ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রাম-০৩

সুপেয় পানির জন্য হাহাকার, চিকিৎসায় এখনও ভরসা ঋষি-বৈদ্য

  • ড. শাওলী মাহবুব ও সাগর ত্রিপুরা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

(পূর্বপ্রকাশের পর)

পুকুরপাড়া গ্রামটিতে স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা সেবা নেই বললেই চলে। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই এখনো পাহাড়ি নিজস্ব চিকিৎসা ব্যবস্থা যা বৈদ্য বা ঋষির চিকিৎসা হিসেবে পরিচিত, তার উপর নির্ভরশীল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে শহরমুখী চিকিৎসা সহায়তা নেওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। যদিও পুরো এলাকায় স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক ইত্যাদি না থাকার কারণে কখনো কখনো মুমূর্ষু রোগীকে পাশের রুমা উপজেলা সদরে একদিনের হাঁটা পথে সবাই মিলে বহন করে নিয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

এলাকাটি অতি দূর্গম হওয়ায় স্বাস্থ্য কর্মী বা ওষুধপত্র পৌঁছাতে সময় লাগে। অনেক সময় এলাকাবাসী প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার জন্য পার্শ্ববর্তী সেনা ক্যাম্প অথবা বিজিবি ক্যাম্প এর উপর নির্ভরশীল হয়। এই এলাকার নারীরাই সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতার মুখোমুখি হয়। মাসিক বা পিরিয়ডের সময় পর্যাপ্ত সচেতনতা এবং স্যানিটারি ন্যাপকিনের অভাব ও ব্যবহার বিষয়ে অজ্ঞতা থাকায় এখানকার কোনো নারীই এসব ব্যবহার করেনা বরং যে যার সক্ষমতা অনুযায়ী নিজেদের মতো করে সবাই নিয়ন্ত্রণ করে।

সুপেয় পানির অভাব পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার কমবেশি সব গ্রামের একটি প্রধান সমস্যা। পানির জন্য আদিবাসীরা ঝিরি-ঝর্ণার উপর নির্ভর করে থাকে। কিন্তু ঝিরি বা ঝর্ণায় পানিও সবসময় থাকেনা। বছরের ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাসে ঝর্ণার পানি শুকিয়ে যায়। ফলে এলাকার জনগোষ্ঠীদের এসময় নিরাপদ পানির জন্য তীব্র কষ্ট করতে হয়। পানি পাওয়ার জন্য গ্রাম থেকে আধ-ঘন্টা বা এক ঘন্টা দূরের রাস্ত হেঁটে, লাইন ধরে অনেক অপেক্ষার পর পানি আহরণ করতে হয়। পানি সংগ্রহের এই কাজটি সাধারণত: নারীরাই করে থাকেন। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি থাকায় অনেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ফুটিয়ে তুলে রাখেন খাবার পানি হিসেবে। আবার এসময় ঝর্ণায় পানি থাকায় পানির কষ্ট কিছুটা কম থাকে। গ্রীষ্মকালে পানি সমস্যার কারণে পানিবাহিত নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

এখানকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা জাতীয় রাজনীতি দ্বারা তেমন প্রভাবিত নয়। যেহেতু গ্রামটি পার্বত্য চট্টগ্রামের অতি দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত এবং আšতর্জাতিক সীমানা ভারত, মিয়ানমারের সংযোগস্থল (যেটি ত্রিসীমানা বলে অভিহিত) সেহেতু এখানকার রাজনৈতিক চরিত্র আঞ্চলিক এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত। এই এলাকাটি যুগ যুগ ধরে দেশীয় এবং আšতঃদেশীয় নানা বিদ্রোহী সশস্ত্র গ্রুপগুলোর প্রকাশ্য আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

আরও পড়ুন: ফ্রেমে বাধাঁনো ছবির মতো জীবন নয় যাদের

এই এলাকা মিজো পার্টি (মিজোরামের গৃহযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বিদ্রোহী সশস্ত্র দল), আরাকান আর্মি (এএ), আরাকান লিবারেশন পার্টি (এমএলপি) মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী দল, মগ পার্টি সবশেষে কুকি-চিন ন্যাশলাল ফ্রন্টের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। এসকল পার্টি গুলো নানান সময়ে এলাকাগুলোর রাজনৈতিক চরিত্র পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অনেক নিরীহ গ্রামবাসী তাদের এই অবস্থানের কারণে নিরব অত্যাচারের শিকার, আবার অনেকে তাদের সুবিধাভোগী।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে এসব দলের প্রভাব কমে গেছে। যদিও পুরোপুরি সশস্ত্র দল মুক্ত এলাকা হতে পারেনি। এখানকার দূর্গম জঙ্গল সশস্ত্র দলগুলোর নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে সুপরিচিত। তবে যেসব স্থানে সেনা/বিজিবি ক্যাম্পের অবস্থান, সেখানে তাদের পদচারণা তেমন নেই। বিস্ময়কর হলেও এটা সত্যি যে সেনা ক্যাম্পগুলো নিরাপত্তার ভূমিকায় থাকে বলে ক্যাম্পের আশেপাশের আদিবাসী গ্রামগুলো নিরাপদবোধ করে।

২০১৫ সালে নতুন এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সমর্থিত আতুমং মার্মা। আতুমং মার্মা ৪ নং বড়থলি ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান হলেও বাস করেন বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলা সদরে। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে অস্থায়ী ইউনিয়ন অফিসও রুমাতেই করেন। তার অধীনস্ত এলাকা দূর্গম হওয়ায় এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে বছরে দুই তিনবার এলাকা পরিদর্শনে যান। কিন্তু এখানে উল্লেখ্য যে এই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সমস্ত সমস্যার সমাধান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীই করে থাকে।

সেনাক্যাম্পগুলো প্রায় নয় দশটি গ্রাম কেন্দ্র করে গঠিত হয়। এই এলাকার আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার বিষয়টি চার পাঁচটি সেনাক্যাম্প এবং বিজিবি ক্যাম্পই দেখশোনা করে থাকে। সব গ্রামে না থাকলেও কয়েকটি সচেতন গ্রামে, গ্রামের অভ্যন্তরে শান্তি শৃঙ্খলা এবং একতা বজায় রাখার জন্য কমিউনিটি ক্লাব রয়েছে। ক্লাবগুলো শিক্ষার্থী এবং গ্রামের অভিভাবকদের মধ্যকার সুসম্পর্ক তৈরি ও গ্রামের ভেতর যেকোনো ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।

জীবনমান উন্নয়নে যা করণীয়

পুকুরপাড়া এলাকার প্রাত্যহিক দিনের এই চিত্রসমূহ আসলে দূর্গত পার্বত্য এলাকার ত্রিপুরা, মারমা কিংবা বম জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনকেই নির্দেশ করে। প্রশ্ন হলো যদি এই অতি দূরবর্তী জনগোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং আবাসস্থল ঠিক রেখে জীবনধারার মানোন্নয়ন করতে চান, সেটা আসলে কীভাবে সম্ভব? পুকুরপাড়ার অভিজ্ঞতা আমাদের দেখায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন বাংলাদেশের আদিবাসী জীবনের উন্নয়নের প্রথম শর্ত। কেননা তাদের অধিকাংশই শহরাঞ্চল থেকে দূরবর্তী স্থানে বাস করেন। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও পর্যটনক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধন করাও অত্যন্ত জরুরী। এক্ষেত্রে তারা কতটা উন্নয়নসহযোগীদের তাদের এলাকায় প্রবেশাধিকার দেবেন সেটাও তাদের সিদ্ধান্তের উপর ন্যস্ত করা শ্রেয়।

পাহাড়ি বা সমতলীয় যেকোন আদিবাসীদের সাথে যুক্ত হবার সময় এমন কৌশল অবলম্বন করতে হবে যেন তা এই প্রান্তিক দুর্বল জনগোষ্ঠীর অধিকার, স্বায়ত্ত্বশাসন এবং সুস্থতাকে অগ্রাধিকার দেয় । এক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জগুলো নিশ্চিত করতে হবে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব যা আসলে এখনও সীমিত আকারেই রয়েছে, উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং ক্রমবর্ধমান স্বীকৃতি সত্ত্বেও, টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা বা¯তবায়নে আদিবাসী সম্প্রদায়ের কণ্ঠস্বর এবং দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থাপন বাংলাদেশে এখনও অনেক কম। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের আদিবাসী নেতা, প্রবীণ এবং যুব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শের জন্য আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া গ্রহণ করা উচিত।

আরও পড়ুন: মাধ্যমিকেই ঝরে পড়ে পুকুরপাড়ার অধিকাংশ শিশুরা

আদিবাসীদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, এবং অভিজ্ঞতাকে আমরা অতি সরলীকরণ বা স্টেরিওটাইপ করে উপস্থাপন করে ফেলি। যেনো বা সকল জনগোষ্ঠীর সমস্যাই একরকম। এ হ্রাসমূলক আখ্যান এড়িয়ে চলা উচিত। তাদের সমস্যাগুলো যেহেতু তাদের নিজ নিজ অঞ্চল এবং প্রেক্ষাপট অনুসারে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়, কাজেই অবকাঠামোগত ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নকে স্থানিক প্রেক্ষাপটে সাজানো জরুরি। এছাড়াও আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভূমি অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা, সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের মতো অবিরাম সংগ্রামগুলো চিহ্ণিত করা উচিত এবং তাদের কথা বলার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেয়া দরকার। একই সঙ্গে যেকোন পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রাথমিক পর্যায়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে জড়িত করতে হবে।

আদিবাসীদের অংশগ্রহণে উপদেষ্টা বোর্ড বা স্টিয়ারিং কমিটি তৈরি করতে হবে। নেতৃত্ব তৈরির লক্ষ্যে আদিবাসী কণ্ঠ, আদিবাসী সংগঠক, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান রক্ষকদের নেতৃত্ব এবং দক্ষতার উপর জোর দিতে হবে। আদিবাসী ভাষাচর্চা বিশেষভাবে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্ব-স্ব জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সাংস্কৃতিক উপাদান অšতর্ভূক্তকরণের ব্যবস্খা করতে হবে। মোটকথা, পার্বত্যচট্টগ্রামে ত্রিপুরাসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে তাদের মূল আবাসস্থল থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। বাংলাদেশের এসব জনগোষ্ঠী পাহাড়ী বনাঞ্চল প্রতিবেশের সাথে সহাবস্থান করছেন। বন তাদের হাতেই নিরাপদ। বহুবর্ণিল ভাষা ও সংস্কৃতি দিয়ে তারা বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি অঙ্গনকে ঋদ্ধ করেছেন।

দূরবর্তী জনপদের এই অধিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে তাদের আবাসস্থল এবং সংস্কৃতিকে অক্ষুন্ন রেখেই সব কিছু করতে হবে। পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পাশে বহুসংস্কৃতির অবস্থানকে সাবলীল করতে ও অতিদূর্গম অঞ্চলের মানুষের জীবনধারার মানোন্নয়নে দেশের সরকার ও জনসাধারণের আন্তরিক অবস্থান প্রয়োজন। (সমাপ্ত)

ড. শাওলী মাহবুব জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সাগর ত্রিপুরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডিজেনাস স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সভাপতি।