আবদুস সামাদ : ফুটবলের বাঙালি জাদুকর

  • নিশীথ দাস, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

তাঁর স্মরণে বাংলাদেশ সরকার একটি স্মারক ডাকটিকেট ও উদ্বোধনী খাম প্রকাশ করে

তাঁর স্মরণে বাংলাদেশ সরকার একটি স্মারক ডাকটিকেট ও উদ্বোধনী খাম প্রকাশ করে

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অপূর্ব ক্রীড়াশৈলির প্রকাশ ঘটিয়ে ফুটবল জগতে তুমুল আলোড়নের মাধ্যমে মানুষের মন কাড়েন বাঙালি ফুটবলারদের আইকন সামাদ। পুরো নাম সৈয়দ আবদুস সামাদ। তাকে ফুটবলের জাদুকর হিসেবে ডাকা হয়। ব্রিটিশ-ভারতের বাংলায় শুধু নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফুটবলে নিজের অসাধারণ ক্রীড়াকৌশল দেখানো জাদুকর ১৮৯৫ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের ভুরী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ছিল অগাধ প্রেম। পড়াশোনায় তার খুব একটা মনোযোগ না থাকার কারণে অষ্টম শ্রেণীতেই এই অধ্যায়ের ইতি টানেন। পড়াশোনার পরিবর্তে তিনি খেলাধুলাতেই মনোযোগ দেন। অল্প বয়সেই কলকাতার বড় বড় ক্লাব থেকে ডাক আসে তার। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই কলকাতা মহানগরে ফুটবল খেলতে আসেন।

সামাদ ১৯১২ সালে কলকাতা মেইন টাউন ক্লাবে যোগ দেন। ১৯১৬ সালে ইংলিশ ক্লাব সামারসেটের পক্ষ হয়ে খেলেন। ১৯১৫-৩৮ পর্যন্ত এই ২৩ বছরের খেলোয়াড়ি জীবনে ঘটেছে নানা বিস্ময়কর ঘটনা। এ কারণেই তার নামের সামনে ‘জাদুকর’ শব্দটি জুড়ে গেছে। তার খেলার দক্ষতায় তৎকালীন সর্বভারতীয় ফুটবল দল গ্রেট ব্রিটেনের মতো বিশ্বসেরা ফুটবল দলের বিরুদ্ধে এক অবিস্মরণীয় জয় অর্জন করে।

বিজ্ঞাপন
https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/18/1566127670931.jpg
◤ সামাদের খেলোয়াড়ি জীবনে ঘটেছে নানা বিস্ময়কর ঘটনা ◢


তিনি ১৯২৪ সালে ভারতের জাতীয় ফুটবল দলে নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯২৬ সালে দলটির অধিনায়ক হন। এই সময়ে ভারতের হয়ে বার্মা (মায়ানমার), সিলোন (শ্রীলঙ্কা), সুমাত্রা-জাভা-বোর্নিও (ইন্দোনেশিয়া), মালয় (মালয়েশিয়া), সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন ও ইংল্যান্ড সফর করেন। চীনের বিপক্ষে একটি ম্যাচে ভারত ৩-০ গোলে পিছিয়ে থাকলেও তাঁর দেওয়া চারটি গোলে ৪-৩ গোলে অবিস্মরণীয় এক জয়লাভ করে। এ খেলা দেখে স্কটিশ এক ফুটবলবোদ্ধা বলেন, “সামাদ ইউরোপে জন্মগ্রহণ করলে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে স্বীকৃতি পেত।” ১৯২১-৩০ পর্যন্ত তিনি ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের হয়ে খেলেন। ১৯২৭ সালে নিজের দল ইস্ট বেঙ্গল তার এক গোলের ফলেই ইংল্যান্ডের ম্যাশউড ফরেস্টের বিপক্ষে জয় পেয়েছিল। তাঁর খেলায় মুগ্ধ হয় ব্রিটিশরাও। ১৯৩৩ সালে সামাদ যোগ দেন কলকাতা মোহামেডানে। মোহামেডানকে প্রায় একক কৃতিত্বে টানা পাঁচবার কলকাতা সিনিয়র ডিভিশন লিগে চ্যাম্পিয়ন করেন তিনি। ১৯৩৬ সালে খেলাকালীন গুরুতর আহত হওয়ার কারণে তিনি আর খেলতে পারেননি।

আফ্রিকায় এক সফরের সময় ষড়যন্ত্র করে তাকে অধিনায়ক না করায় তিনি দল থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। তার অনুপস্থিতিতে দলটি সেবার সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি। তার প্রসঙ্গে ইংল্যান্ডের কৃতি ফুটবলার এলেক হোসি বলেছিলেন, “বিশ্বমানের যে কোনো ফুটবল দলে খেলার যোগ্যতা সামাদের রয়েছে।”

বিজ্ঞাপন
https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/18/1566127758237.jpg
◤ পার্বতীপুরে বাংলাদেশ রেলওয়ে নির্মিত সামাদ মিলনায়তন ◢


সামাদের খেলার সময় মাঠে অবিশ্বাস্য ঘটনার উদ্ভব হতো। একবার ইন্দোনেশিয়ার জাভায় সর্বভারতীয় ফুটবল দলের খেলা চলাকালে কয়েকজন খেলোয়াড়কে পাশ কাটিয়ে গোলপোস্ট লক্ষ্য করে শট করেন সামাদ। কিন্তু গোলপোস্টের ক্রসবারে লেগে বল মাঠে ফিরে এলে তিনি অবাক হন গোল না হওয়ার কারণে। আবারও তীব্র শটের বল গোলপোস্টের ক্রসবারে লেগে ফিরে আসে। এবার তিনি চ্যালেঞ্জ করে বলেন, “গোলপোস্টের উচ্চতা নিশ্চয়ই কম আছে। নইলে আমার দুটো শটেই গোল হতো।” পরে গোলপোস্টের উচ্চতা মেপে দেখা যায়, তা স্ট্যান্ডার্ড মাপের চেয়ে চার ইঞ্চি কম! আরেকবার মাঠের মধ্যস্থল থেকে বল নিয়ে সব খেলোয়াড়কে বোকা বানিয়ে বল মারেন গোলপোস্টে কিন্তু গোল না হয়ে বল গোলপোস্টের কয়েক ইঞ্চি উপর দিয়ে চলে যায়। কিন্তু সামাদ গোল হয়েছে বলে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, “আমার শটে নিশ্চয়ই গোল হয়েছে।” পরে ওই গোলপোস্ট মেপে দেখা গেল ওটার উচ্চতা ছোট। মজার একটি ব্যাপার হচ্ছে, একবার সামাদ খেলার আগ মুহূর্তে মাঠের চার্তুদিকে পায়চারি করে ক্রীড়া কমিটির কাছে অভিযোগ জানান, মাঠটি আন্তর্জাতিক মাপের তুলনায় ছোট হওয়ায় এখানে আমাদের টিম খেলতে পারবে না। সত্যি পরে মাঠ মেপে এর সত্যতা প্রমাণিত হয়।

যখন ফুটবল ম্যাচ থাকত না তখন সামাদ ভাড়ায় খেলতেন অন্যের পক্ষ হয়ে। তৎকালীন জমিদাররা খেপ খেলানোর জন্য তাকে ভাড়া করে নিয়ে যেত। খেলা শুরুর আগে তিনি তাদের বলতেন, কয়টি গোল দিতে হবে? ম্যাচের পুরো সময় তিনি বল নিয়ে মাঠে নেচে বেড়ালেও গোল দিতেন না। খেলা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই নির্ধারিত গোল দিয়ে চুক্তির টাকা নিয়ে যেতেন।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি স্থায়ীভাবে চলে আসেন পূর্ব বাংলার পার্বতীপুরে। সংগঠক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বেতনভুক্ত ফুটবল কোচ হন। ১৯৬২ সালে রাষ্ট্রপতি পদক লাভ করেন। ১৯৬৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ফুটবলের এই জাদুকর মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীকালে, পার্বতীপুর শহরের ইসলামপুর কবরস্থানে ১৯৮৯ সালে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিসৌধ। তাঁর স্মরণে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি একটি স্মারক ডাকটিকেট ও উদ্বোধনী খাম প্রকাশ করেছে। পার্বতীপুরে বাংলাদেশে রেলওয়ে নির্মিত ‘সামাদ মিলনায়তন’ নামে একটি মিলনায়তনও আছে।