'মনে করো আমি নেই বসন্ত এসে গেছে'

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সুমন কল্যাণপুর

সুমন কল্যাণপুর

৮৪ বছর আগে ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী একজন শ্যামাঙ্গী কন্যা এখন বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়ে বসবাস করেন দক্ষিণ ভারতে। লতা মুঙ্গেশকারের সঙ্গে টক্কর দিয়ে গান গেয়েছেন বোম্বের সিনেমায়। তার গলা আর লতার গলা আলাদা করতে পারেনি মানুষ। এই বসন্তে তার কথা মনে হতেই পারে বাংলা গানের শ্রোতাদের। তিনি গেয়েছেন বসন্ত ও বেদনা মাখানো অবিস্মরণীয় গান: 'মনে করো আমি নেই বসন্ত এসে গেছে/কৃষ্ণচূড়ার বন্যায় চৈতালি ভেসে গেছে।'

পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ও রতু মুখোপাধ্যায়ের সুরে গাওয়া গানের মতো অসংখ্য গান তিনি উপহার দিয়েছেন। বাংলা ছাড়াও হিন্দি, তামিল, মারাঠি, গুজরাতি, ভোজপুরি ইত্যাদি ভাষায় বহু জনপ্রিয় গান গেয়েছেন তিনি। জন্ম নাম সুমন হেমাদি হলেও তিনি সুপরিচিত সুমন কল্যাণপুর নামে।

বিজ্ঞাপন

সুমন কল্যাণপুর ১৯৩৭ সালের ২৮ জানুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শংকর রাও হেমাদি কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালোর শহরের এক বনেদি সারস্বত ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে চাকরির সূত্রে ব্রিটিশ শাসিত পূর্ববঙ্গের ঢাকা শহরে এসেছিলেন। কর্ণাটকের উদুপি জেলার কুন্দপুর তালুকের একটা গ্রাম হেমাদি তাদের আদিবাস। তিনি সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার এক উঁচু পোস্টে চাকরি করতেন এবং দীর্ঘদিন ধরে অধুনা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় নিয়োজিত ছিলেন। বুড়িগঙ্গার তীরের শহর ঢাকা সুমন ছাড়াও আরেক জন কণ্ঠশিল্পীর জন্মস্থান, যিনি উপমহাদেশের অন্যতম সেরাদের একজন। তার নাম মুন্নি বেগম। উর্দু গানের জনপ্রিয় এই শিল্পী পরিবারের সঙ্গে ১৯৭১ সালে জন্মস্থল ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যান।

সুমনের পরিবারে পিতা এবং মাতা সীমা হেমাদি ছাড়াও পাঁচ বোন এবং এক ভাই ছিলেন। সুমন তার ভাইবোনেদের মধ্যে সকলের বড়ো ছিলেন। তার পরিবার ১৯৪৩ সালে মুম্বই শহরে চলে যান। যেখানে তিনি সংগীত জীবনের বিকাশ ঘটে।

বিজ্ঞাপন

সুমন কল্যাণপুর সব সময় ছবি আঁকা এবং সংগীতে অনুরক্ত ছিলেন। মুম্বইয়ের বিখ্যাত কলম্বিয়া হাই স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে তিনি ছবি আঁকার পরবর্তী পাঠ নিতে মর্যাদাপূর্ণ স্যার জে জে স্কুল অফ আর্টসে ভর্তি হয়েছিলেন। একই সঙ্গে পুণের প্রভাত ফিল্মের সংগীত পরিচালক এবং তাদের একজন পারিবারিক বন্ধু 'পণ্ডিত কেশব রাও ভোলে'জির কাছে উচ্চাঙ্গ কণ্ঠ সংগীতে তালিম নিয়েছিলন।

সুমনের নিজের মত অনুযায়ী, প্রথমদিকে গান গাওয়াটা ছিল তার কাছে একটা শখ, কিন্তু ক্রমে ক্রমে সংগীতের ওপর তার অনুরাগ বেড়ে যায়, আর এর ফলস্বরূপ তিনি পেশাদারিত্বের সঙ্গে 'উস্তাদ খান আবদুল রহমান খান' এবং 'গুরুজি মাস্টার নবরং' এঁদের কাছে সংগীত শিক্ষা করতে আরম্ভ করেছিলেন।

১৯৫৪ সালে সুমন সংগীতের কর্মজীবন শুরু করেন এবং ১৯৬০ এর দশক এবং ১৯৭০ এর দশকে তিনি ভীষণভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি হিন্দি ভাষা ছাড়াও মারাঠি, অসমিয়া, গুজরাতি, কন্নড়, ভোজপুরি, রাজস্থানি, বাংলা, ওডিয়া এবং পাঞ্জাবি ভাষায় গান রেকর্ড করেছিলেন। তার সমকালে তিনি জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী বলে বিবেচিত হয়েছিলেন। তিনি মোট ৮৫৭ টি হিন্দি গান গেয়েছেন।

যদিও সুমন কল্যাণপুরের কণ্ঠ অনেক সময়ই লতার মনে করে ভুল করত লোকজন, তথাপি লতার মতো ম্যাগাস্টারের সামনে তিনি সুযোগ পেয়েছেন কমই। কয়েক বছর মোহাম্মদ রফি ও লতার মধ্যে বনিবনা না হওয়ার ফলে তার জীবনে কিছুটা সুযোগ এসেছিল। তাতেই বোম্বের ফিল্মি জগতে আলোড়ন তুলেন তিনি। তিনি ভারতের অতি শ্রদ্ধেয় নেপথ্য গায়িকাদের মধ্যে একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। তার সেই সময়কালে, লতা মঙ্গেশকরের একাধিপত্যের মধ্যেও, প্রায় সমস্ত সংগীতকারের সঙ্গেই যুক্ত হয়ে গান গেয়ে স্বীকৃতি অর্জনে সফল হয়েছিলেন সুমন কল্যাণপুর।

অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন যে, সুমনের যা প্রতিভা, তাতে তার যত দূর এগোনো উচিত ছিল, তত দূর তিনি যেতে পারেননি, যদিও তার অভাবনীয় সাংগীতিক বৈশিষ্ট্য, যেগুলো একজন নেপথ্য গায়িকার কাছে খুবই প্রয়োজনীয়, সেই উচ্চাঙ্গ সংগীতের বিশদ জ্ঞান, সুরেলা কণ্ঠ এবং গলার বিস্তীর্ণ পরিসীমা তার পুরোপুরিভাবে ছিল। যে কারণে উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষায় গাওয়া তার বহু গান  আজো জনপ্রিয়। যেমন জনপ্রিয় বৃহত্তর বাংলাভাষী শ্রোতাদের কাছেও। বাংলার চিরায়ত বসন্তে কৃষ্ণচূড়ার বন্যায় প্রকৃতি ও চরাচরে চৈতালি ভেসে গেলে তার কথা মনে পড়ে। তিনি তার জন্মস্থান ঢাকায় অনুপস্থিত থেকেও সুরের মায়াবী আবহে জানান, 'মনে করো আমি নেই বসন্ত এসে গেছে'।