নিজের ইন্ডাস্ট্রির সংকটে উদ্বিগ্ন প্রসেনজিৎ, সমাধান খুঁজতে দিশেহারা!
কলকাতার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিও আমাদের দেশের মতো ধুকে ধুকে বেঁচে আছে। সেখানেও একের পর এক সিনেমা মুখ থুবড়ে পড়ছে। কমে গেছে সিনেমা নির্মাণের সংখ্যাও। আমাদের দেশে যেমন বছরে দু-একটি ছবি ঈদের সময় ভালো ব্যবসা করে তেমনি কলকাতাতেও বছরে অল্প সংখ্যক ছবি বক্স অফিসে ভালো ফল আনতে পারছে। প্রতিনিয়ত হিন্দি সিনেমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে হচ্ছে সেখানের ছবির ইন্ডাস্ট্রিকে।
এমন পরিস্থিতিতেও কলকাতার মেগাস্টার প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জির একাধিক সিনেমা সম্প্রতি হিট হয়েছে। তারমধ্যে সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া ‘অযোগ্য’ ছবিটি সিনেমা হলে ৫০ দিনের বেশি অতিক্রম করেছে। এটি প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা জুটির ৫০তম সিনেমা। গতকালই প্রসেনজিৎ তার ফেসবুক পেজে এই সুখবর শেয়ার করেন ভক্তদের সঙ্গে।
তবে সিনেমার এই মন্দা বাজারের মধ্যে আবার ফেডারেশনের অনেক ধরনের নিয়ম কানুনে অতিষ্ঠ অনেকেই। বিশেষ করে ছবির টেকনিশিয়ানরা অনেকদিন ধরেই নিজেদের অধিকার আদায় নিয়ে কথা বলছেন। এখন তা এক প্রকারের আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এই বিষয়টি নিয়েই যে প্রসেনজিৎ ভীষণ উদ্বিগ্ন তা তার আজকে বিকেলের দীর্ঘ ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে। তার লেখার বিষয় ‘বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কিছু সংকট, কিছু তর্ক ও সমাধানের ইচ্ছে।’ কয়েকটি পরিচ্ছদে লেখাটি শেষ করেছেন জনপ্রিয় এই নায়ক।
প্রথম পরিচ্ছদে তিনি লিখেছেন, ‘আজ সকালে টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে বাংলা ছবির, টেলিভিশনের পরিচালকরা ফেডারেশনের সিদ্ধান্তের সামনে কিছু প্রশ্ন রেখেছে। বহুদিন ধরেই রাখছে, আজ ভঙ্গিটা মুভমেন্টের। তার অনেক কারণ রয়েছে। এই মুভমেন্টের গোড়ায়, আগায়, সামনে, পিছনে, ডানদিক, বাঁদিক, সিনিয়র, জুনিয়রসহ সমস্ত রকমের টেকনিশিয়ান, সিনে শ্রমিকদের স্বার্থহানির এক ফোঁটা উদ্দেশ্য নেই। বিষয়টা পলিসির।
দ্বিতীয় পরিচ্ছদে প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি লিখেছেন, ‘বিষয়টা বনাম বা ভার্সেস এর নয়। যে ভার্সেস সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, পলিটিক্যাল রঙের, তার নয়, বিশ্বাস করুন না করুন, নয়। বিষয়টা একই পরিবারের মধ্যে। পরিবারটা বাংলা বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি। তাই যে কোনো রাজনৈতিক বনাম এর, অন্য যে কোনো বনাম এর বাইরে এই আলোচনা। কিন্তু বললেই তো আর হয় না। বনাম নিয়েই বেশি আলোচনা হবে। ‘এরা বনাম ওরা’, এই মর্মেই আলোচনা হয়, কারণ তাতেই লাভ হয় বেশি, মজাও হয় বেশি। তাই ঐটাই চলতে থাকে। আর কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। তাতে বিপদ বাড়তে থাকে গোটা ইন্ডাস্ট্রির। অভিনেতার, পরিচালকের, ফোকাস পুলারের, ট্রলি সেটিং ভাইয়ের, ইলেকট্রিশিয়ানের, হেয়ার ড্রেসারের, মেকআপ আর্টিস্টের, সহকারী পরিচালকের, লাইটের কর্মীদের আরো সকলের মুখ কালো হতে থাকে।
তৃতীয় পরিচ্ছদে অভিনেতা লিখেছেন, ‘পরিবারের কারো শরীর খারাপ হলে ডাক্তার টেস্ট করাতে বলে। পলিসি নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে, তাহলে সকলে বসে সেই টেস্টগুলো করে নেওয়াই উচিত কাজ। যদি সত্যিই গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রাখতে হয়, তাহলে সবার মতামত নিয়েই চলতে হয়। শুধু ভোট নয়, মতামত। সুইচ টিপে ভোট দেওয়া নয়, মতামত। কথায়, লেখায়, বলায়। এবং সকলের। পরিচালকের, ট্রলি যিনি ঠেলেন তার, লাইট যিনি লাগান তার, একসঙ্গে। যদি তারজন্য নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম লাগে, লাগুক। ময়দান লাগে, লাগুক। ব্রিগেড লাগে, লাগুক। পয়সা খরচ করে সবার মতামত শোনা হোক। বোঝাই যাচ্ছে প্রস্তাবটা আবস্তব দিকে চলে যাচ্ছে। কারণ এতদিনের যে নিয়ম তৈরির ব্যবস্থা তাতেও সমাধান হচ্ছে না। বাওয়ালের ভিউস, ট্র্যাকশন, কমেন্ট বেড়ে চলেছে আর ইন্ডাস্ট্রির সব কর্মীদের, বিশেষ করে যারা অল্প অর্থ রোজগার করেন, তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ বেড়েই যাচ্ছে।
বাংলা ছবির স্বাস্থ্য ভাল নয়, এটা পার্সেপশন নয়, সত্যি সমস্যা। তাই এর সমাধানও ‘পার্সেপশন’ দিয়ে হবে না। সত্যি সমাধান দিয়েই করতে হবে। সেখানে ক্ষমতার লাফালাফি দেখালে হবে না, ভোট গুনলে হবে না। এটা রাজনৈতিক সমস্যা নয়, রাজনৈতিক কায়দায় এই সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যা বিনোদন শিল্পীদের, তাদের কাজের পরিবেশের, তাদের সম্মানের। তাদের মানে সকলের। যিনি মূল ভূমিকায় অভিনয় করেন, তার, যিনি জল দেন, খাবার দেন, তারও।
শেষ পরিচ্ছেদে প্রসেনজিতের ভাষ্য, ‘ফেডারেশনের সিদ্ধান্তের জেরে গোটা ইন্ডাস্ট্রি যেভাবে এক বড় আসন্ন বিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা নানা রকম ঘটনা দিয়েই বুঝিয়ে দেওয়া যায়। বাইরের বিজ্ঞাপন না আসা, বাইরের ছবির কাজ না আসা, পাশের দেশের একই ভাষার কাজ এখানে না আসা, এসবেরই পথ সরু হতে হতে বন্ধ হতে চলেছে। আজকের বেশি টাকা কাল যদি শেষ হয়ে যায় তাহলে পশ্চিমবঙ্গে বিনোদন শিল্প বলে আর কিছু থাকবে না। এটা রকেট সাইন্স নয়, কঠিন অঙ্ক নয়। একটু মাথা খাটালেই বোঝা যাবে।
আবার একটা অনুরোধ, এটা বিনোদন শিল্প। চেনা ভার্সেস-এর ন্যারেটিভ দিয়ে মিটবে না। মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে সবার। মন মরে যাচ্ছে। এইভাবে চলতে থাকলে ৮০ সালের পর আবার সেই দিন আসবে, যখন নতুন এসি স্টুডিওগুলো আবার গুদাম হয়ে যাওয়া ছাড়া আর পথ থাকবে না।
আঞ্চলিক ভাষার বিনোদন ভালবাসা, ঐক্য, সম্মান, আলোচনা ছাড়া বাঁচতে পারে না। প্রয়োজনে সাময়িক সংঘাত হোক, কিন্তু সকলে আরো বেটার পরিবেশ, বেটার অবস্থায়, সকলের জন্য বেটার অবস্থায় পৌঁছতে পারি। সকলের জন্য। জয় বাংলা ইন্ডাস্ট্রির, জয় বাংলা।’