আমিরাতে অসহায় জীবন কাটাচ্ছে হবিগঞ্জের কয়েক হাজার শ্রমিক
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। ধনী দেশের তালিকার মধ্যে অন্যতম রাষ্ট্র। দেশটিতে রয়েছে বাংলাদেশের জন্য বিশাল শ্রমবাজার। পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে সেখানে পাড়ি জমিয়েছেন কয়েক লাখ বাংলাদেশি। কিন্তু পরিবারের সচ্ছলতা ফেরানো কিংবা স্বপ্নপূরণ তো দূরের কথা, উল্টো নিজেদেরই না খেয়ে মরতে হচ্ছে বিদেশ-বিভুঁইয়ে।
তিন থেকে চার মাস ধরে কাজ করেও বেতন পাচ্ছেন না আরব আমিরাতে কর্মরত হবিগঞ্জের কয়েক হাজার শ্রমিক। দিনরাত পরিশ্রম করিয়ে বেতন দিচ্ছে না কতিপয় বাঙালি দালাল। বিশেষ করে ভিজিট ভিসায় দেশটিতে যাওয়া বেশিরভাগ শ্রমিক এমন সমস্যার সম্মুখীন। কিন্তু যথাযথ ‘আইডি কার্ড’ না থাকায় দেশি-বিদেশি কোনো সংস্থার কাছে অভিযোগও করতে পারছে তারা।
আরক আমিরাতে যাওয়া প্রবাসীদের তথ্যমতে- দুবাই, শারজা, আবুধাবী, আজমান, আল-আইন ও ফজিরা শহরে হবিগঞ্জের প্রায় ত্রিশ হাজারের অধিক শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে ভিজিট ভিসায় সেখানে বসবাস করছেন অন্তত ১২-১৪ হাজার শ্রমিক। যাদের কাছ করতে হচ্ছে বাঙালি লাইসেন্সধারী শ্রমিকের আওতায়। আইডি না থাকায় দালালদের কথামত বিভিন্ন কোম্পানিতে কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে। অথচ এত পরিশ্রমের পরও অনেকেই তিন মাস আবার কেউ চার মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। বেতনের কথা বললে, দেই-দিচ্ছি করে কালক্ষেপন কিংবা অচিরেই দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। আবার কখনও কখনও হুমকি-ধামকি দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে এসব শ্রমিদের। কেউ আবার আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে চলছেন। যাদের আত্মীয়-স্বজন নেই তারা বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে চলছেন।
প্রবাসীদের তথ্যমতে, এভাবে বেতন না পাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। যার অধিকাংশই হবিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার। তবে সবচেয়ে বেশি রয়েছে বাহুবল উপজেলার। এছাড়া বানিয়াচং, চুনারুঘাট ও লাখাই উপজেলার শ্রমিকও রয়েছেন।
এমন পরিস্থিতির কারণে সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে আরব আমিরাত যাওয়া অনেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। কেউ এমন শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে স্বেচ্ছার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ আরব আমিরাত ইমিগ্রেশন ও বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আউট পাস সংগ্রহ করে দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন।
অনেক শ্রমিক অভিযোগ করেন, দালালদের মাধ্যমে ৪-৫ লাখ টাকা খরচ করে পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে সংযুক্ত আবর আমিরাতে পাড়ি জমিয়েছেন। দালালরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা ডিউটি, সপ্তাহে ১ দিন ছুটি ও বেসিক ১৩৫ দিনার (২৭ হাজার ৭৩০ টাকা) বেতন দেবে বলেছিল। কিন্তু এখন তাদেরকে ১২ থেকে ৩৬ ঘণ্টা পর্যন্ত একটানা ডিউটি করিয়ে গত ৩-৪ মাস ধরে বেতনই দেয়নি। উল্টো ছোটখাট কোনো ভুল হলে ৫০ দিনার (১০ হাজার ২৭০ টাকা) বেতন কাটা হয়।
ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টায় সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়া হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ইউনিয়নের মানিকপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. আরশ মিয়া বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে মুঠোফোনে বলেন, ‘দেশে হাঁসের খামার করতাম। ভালোই দিন কাটছিল। দুবাই এসেছিলাম বেশি রোজগারের আশায়। কিন্তু এখানে এসে দেখি ভাগ্য পরিবর্তন তো দূরের কথা, ঠিকমতো খাইতেই পারতেছি না।’
তিনি বলেন, বাড়িতে সবাই আশায় আছে। চার মাস যাবত এক কোম্পানিতে কাজ করতেছি। এখন পর্যন্ত এক টাকাও পাইনি। বাড়ি থেকে বারবার টাকার জন্য টেলিফোন আসছে। এখন কি করব কিছুই বুঝতে পারতেছি না।’
চুনারুঘাট উপজেলার উবাহাটা ইউনিয়নের উবাহাটা গ্রামের বাসিন্দা মো. কামরুল ইসলাম নামে এক প্রবাসী শ্রমিক বলেন- ‘এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে পরিবারের জন্য দুবাই এসেছিলাম। এসে খুব বিপদে পড়েছি। এক সাইটে কাজ করেছিলাম তিনমাস ধরে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক টাকাও পাইনি। বাড়িতে টাকা দেওয়াতো দূরের কথা, কিভাবে খাবো, রুম ভাড়া দেবো বুঝতে পারছি না।’
বাহুবলে উপজেলার সাতকাপন ইউনিয়নের গগলপুর গ্রামের মো. বিলাথ মিয়া নামের এক শ্রমিক বলেন- ‘কয়েকমাস ধরে বেতন না পাওয়ায় সহকর্মীর কাছ থেকে টাকা ধার করে চলতে হচ্ছে। কিন্তু বাড়িতে দুশ্চিন্তা করবে বলে কিছুই বলতে পারছি না।’
একই ইউনিয়নের বক্তারপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. হাফিজ মিয়া বলেন- ‘বাড়ি থেকে টাকা এনে চলতে হচ্ছে। ৪-৫ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ এসেছিলাম পরিবারের দায়িত্ব নেব বলে। উল্টো আমার ভরণ-পোষণ এখনও পরিবারকেই করতে হচ্ছে।’
বাহুবল সদরের বাসিন্দা মো. সেলিম মিয়া বলেন- ‘অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ এসেছিলাম। কিন্তু স্বপ্নপূরণ দূরের কথা, এখন না খেয়ে মরতে হবে মনে হচ্ছে।’ তিনি বলেন- ‘বাঙালি হয়েও বাঙালির দুঃখ বুঝে না। আমাদের জীবন নিয়ে খেলছে কিছু অসাধু বাঙালি। আমার এর প্রতিকার চাই।’