাড়িতে কাজ নিয়েছিলাম। সারাদিন কাজ করে রাতের বেলা পড়তাম। কিন্তু মালিক বলত এখানে থাকলে কাজ করে খেতে হবে, তুই পড়াশোনা করতে পারবি না। কিন্তু আমি রাতে লুকিয়ে পড়তাম। একদিন মালিক বিষয়টি দেখতে পেয়ে বই-খাতা ছিঁড়ে ফেলে এবং আমাকে তাড়িয়ে দেয়। আটকে দেয় তিন মাসের বেতনও। এরপর আমি রিকশা চালিয়ে টাকা আয় করা শুরু করি। আয়ের ওই টাকায় সংসার চালানোর পাশাপাশি নিজে পড়াশোনা করছি। এ বছর আমি আলিম (এইচএসসি সমমান) পরীক্ষা দিয়েছি। এখন পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষক হতে চাই।’

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, জালালের বাবা বার্ধক্যজনিত কারণে বিছানায় পড়ে আছেন। বয়সের ভাড়ে মাও ঠিকমতো চলতে পারেন না। চার ভাইয়ের মধ্যে দুই ভাই ও এক বোন বিয়ে করে আলাদা হয়েছেন। আরেক ছোট ভাইও রিকশা চালায়। বাকি দুই বোন অষ্টম ও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। রিকশা চালিয়ে প্রতিদিন ৫-৬শ টাকা আয় করেন জালাল। এই টাকায় চলে সংসার, নিজের ও দুই বোনের পড়াশোনা এবং বাবা-মায়ের চিকিৎসার খরচ।

জালাল বাঘবেড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিইসি, কিল্লা বোকাই নগর ফাজিল মাদরাসা থেকে জেডিসি ও দাখিল পাস করেছেন। চলতি বছর ওই মাদরাসা থেকে আলিম পরীক্ষা দিয়েছেন। তবে ফল প্রকাশের আগেই অনার্সে ভর্তির খরচ নিয়ে শঙ্কায় আছেন তিনি।

জালাল বলেন, ‘রিকশা চালানোয় সহপাঠীরা কটূক্তি করে। কিন্তু সেটা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার অভিযোগ প্রতিবেশী সেই মালিকের প্রতি। কারণ ১১ বছর আগে ওই মালিক আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেও ৩ মাসের বেতন ৭৫০ টাকা পরিশোধ করেনি। জীবনের প্রথম উপার্জনের টাকার মায়াটা তাই এখনো ছাড়তে পারিনি।’

জালালের সঙ্গে কথা বলতে বলতে জোহরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। এমন সময় এক যাত্রী যেতে চাইলে জালাল বলেন, ‘এখন নামাজ পড়তে যাব। অন্য রিকশা দেখেন ভাই।’ পরে টুপি বের করতে করতে জালাল বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বুঝলেন ভাইয়া, রোজার মাসে নামাজের ফজিলত অনেক। শুধু নিজের লাভের চিন্তা করলে হবে না। আল্লাহর সন্তুষ্টিও অর্জন করতে হবে।’

জালালের বিষয়ে কিল্লা বোকাইনগর ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ ছায়েদুল হক বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘জালাল রিকশা চালিয়ে সংসার ও পড়াশোনার খরচ বহন করে। বিষয়টি জানার পর মাদরাসায় তাকে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছি। সে এ বছর আলিম পরীক্ষা দিয়েছে। আমি তার সফলতা কামনা করি।’