ইসিটিতে সার্বভৌমত্বকে খাটো করা হয়েছে: তুরিন আফরোজ
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সনদ চুক্তিতে (ইসিটি) ১৮-ধারায় বলা হয়েছে, সার্বভৌমত্ব থাকবে তবে ‘রুলস অব ইন্টারন্যাশনাল ল’ মেনে। আবার ধারা ১৮(২) এ বলা হয়েছে কোন ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে ইসিটি প্রাধান্য পাবে।
তাহলে কিভাবে সার্বভৌমত্ব থাকলো এমন প্রশ্ন তুলেছেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। ইসিটিতে সার্বভৌমত্বকে খাটো করা হয়েছে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত স্বাক্ষর করেনি। স্বাক্ষরের প্রথম ধাপ শেষ করে পর্যবেক্ষক হিসেবে রয়েছে বলে জানান তিনি।
শনিবার (২৩ ডিসেম্বর) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) আয়োজিত ‘জ্বালানি উন্নয়নে বিনিয়োগ চুক্তি’ শীর্ষক নাগরিক সংলাপে তিনি এমন তথ্য তুলে ধরেন।
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, এখন প্রশ্ন হচ্ছে যাবো কি, যাবো না, কি পাবো, কি পাবো না। কি হারাবো সেই অনিশ্চয়তা চলছে। এতে স্বাক্ষর করার অর্থ হচ্ছে সবকিছু বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে। ধারা ১৩-তে বলা হয়েছে, বিনিয়োগকারী চাইলে বিনিয়োগ ও মুনাফা বিনা বাধায় ফেরত নিতে পারবে। স্বাগতিক দেশ বাধা দিতে পারবে না। এশিয়ান ক্রাইসিসে আমরা দেখলাম অনেক কোম্পানি চলে গেলে। আবার যদি শ্রীলংকার মতো কোন অবস্থা হয় তখনও আটকাতে পারবো না।
তিনি বলেন, ধারা ১২-তে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিগ্রহে বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ধরেন আমি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, আমি রাষ্ট্রকে দেখবো না তার ক্ষতিপূরণ দেবো। তারা সন্তুষ্ট না হলে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে যেতে পারবেন। সেখানে মামলা পরিচালনার অর্ধেক খরচ আমাকে দিতে হবে।
ধারা ১৪ (১) এ বলা হয়েছে, প্রথম ৫ বছরে বের হওয়া যাবে না। এরপর ১ বছর মেয়াদে নোটিশ দিতে হবে। আবার বের হয়ে গেলেও ২০ বছর পর্যন্ত বহাল থাকবে। অর্থাৎ আইনটিতে স্বাক্ষর করা মানে ২৬ বছরের খাঁচায় আটকে যাওয়া। ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডসহ ৪৫টি দেশ এই চুক্তি নিয়ে সংকটে পড়েছে।
ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাংলাদেশ দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির ক্ষেত্রে সব সময় মার খায়। কখনও অজ্ঞতার কারণে কখনও স্বার্থের অন্বেষায় প্রভাবিত হয়। প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতা না থাকায় একই জিনিস কারো কাছে ৩ পয়সা, কারো কাছ থেকে ৩০ পয়সা দিয়ে কেনা হচ্ছে। দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি দুর্বলের জন্য সহায়ক হয় না, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে শক্তিশালীরা প্রভাব বিস্তার করে থাকে। বহুপাক্ষিক চুক্তি অনেক সময় দুর্বলের জন্য সহায়ক হয়ে থাকে।
ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড এম শামসুল আলম বলেন, বিইআরসি ক্যাবের অভিযোগ আমলে নেয়নি। আমরা হাইকোর্টে গেছি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশ বাতিল করে দিয়েছে। আদালত বলেছে, বিইআরসি নীরবতা পালন করেছে যা উচিত হয়নি। বিইআরসি বক্তব্য হচ্ছে নির্ধারিত ফর্মুলায় ভোক্তাকে অভিযোগ করতে হবে। নানা কারণে ভোক্তার পক্ষে সব সময় অভিযোগ করা সম্ভব হয় না।
তিনি বলেন, ইসিটি মূলত ফসিল ফুয়েল বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে জন্য করা হয়েছে। ইসিটি যতো শক্তিশালী হতে ফসিল ফুয়েলে বিনিয়োগকারীরা দৃঢ় হবে। ইসিটি ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে, এতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার ব্যাহত ও অসমতার শিকার হবে। আমরা ইসিটিতে স্বাক্ষর না করার জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে গণস্বাক্ষরসহ আবেদন জমা দিয়েছি।
বাংলাদেশের রেগুলেটি বডির অভিজ্ঞতার রেশ টেনে তিনি বলেন, আমার করের টাকায় যার বেতন হয়, সেই আমার কথা শুনতে চায় না। ইসিটিতে মতপার্থক্য হলে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে যেতে বলা হয়েছে। সেখানে গেলে কি হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। ব্যক্তি বিশেষ এই আত্মঘাতী সনদে চুক্তির জন্য তৎপর। তারা দায়মুক্তি আইনের মাধ্যমে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে উঠেছে। দায়মুক্তি আইন হয়তো এক সময় থাকবে, সে কথা মাথায় রেখে ইসিটির জন্য তৎপর হয়েছে। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করলে পরকাল পর্যন্ত রক্ষা পাবে। রফতানি আয়ের টাকা বাংলাদেশে না এসে এফডিআই হয়ে ফিরে এসেছে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কিছু হতে পারে না।
তিনি বলেন, সমবেত মানুষ হবে না। ছাত্ররা কোন দাবি নিয়ে রাস্তায় নামলে পরাজিত হয় না। কোন ছাত্র আন্দোলন কখনও পরাজিত হয়নি। আমরা এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সফল হয়েছি। ভোক্তা শুধু পণ্য কেনে না, তারা চিকিৎসা সেবা, শিক্ষাসহ অনেক কিছুই কেনেন। এখানে বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
ক্যাবের গবেষণা সমন্বয়ক প্রকৌশলী শুভ কিবরিয়ার সঞ্চালনায়, চুয়েট তড়িৎ কৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক প্রকৌশলী ড. সম্পদ ঘোষ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বিবদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইমরানুল ইসলামসহ ক্যাবের বিভিন্ন জেলা কমিটি নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আলোচনায় অংশ নেন।