ঈদের ছুটি কাটুক হাওর-পাহাড়-অরণ্যে
বাঙালি জাতি ভ্রমণপ্রিয়, তবে কর্মব্যস্ততায় পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়ানোর সময় হয়ে ওঠে না। তবে ছুটি পেলেই পরিবার নিয়ে অনেকেই ঘুরতে বের হন। বিশেষ করে ঈদের ছুটিতে সবাই কাছে বা দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে পছন্দ করেন। নিজের সাধ্যের মধ্যে অনেকে দেশ বা বিদেশের দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে যাবেন। এক্ষেত্রে ভ্রমণপ্রিয় মানুষের পছন্দের জায়গা হতে পারেন প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত হবিগঞ্জ।
হবিগঞ্জে দর্শনীয় স্থানগুলো হলো
রেমা-কালেঙ্গা বন:
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বন রেমা-কালেঙ্গা অবস্থিত হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায়। আয়তন প্রায় ১ হাজার ৭৯৫ হেক্টর। কালেঙ্গা, রেমা, ছনবাড়ী আর রশিদপুর চারটি বিটের মধ্যে রেমা, কালেঙ্গা আর ছনবাড়ী এলাকার বিস্তীর্ণ জঙ্গল নিয়ে রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য গঠিত। রয়েছে বেশ কয়েকটি পাহাড়-টিলা।
বন বিভাগের তথ্যমতে, রেমা-কালেঙ্গায় ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, সাত প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬৭ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এছাড়া এখানে বিরল অনেক প্রজাতিসহ ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্মও রয়েছে। অভয়ারণ্যের ভেতরে রয়েছে সু-উচুঁ একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় বনের ভেতরের দূর-দূরান্তের মনোরম দৃশ্য। আর টাওয়ারের নিচেই আছে আঁকাবাঁকা একটি লেক।
বাংলাদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবনধারাও দেখা যেতে পারে এখানে। রেমা-কালেঙ্গা বনের ভেতরেই রয়েছে ত্রিপুরা, সাঁওতাল, তেলুগু ও উড়ংসহ চারটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস। যাদের অতিথিপরায়ণ যে কাউকে মুগ্ধ করবে।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান:
চারদিকে গাঢ় থেকে হালকা জঙ্গল আর পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত এ উদ্যানে নানান জাতের পাখি আর বন্যপ্রাণীদের আশ্রয়স্থল। উদ্যানের ভেতরে এক সময় সাতটি ছড়া বা ঝরণা ছিল। সেখান থেকেই উদ্যানটির নামকরণ হয় সাতছড়ি। প্রায় ২৪৩ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত উদ্যানে ১৪৯ প্রজাতির পাখি, ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৬ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে।
জলাবন লক্ষীবাউর:
হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় লক্ষীবাউর সোয়াম্প ফরেস্ট (জলাবন)। যা এলাকাবাসীর কাছে ‘খড়তির জঙ্গল’ নামেও পরিচিত। বর্ষাকালে চারদিকে হাওরের পানি আর জঙ্গলের গাছপালার সবুজ অরণ্য পরিবেশকে নান্দনিক করে তুলেছে। দূর থেকে জঙ্গলটিকে ভাসমান জঙ্গল মনে হয়।
হিজল, করচ, বরুণ, কাকুরা, বউল্লা, খাগড়া, চাউল্লা, নলসহ অসংখ্য গাছ ও গুল্মে পরিপূর্ণ এই জলাবন। এখানে রয়েছে মেছোবাঘ, শিয়াল, গুইসাপ, কেউটে, লাড্ডুকা, দারাইশসহ অনেক বিষধর সাপ। বর্তমানে বিভিন্ন জাতের বক, পানকৌড়ি ও বালিহাঁস দেখা গেলেও শীতকালে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে নির্জন এই জলাবন।
দ্য প্যালেস রিসোর্ট:
বিলাসবহুল সময় কাটাতে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার পুটিজুড়ি এলাকায় রয়েছে দ্য প্যালেস রিসোর্ট। সবুজ টিলার চূড়ায় গড়ে তোলা প্যালেসটি দেখলে মোগল আমলের রাজপ্রাসাদ মনে হবে। এক টিলা থেকে অন্য টিলায় যাতায়াতের জন্য তৈরি করা হয়েছে দুটো ঝুলন্ত সেতু। পাশে রয়েছে থরে থরে ফল আর সবজির বাগান।
রিসোর্টের নূন্যতম ভাড়া ১১ হাজার ৫০০ টাকা। আর তিন কক্ষের প্রেসিডেনশিয়াল ভিলার ভাড়া প্রতিদিন এক লাখ ২০ হাজার টাকা! প্যালেসে রয়েছে ওয়াটার জোন, চীনা নৌকা, বিলিয়ার্ড, রিমোট কন্ট্রোল কার রেসিং, ফুটবল, বাস্কেটবল আর টেনিস গ্রাউন্ড।
কমলা রাণীর দিঘী:
কমলা রাণীর দিঘী বা সাগর দিঘীর আয়তন প্রায় ১৩ একর। পল্লী কবি জসিম উদ্দিন সাগর দিঘীর পশ্চিম পাড়ে বসে কমলা রাণীর উপন্যাস রচনা করেন।
বিথঙ্গল আখড়া:
হবিগঞ্জ শহর থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার অতিক্রম করে কালারডুবা খেয়াঘাট। সেখান থেকেই ট্রলার ভাড়া করে প্রায় ১৬ কিলোমিটার কিংবা বানিয়াচং উপজেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিথঙ্গল আখড়া। ৬০০ বা ৪০০ বছর পূর্বে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ গোস্বামী বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের জন্য বিথঙ্গলে এসে এই আখড়া প্রতিষ্ঠা করেন। আখড়ায় শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ গোস্বামীর সমাধিস্থলের ওপর একটি সুদৃশ্য মঠ প্রতিষ্ঠিত। মঠের সামনে একটি নাট মন্দির এবং পূর্ব পার্শ্ববর্তী একটি ভান্ডার ঘর এবং দক্ষিণে একটি ভোগ মন্দির রয়েছে। এছাড়া আরও কয়েকটি পুরাতন ইমারত আছে।
আখড়ায় অনেক দর্শনীয় বস্তুর মধ্যে রয়েছে ২৫ মণ ওজনের শ্বেত পাথরের চৌকি, পিতলের সিংহাসন, রথ, রৌপ্য নির্মিত পাখি, মুকুট ইত্যাদি। বিশাল এই আখড়ায় মোট কক্ষ আছে ১২০টির মতো। আখড়া ও হাওরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতেই দর্শণার্থীরা এখানে আসেন।
তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধ:
হবিগঞ্জের মাধবপুর তেলিপাড়া চা বাগানে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধে স্মৃতি বিজরিত তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধ। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলোটিতে দেশকে স্বাধীন করার জন্য ঐতিহাসিক এক শপথ অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকেই সমগ্র রণাঙ্গনকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী।
বৈঠক শেষে এমএজি ওসমানী নিজের পিস্তলের ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের শপথ নেন। বর্তমানে সেখানে রয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। পাশে বাংলো ও অপরূপ একটি লেক, যা দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে।
চা বাগানের অপরূপ দৃশ্য:
সবুজ কচি পাতার চা বাগান দেখতে কে না ভালোবাসে। তাইতো নয়নাভিরাম সবুজ চা বাগান, আঁকাবাঁকা পাহাড় টিলা দেখতে চলে আসতে পারেন হবিগঞ্জে। চুনারুঘাট, নবীগঞ্জ ও মাধবপুর উপজেলায় রয়েছে ৫৪টি চা বাগান।
বর্ষায় অপরূপ হাওর:
কর্মব্যস্ত জীবনে গ্রামে যাওয়া হয় না অনেকেরই। অথচ বর্ষায় হাওরের সৌন্দর্য দেখতে পছন্দ করেন সবাই। হবিগঞ্জে আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, নবীগঞ্জ, লাখাই উপজেলা বিস্তৃর্ণ এলাকায় রয়েছে হাওর। যেখানে ভ্রমণ করলে যেকারও মন ভরে উঠবে। এছাড়া, হাওরের বুকে পানিতে ভেসে থাকা হিজল, করছ, বল্লা, ছালিয়া, নলখাগড়াসহ নানান প্রজাতির বনজ ও জলজ প্রাণি আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
অন্যান্য দর্শণীয় স্থান:
হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার সাতশ বছরের পুরনো শংকরপাশা উচাইল শাহী মসজিদ। সেখানে রয়েছে মুগল আমলের অনেক স্মৃতি চিহ্ন। মাধবপুর উপজেলার অবস্থিত রাবার বাগান, ফ্রুট ভ্যালি, শাহজী বাজার পাওয়ার প্লান্ট, এশিয়া মহাদেশের সর্ব বৃহত্ত গ্যাস ক্ষেত্রে বিবিয়ানা এবং গ্রিনল্যান্ড পার্ক।