পাহাড়ি ঢলে বয়ে আসা বালি-পাথরে হুমকিতে পরিবেশ
সুনামগঞ্জের সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বয়ে এসেছে প্রায় ৪০টি ছড়া। এসব ছড়া পাহাড়ি ঢলে বাংলাদেশে বয়ে আনছে বিপুল পরিমাণ বালি ও পাথর। আর এসব বালি ও পাথরের আগ্রাসনে বসতবাড়ি, ফসলি জমি, মসজিদ, স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা এখন হুমকির মুখে। পাশাপাশি প্রায় ২৩টি নদীর নাব্যতা কমে গেছে। ফলে হুমকিতে আছে এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ।
জানা গেছে, সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত এলাকা তাহিরপুর, বিশ্বাম্ভরপুর, দোয়ারা বাজার, ছাতক, ধর্মপাশা, জেলা সদরের ডলুরা, নারায়নতলা দিয়ে মেঘালয় পাহাড় থেকে বয়ে আসছে এসব ছড়া ও নদী। এসব ছড়া ও নদীর ঢলে বিপুল পরিমাণ বালু ও পাথর বাংলাদেশে প্রবেশ করায় পুকুর ভরাট হচ্ছে, ফসলি জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। ফলে মরু ভূমিতে পরিণত হচ্ছে এলাকাটি।
অন্যদিকে বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের প্রবল স্রোতে নদী ভাঙন বেড়ে যাওয়ায় ঘর-বাড়ি হারিয়ে পথে বসেছেন স্থানীয়রা। বালুতে ভরাট হওয়া নদীগুলোর ধারণ ক্ষমতা কমায় অল্প পানিতেই নদী ভরে যায়। ফলে নিম্নাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়।
আরও জানা গেছে, তাহিরপুর উপজেলার পাঁচশোলা, বিকিবিল, লালকুড়ি, লোভার হাওর ও বিশ্বাম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরসহ জেলার দোয়ারা বাজার উপজেলার খাশিয়ামারা, সোনালী তলা, টিলাগাঁও, মহবতপুর, ছাতক উপজেলার ইছামতি সীমান্ত এলাকাসহ বিভিন্ন নদী ও হাওরগুলোতে চৈত্র মাসে ১০-১২ হাত পানি থাকতো। কিন্তু এসব নদী এখন বালুর চড়ে পরিণত হয়ে নাব্যতা হারিয়েছে। কোনও কোনও নদীর গতিপথও পরিবর্তন হচ্ছে।
তাহিরপুর সীমান্তের চাঁনপুর গ্রামের আজিজুল ইসলাম ও নুরসহ স্থানীয়রা জানান, ২০০৮ সালের ২০ জুলাই অতি বৃষ্টিতে তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তে কালো পাহাড় নামকস্থানে পাহাড় ধস হয় এবং পাহাড়ি ঢলে চাঁনপুর সীমান্তের ঘর-বাড়ি হারায় শত শত পরিবার। এছাড়া বালির নিচে চাপা পড়ছে সীমান্ত স্কুল, মসজিদসহ শত শত একর ফসলি জমি। ফলে পাহাড় ও আশপাশে বসবাসকারী পরিবারগুলো বৃষ্টি হলেই পাহাড় ধসের আতঙ্কে থাকেন।
অভিযোগ আছে, ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় হলেও বালু ও পাথর সরাতে আজ পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা শফিকুল, জামাল, সুমন জানান, সুনামগঞ্জ জেলা সীমান্তে পাহাড়ি ছড়া দিয়ে ভারত থেকে কয়লা, চুনা পাথর, গরু আনে চোরাকারবারিরা। এতে রাজস্ব হারায় সরকার। তবে মাঝে মাঝে বিএসএফএ’র হাতে আটক হয় অনেকে। প্রশাসনের নজরদারী না থাকায় সীমান্তে বসবাসকারী মানুষদের আতঙ্কে বাস করতে হয়।
তাহিরপুর সীমান্ত এলাকার চাঁনপুর, লাকমার কৃষকরা জানান, আগে ছোট-বড় হাওরের ফসলি জমিতে প্রতি কিয়ারে ১৮-১৯ মণ ধান পাওয়া যেত। কিন্তু ছড়ায় বয়ে আসা বালি, মাটি, পাথরে এসব জমি এখন চাষের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশবিদদের দাবি, প্রাথমিকভাবে এসব পাহাড়ি ছড়া দিয়ে নেমে আসা পানির সাথে পাথর ও বালি আগ্রাসন বন্ধ করা বেশ কঠিন। তবে এসব পাহাড়ি ছড়ার সাথে মাঝারি আকৃতির নালা তৈরি করে নদীর সাথে প্রবাহিত করা গেলে ক্ষতি কম হবে।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক পিযুস পুরকাস্থ টিটু বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘আগ্রাসী পাহাড়ি ঢলে অনেক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। সেই সাথে ফসলি জমিসহ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র নষ্ট হচ্ছে। এসব পাহাড়ি ঢল ফেরানো যাবে না। তবে এ বিষয়ে বিশেষ গবেষণা করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘ভারতীয় মেঘালয় পাহাড় থেকে ছড়ার মাধ্যমে বালি ও পাথর তাহিরপুর সীমান্তে আসছে। এতে স্থানীয়রা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করে একটি সমাধান বের করা প্রয়োজন।’
বিজিবি ব্যাটালিয়ন-২৮ এর অধিনায়ক মো. মাকসুদুল আলম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘আমরা শিগগিরই জেলা প্রশাসকসহ সীমান্তে বালু ও পাথর আগ্রাসন সরজমিনে পরিদর্শন করবো। পরবর্তীতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সুনামগঞ্জের রুটিন দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসক মো. শরিফুল ইসলাম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে সবার সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’