আবাসিকের গ্যাস বিল বৃদ্ধির প্রস্তাব, বিইআরসির বাছাই কমিটি

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আবাসিকের গ্যাস বিল বৃদ্ধির প্রস্তাব

আবাসিকের গ্যাস বিল বৃদ্ধির প্রস্তাব

মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকের গ্যাস বিল বাড়ানোর আবেদন যাচাই-বাছাই করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। পরিচালক (গ্যাস) প্রকৌশলী মো. ফজলে আলমকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে।

বিইআরসির কমিশনের সভায় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই সভার কার্যপত্র এখনও প্রস্তুত হয়নি। প্রস্তুত হলেই কমিটি কাজ শুরু করবে বলে সূত্র জানিয়েছে। তিতাসের গ্যাস বিল বাড়ানোর প্রস্তাব কমিশনের সভায় তোলার কথা গত ৩ ডিসেম্বর জানিয়েছিলেন বিইআরসি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন।

বিজ্ঞাপন

মিটার বিহীন আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের নির্ধারিত বিল আদায় করা হয়। বর্তমানে দুই চুলা ৬০ ঘনমিটার ও এক চুলা ৫৫ ঘনমিটার গ্যাসের দাম আদায় করা হয়। গ্রাহক ব্যবহার করুক, না করুক অথবা বেশি ব্যবহার করলেও নির্ধারিত বিলেই তাকে দিতে হয়। তিতাস গ্যাস বিদ্যমান এক চুলা ৫৫ ঘনমিটার (৯৯০ টাকা) থেকে বাড়িয়ে ৭৬.৬৫ ঘনমিটার (১৩৭৯.৭০ টাকা), দুই চুলা ৬০ ঘনমিটার (১০৮০ টাকা) থেকে বাড়িয়ে ৮৮.৪৪ ঘনমিটার (১৫৯১.৯২) করার আবেদন করেছে বিইআরসির কাছে। আবেদনটি চলতি বছরে মে মাসে জমা হয় বিইআরসিতে। ব্যাপক বিতর্কের পর বিষয়টি অনেকটা ধামাচাপা পড়ে যায়।

তবে সম্প্রতি আবার তৎপরতার শুরুর কথা জানা গেছে। বিইআরসির চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চাইলে বলেন, আগে শুধু তিতাস গ্যাসের প্রস্তাব এসেছিল। আরও কয়েকটি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি রয়েছে। যে কারণে পেট্রোবাংলার মতামত চাওয়া হয়েছিল। এখন পেট্রোবাংলার মতামত পাওয়া গেছে।

বিজ্ঞাপন

গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের এখতিয়ার রয়েছে বিইআরসির হাতে। যদিও আইন সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাহী আদেশেও দাম সমন্বয়ের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। একাধিক দফায় বাড়ানোর নজিরও রয়েছে। বিইআরসির আইন অনুযায়ী কোনো আবেদন এলে প্রথমে কমিশনের বৈঠকে তোলা হয়। সেখানে অনুমোদিত হলে গণশুনানিতে দেওয়া হয়। অথবা কমিশন সভায় প্রস্তাব বাতিল করে দিতে পারে। তেমন নজিরও বিদ্যমান।

বিইআরসি সর্বশেষ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশ দেয় ২০২২ সালের ৫ জুন। বিইআরসি আদেশ দেওয়ার আগে মার্চে গণশুনানি গ্রহণ করে। তখন বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের পরিসংখ্যানে দেখা যায় গড়ে এক চুলা ৪০ এবং দুই চুলা সর্বোচ্চ ৫০ ঘনমিটার ব্যবহার করছে। প্রিপেইড গ্রাহকের ব্যবহারের পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে এক চুলা ৭৩.৪১ ঘনমিটার ও দুই চুলা ৭৭.৪১ ঘনমিটার থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়।

বিইআরসির তৎকালীন (২০২২ সাল) সদস্য (গ্যাস) মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমারতো মনে হয় ৫০ ঘনমিটারের নিচে করা উচিত ছিল। প্রথমবার জন্য ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়েছিল। তখন শর্ত দেওয়া হয়, প্রিপেইড মিটার বসানো এবং পরবর্তীতে কমিয়ে আনার।

আপনাদের সময়ে আদেশটি হয়েছে। কীসের ভিত্তিতে এক ও দুই চলা যথাক্রমে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়েছে। এমন প্রশ্নের জবাবে মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, তাদের যে সাড়ে ৩ লাখ প্রিপেইড মিটার ছিল সেখানে দেখা গেছে গড়ে ৪৫ ঘনমিটারের কম ব্যবহৃত হয়েছে। প্রিপেইড মিটারের বিলের তথ্য দেখলেই বুঝতে পারা যায়। বিষয়টির জন্য রকেট সায়েন্স জানা দরকার হয় না।

জুনের ওই আদেশে আবাসিকে প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের তৎকালীন দর ১২.৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা করে দেয়। সে হিসেবে নন মিটার একচুলার ৯৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি হয়ে ৯৯০ টাকা, দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে ১০৮০ টাকা করা হয়।

তিতাস দাবি করেছেন, নির্ধারিত পরিমাণের (৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার) চেয়ে মিটারবিহীন গ্রাহকরা বেশী গ্যাস ব্যবহার করে। ফলে সিস্টেম লস বৃদ্ধি পেয়েছে। এক চুলা ৭৬.৬৫ ঘনমিটার ও দুই চুলা ৮৮.৪৪ ঘনমিটার করার আবেদন করা হয়েছে। বিইআরসি আগে যে আদেশ দিয়েছে তা বাস্তব সম্মত ছিল না।

লালমাটিয়ার বাসিন্দা ডা. মনিরুল ইসলাম গ্যাসের প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করেন। মাসে ৫০০ টাকার গ্যাসেই শেষ করতে পারেন না। মিটার ভাড়াসহ কোনো কোনো মাসে ৪০০ টাকাতেই চলে যায়। প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারীরা অর্ধেক খরচেই মাস পার করছে। অথচ প্রায় ৩৪ লাখ মিটার বিহীন আবাসিক গ্রাহকের কাছ থেকে দ্বিগুণ বিল আদায় করা হচ্ছে। সেই বিলও আরও বাড়াতে তৎপর হয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

গ্যাসের প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা গেলে এই সংকট থাকে না। প্রথম দিকে গ্যাসের প্রি-পেইড মিটার স্থাপনে বেশ তোড়জোড় ছিল। এখন যতটা পারা যায় বিলম্বিত করার কৌশলী অবস্থান নিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। প্রথম দিকে তারা বলেছিলেন আবাসিকে অনেক বেশি গ্যাস পুড়ছে, মিটার স্থাপন করলে তাদের রাজস্ব বেড়ে যাবে। কিন্তু লালমাটিয়া (২০১৬ সালে) এলাকায় প্রথম যখন মিটার বসানো হলো তার রেজাল্ট এলো উল্টো। দেখা গেলো প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারীদের বিল আসছে দেড়’শ থেকে আড়াই’শ টাকা। যাদের মিটার নেই তাদের কাছ থেকে তখন বিল আদায় করা হচ্ছিল দুই চুলা সাড়ে ৪’শ টাকা।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পূর্বে বলেছিলেন, প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের পাইলট প্রকল্পের রেজাল্ট ভালো। দুই চুলায় মাসে ৩৩ ঘনমিটার গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে।

বিইআরসি ২০১৮ সালে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের দ্রুত করার আদেশ প্রদান করে। গ্রাহক যাতে নিজেরা মার্কেট থেকে মিটার কিনে স্থাপন করতে পারে সেই সুবিধা উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর প্রণীত নীতিমালায় বলা হয়েছে গ্রাহক নিজের পছন্দমতো দোকান থেকে মিটার ক্রয় করে বিতরণ কোম্পানিতে জমা দেবেন। বিতরণ কোম্পানিগুলো পরীক্ষা করে গ্রাহকের আঙ্গিনায় স্থাপন করবে। তবে নানা মারপ্যাঁচ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। কোম্পানিগুলো বাজারের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে মিটার কিনেই নিজেরাই স্থাপন করছে, তাও চলছে ঢিমেতালে। তারা দুই দিকে ব্যবসা জারি রাখতে চায়। এক গ্রাহকের পকেট কাটা, অন্যদিকে প্রকল্পের নামে বেশি দামে মিটার কিনে ব্যক্তি বিশেষে অনৈতিক সুবিধা নেওয়া।

বিইআরসি ২০২২ সালে প্রিপেইড মিটার সংক্রান্ত একটি চিঠি ইস্যু করে। তাতে বলা হয় ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর গেজেটে পর্যায়ক্রমে সকল আবাসিকে প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয় বিতরণ কোম্পানিগুলোর গৃহীত ব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত পর্যা‌য়ে নয়। নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে প্রি-পেইড মিটার স্থাপন কার্যক্রম ত্বরান্বিত হবে বলে কমিশন আশা করে।