রেওয়াজ অনুযায়ী চলে যাওয়া বছরের পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। দেখা হচ্ছে বছরের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তিগুলো। মহাকালের অতল গর্ভে ২০২৪ নামক বছরটি হারিয়ে যাওয়ার আগে কি দিয়ে গেল আর কি নিয়ে গেল? কেন ২০২৪ সালকে পৃথিবীর ইতিহাস মনে রাখবে, এই প্রশ্নও আলোচিত হচ্ছে।
২০২৪ সালকে বলা হয়েছিল নির্বাচনের বছর। বিশ্নে ইতিহাসে খুব কম বছরই ছিল ২০২৪ সালের মতো, যখন অধিকাংশ বিশ্ববাসী ভোট দিয়েছিলেন। মোটামুটিভাবে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৮০০ কোটির প্রায় অর্ধেক (৩৫০ কোটির বেশি মানুষ) ২০২৪ সালে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল এসব ভোটাররা বেছে নেবেন নিজেদের পছন্দের নেতা, রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকারপ্রধান, শাসনব্যবস্থা। তাই ২০২৪ সালকে বলা হয়েছিল বিশ্বজুড়ে নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর।
ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেকটোরাল সিস্টেমস (আইএফইএস) জানিয়েছিল, ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে ৭০টির বেশি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদনের তথ্য জানায়, যেসব দেশে ২০২৪ সালে নির্বাচন হবে, সেসব দেশের সম্মিলিত জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৯ শতাংশ। ভারত থেকে রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা, তাইওয়ান থেকে পর্তুগাল—এ বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এসব নির্বাচন গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দিয়েছে কিনা, সেটাই এক বড় প্রশ্ন।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, নির্বাচন ছিল একটি নিছক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। ক্ষমতাসীনরাই ভোটের প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতায় পুনরাগম করেছে। ভোটারদের ক্ষমতায়ন হয় নি। নির্বাচনের স্বচ্ছতা, শুদ্ধতা ছিল না। ফলে এসব নির্বাচন বৈধতা পায় নি এবং গণতন্ত্রকে মজবুত করতে পারে নি। বরং নির্বাচনী অনিয়ম নিয়ে দেশে দেশে আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। জনবিক্ষোভ ও প্রতিবাদের জোয়ারে অনেক শাসক ভেসে গেছে। যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
নির্বাচনের বছরে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের বদলে যেসব দেশে সংঘাত বিরাজমান ছিল, সেখানে আরও সংঘাত হয়েছে। সিরিয়া, মিয়ানমার, আফগানিস্তানের আগুন নিভে নি। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসে নি। ইসরায়েলের গণহত্যা মোটেও বন্ধ হয় নি। প্রতিদিন ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে রক্ত ঝরিয়েছে দখলদার ইসরায়েল। ইরানে অস্থিতিশীলতা বহলা ছিল। ইয়ামেন, ইরাকে অস্থিরতার অবসান হয় নি। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান হয় নি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন ও পশ্চিমা শক্তির মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের জায়গা দখল করার চেষ্টা করেছে উগ্রবাদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মাত্রা ছিল ভয়াবহ। পাকিস্তানের রাজনীতিতে অব্যাহত ছিল প্রচ্ছন্ন সামরিক হস্তক্ষেপ।
ফলে নির্বাচনের বছরটি বাস্তব পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে বলা যাবে না। এটি নির্বাচনের বছর এজন্য ছিল যে এ বছর আরও অনেক নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনগুলো গণতন্ত্রের বিকাশ ও শক্তি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখার বদলে কর্তৃত্ববাদীদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়েছে। প্রার্থীদের বিপদের পাশাপাশি নাগরিকদের ভোটদানের মুহুর্তগুলো ছিল আক্রান্ত আর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল বিপন্ন, যা নির্বাচন ও গণতন্ত্রের প্রতি আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। বহু ক্ষেত্রে সহিংসতাকে প্রণোদিত করা হয়েছে এবং শাসন ও নির্বাচন ব্যবস্থায় এমন সব কাজ করা হয়েছে, যা মৌলিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। ফলে এমন প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে যে, গণতন্ত্র কি "নির্বাচনের বছর" ২০২৪ সালে টিকে আছে বা ছিল? এমন প্রশ্ন অসঙ্গত বা অস্বাভাবিক ছিল না, ছিল বহুলাংশেই যথার্থ। তবে এসব প্রশ্নের উত্তর এবং নির্বাচন ও গণতন্ত্র সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের পথ দেখানো বিদায়ে পথে চলা ২০২৪ সালের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। সম্ভবত সম্ভব হবে আগত ২০২৫ সালে এবং সামনের অনাগত বছরগুলোতে। এজন্য ২০২৫ সালকে বহুলাংশে ব্যস্ত থাকতে হবে বিশ্বের দেশে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরায় প্রতিষ্ঠার কাজে।
২০২৪ সালে সব মিলিয়ে বিশ্ববাসী এমন এক প্রবল দিশাহারা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলেছে, যেখানে ছিল অনিশ্চয়তা ও ভীতি। কারণ, দফায় দফায় ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে তীব্র গোলযোগ আর অভূতপূর্ব সংঘর্ষের সম্মুখীন হতে হয়েছে বিশ্বকে। ২০২৪ নামক বছরটি এমন এক সঙ্কুল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, যখন সারা বিশ্বের মাথার উপরে জমেছে অর্থনৈতিক সঙ্কট ও বাণিজ্য যুদ্ধের ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মেঘ। বৈশ্বিক মহামারি কোভিড পরিস্থিতির ধকল পেরিয়ে বিশ্বের আর্থিক মন্দা কাটানোর জায়গা দখল করেছিল আর্থিক কর্তৃত্ব দখলে জন্য শক্তিমানদের লড়াই। বিশ্বব্যাপী বাজার কব্জা করতে চীন ও মার্কিন দ্বন্দ্ব মোটেও থেমে ছিল না। এমনকি, বিশ্বের বহু স্থানে এই দুই পরাশক্তি ছায়াযুদ্ধে অংশ নিয়ে অনেকগুলো সংঘাতের বিস্তার ঘটিয়েছে। যার মধ্যে জাতিগত, সম্প্রদায়গত, ধর্মগত লড়াই উস্কে দেওয়ার ঘটনা ছিল। ছিল সম্পদ দখল ও কৌশলগত স্থানে কর্তৃত্ব করার প্রচেষ্টা। যার প্রকাশ দেখা গেছে মিয়ানমারের অব্যাহত গৃহযুদ্ধে এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য পার্শ্ববর্তী দেশের শরণার্থী সমস্যা ও নিরাপত্তাগত ঝুঁকির বিষয়গুলোতে।
২০২৪ সালে প্রচণ্ডভাবে টের পাওয়া যায় যে, পরিবেশের অবক্ষয় এবং প্রাকৃতিক সম্পদের নিঃশেষ হয়ে আসার প্রক্রিয়াটি ভয়ঙ্কর গতিতে এগিয়ে চলছে। ফেলে আসা বছরটিতে দুনিয়া পাল্টেছে বহুবিধ ভাবে। এই বছরেই প্রত্যেক দিন বিশ্বের কোনও না কোনও অংশ চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে, তাপপ্রবাহ এবং শৈত্যপ্রবাহের নতুন রেকর্ড গড়েছে, আবার তা ভেঙেও গিয়েছে; যে সব সম্প্রদায় এমনিতেই বিপন্ন, ক্রমাগত বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলে উঠতে না পেরে তারা বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে।
বিশেষত ভুল ও বিকৃত নগরায়নের কারণে পরিবেশগত ভাবে আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের অনেকগুলো প্রধান শহর। সবচেয়ে বেশি বিপদের সম্মুখীন হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান তিন শহর: ঢাকা, দিল্লি, লাহোর। বায়ু মানের দিক থেকে লাগাতার বিশ্বের সবচেয়ে বিপদজনক শহরের তকমা পেয়েছে শহর তিনটি। বসবাসের দিক থেকে প্রাচীন এই শহরগুলো খুবই সঙ্কুল পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে, যেখানে দুষণের কারণে বিস্তার লাভ করেছে বহুবিধ রোগ-ব্যাধি। একই সঙ্গে উন্নত দেশগুলোর কার্বন ও অন্যান্য রাসায়নিক বর্জ্য বিশ্বের দুষণকে পাল্লা দিয়ে বাড়িয়েছে। তদুপরি, অনুন্নত বিশ্বে সম্পদহীনতার কারণে নদী, পাহাড়, বনাঞ্চল কর্তনের ঘটনা ঘটেছে অবিরাম গতিতে। ২০২৪ সালে প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি এহেন মারাত্মক উদাসীনতার প্রতিফল অনাগত বছরগুলোতে চরমভাবে দুর্ভোগে ফেলতে পারে বিশ্ববাসীকে।
২০২৪ সালের সালতামামি লিখতে বসলে একটি বিষয় মোটেও বিস্মৃত হওয়ার উপায় নেই। কারণ, এ বছরের বিস্ময় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম মেধাকে উপেক্ষা করার কোনও প্রশ্নই উঠবে না। ২০২৪ সাল তা প্রতিষ্ঠা করে দিল। এআই এখন সৃষ্টিশীল— জেনারেটিভ; যাকে নির্দেশ দিলে সে সেই মতো ছবি, ভিডিয়ো, গান, লেখা, কথোপকথন তৈরি করে দেবে। এতে কার্যক্ষেত্রে সুবিধা প্রচুর হয়েছে। পাঁচশো পৃষ্ঠার বই থেকে কৃত্রিম মেধা নিমেষে ৫-১০ পৃষ্ঠার সারমর্ম বার করে দেবে; জানিয়ে দেবে যে কোনও বিস্তৃত বিতর্কের সারমর্মটুকু। যাচাই করে দেবে তথ্যের সত্যতা।
তবে এআই-এর বিশ্লেষণও নিরপেক্ষ না হতে পারে। সেটা নির্ভর করছে সেই এআই মডেলকে কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তার উপরে। এআই‘কে ইতিবাচক কাজের বদলে নেতিবাচক ও ক্ষতিকর কাজে ব্যবহারের বিপদও রয়েছে। তদুপরি, মানব মেধা ও যোগ্যতার সাথে এই কৃত্রিম মেধার লড়াই শেষ পর্যন্ত সভ্যতার ইতিহাসে কিরূপ প্রভাব ফেলে, সেটাও বিবেচনার বাইরে রাখা যাচ্ছে না। অতি-যান্ত্রিকীকরণের ফলে মানব জাতির ভবিষ্যতে কোনও অদেখা বিপদ এসে হানা দেয় কিনা, সে কথাও ভাবতে হচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে ২০২৪ সালকে বলা যায় এক ক্রান্তিকাল বা সঙ্কুলতার বছর। যে বছরের ট্র্যানজিশনাল পর্যায় পেরিয়ে গণতন্ত্র, ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশ্বশান্তি, পরিবেশ ও প্রযুক্তির গতি কোথায় গিয়ে পৌঁছায়, সেটাই বড় বিবেচ্য বিষয়। যদি সেই গতিসমূহ ইতিবাচক হয়, তাহলেই ভালো। যদি নেতিবাচক ও ক্ষতিকর হয়, তাহলে বিশ্ব ও বিশ্ববাসীকে সামাল দিকে হবে অনেকগুলো বিপদের ক্ষেত্র। ফলে ২০২৪ সালের পর্যালোচনায় বিশ্বকে আগত ২০২৫ সালে আরও সুচিন্তিত ও সুবিবেচনার পথে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ দেয় গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতা, আর্থিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, পরিবেশগত ভারসাম্য এবং কল্যাণমুখী প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রয়োজনে।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।