প্রবাসীদের প্রচেষ্টায় ঘড়ির কাঁটাও যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ে!
প্রবাস জীবনে পাড়ি জমাতে হবে অনেকে তা কল্পনাই করেন না। যেখানে অপরূপ সুন্দর বাংলাদেশের মাটির সঙ্গে মিশে আছে জীবন, যেখানে প্রকৃতির অপার লীলায় লুকিয়ে আছে প্রাণ। সেগুলো ছেড়ে মরুতে পাড়ি দেওয়া সত্যি বেদনাময়!
অনেকেই প্রবাসে আসার পর প্রথম দিকে ব্যাপারটা তাদের কাছে বনবাসের মত লাগে। আমার দেখা একজন প্রবাসী হিসেবে প্রতিদিনই নিত্য নতুন ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়, সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতার ভান্ডারও বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রবাস জীবন শিখিয়ে দেয় কিভাবে আশেপাশে ঘটে যাওয়া অনেক কিছুকেই এড়িয়ে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যেতে হয়। নিরাশার অতল গহীনে হারিয়ে যাওয়া ছেলে মেয়েগুলো চোখের নোনাজল আর শরীরের ঘামকে উপেক্ষা করে বলতে শিখেছে “আমি ভাল আছি মা” তোমরা ভাল আছ-তো? এমনকি অনেক অখাদ্যকে অমৃত সুধা মনে করে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। খাওয়ার পর মায়ের শাড়ির আচঁলে মুখ মোছা ছেলেগুলোও এখন ধুলোমাখা ঘামের শার্টেই মুখ মোছে।
ঘর থেকে বের হলেই যাদের বাইক কিংবা রিকশার প্রয়োজন হতো, তাদেরকে এখন স্বচক্র যানে বা দ্বিচক্র যানে পায়ে হেঁটেই পাড়ি দিতে হয় অনেকটা পথ। নরম বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়া ছেলেগুলো নরম বিছানার জায়গা কাঠের তক্তা দখল করে নিয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠাতে যাকে ডাকা ডাকির অন্ত থাকত না, প্রবাসী হবার কারণেই তাকে সূর্যি মামার আগেই জেগে উঠতে হয়। শরীর খারাপ’কে পেছনে ফেলে রোদ বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হয় কর্মস্থলে।
এক সময় বন্ধুদের নিয়ে অস্থির জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছেলেদের অন্য এক অস্থিরতায় পেয়ে বসে! তা হলো বিদেশে আসার ধার দেনা ফেরত দেওয়ার অস্থিরতা। প্রতিটি টাকা খরচ করতে তাকে দু’বার ভাবতে হয়। যে ছেলেগুলো দেশে কোন কাজই করেনি, প্রবাসে তাদেরকে একটি শুক্রবার কিংবা রোববার কাজ বন্ধ দিলে হতাশা পেয়ে বসে। এই ভেবে যে এ মাসে টাকা কম আয় হবে। অথচ তাদেরকে নিতান্তই ভুলে যেতে হয় যে সপ্তাহের ৬ দিনই ভোর ৪ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়।
ছাত্র রাজনীতির মাঠে বীরদর্পে প্রদক্ষিণ করা ছেলেগুলোই রাজনীতির ভেদাভেদ ভুলে, প্রতিহিংসাকে পেছনে ফেলে “বাংলাদেশি” পরিচয়ে এগিয়ে চলে। বিপদে ভাই বন্ধুর মত পাশে দাঁড়ায়। যদিও সব বাঙালি এক নয়!
সারা দিন কাজের শেষে রাত জেগে পড়াশোনা করতেও তারা ক্লান্ত হয় না, মনে হয় এ যেন জীবনান্দনের মত ক্লান্ত হয়ে ছুটেই চলেছে তারা, ভোর হতেই বেড়িয়ে পড়ে কর্মস্থলে। প্রবাসীদের এমন প্রচেষ্টা দেখে ঘড়ির কাঁটাও যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ে!
তবে দিন শেষে প্রবাসীদের জন্য খুব মজার একটি বিষয় হচ্ছে শত কষ্ট, ব্যস্ততার মাঝেও খুশি হতে খুব বেশি কিছু প্রয়োজন হয় না। দেশ ভাল আছে, দেশে সবাই ভাল আছে, পরিবার পরিজনের হাসি মাখা মুখ ও কণ্ঠস্বরই ভরিয়ে দেয় প্রবাসীদের ক্লান্ত প্রাণকে।
প্রবাসে চরিত্রগুলো ভিন্ন হতে পারে কিন্তু তাদের জীবন যুদ্ধ, গল্পকথা মোটামুটি একই রকম। প্রতিটি জীবনই প্রবাসে এসে বদলে যায়, সজ্জিত হয় সম্পূর্ণ এক নতুন ধাচে। প্রবাস জীবন শিখায় জীবনকে উপলব্ধি করতে, শত বাধা বিপত্তি উপক্ষা করে, মারামারি কাটাকাটি’কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মস্তিকের জোড়ে কি ভাবে এগিয়ে যেতে হয়।
তবে একটা কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই! প্রবাসে যারা থাকেন তারা হাড়ে হাড়ে টের পান জীবন কাকে বলে। অথচ দেশ থেকে পরিবার পরিজন বন্ধু-বান্ধবসহ অনেকেই অনেক কিছু দাবি করেন! তবে দাবি থাকটা স্বাভাবিক এবং সেই দাবি মেটানোটা আহামরি কিছুই নয়! কিন্তু চিরন্তন সত্য হলো আপনারা চোখে না দেখলে বুঝবেন না প্রবাসীরা বুকে পাথর রেখে কি ভাবে আপনাদের চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছে আবার কখনো কখনো হিমশিমও খেতে হচ্ছে! কারণ অধিকাংশ প্রবাসীদের রোজগারটা তাদের হিসেবের। তারা পারত পক্ষে টাকা খরচ করতে চান না, কেন চান তা ওপরের কথাগুলোর দিকে নজর দিলেই বোঝা যাবে। যে পরিবারের সদস্যরা ভাবেন আপনাদের বাবা, কাকা, মামা, ভাই, বিদেশ থাকেন আপনারা কাজ কর্ম না করে চুল স্পাইক করে, দামি পারফিউম মেখে, মোটরসাইকেল নিয়ে ঘোরাঘুরি করেন আপনারা বুঝবেন না এই টাকাগুলো কত কষ্ট, কত নোনাজল আর ঘামের বিনিময়ে উপার্জিত হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই এক রকম ঘটনা বেশি হয়। পরিবার একজন বিদেশ থাকেন তার ওপর ঝুলে থাকেন বাকি সবাই। আমি মনে করি আপনাদের দাবিটা যতটুকু থাকে তার থেকে বেশি ভালবাসা দেন প্রবাসীদের।
বাংলাদেশ থেকে যারা প্রবাসে এসে কাজ করছেন দেশের রেমিট্যান্স বাড়াচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকার তাদের কতটুকু মূল্যায়ন করে সেটা নিয়েও রয়েছে অনেক সংশয়! প্রবাসে ৫-৭ বছর কাজ করে যখন স্বদেশের টানে সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে যান। তখন এয়ারপোর্টে কত রকমের ঝামেলা পোহাতে হয় তা বলাই বাহুল্য আর যদি কম শিক্ষিত মানুষ হয় তা হলে তাঁর কি অবস্থা হয় তা নিশ্চয় আপনারা অনুমান করতে পারেন। এখানেই শেষ নয় কষ্টের রোজগার দিয়ে যখন পরিবার পরিজনদের জন্য কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আসেন সেগুলো নিয়েও অনেক ঝামেলা পোহাতে হয় প্রতারণার শিকার হতে হয়। প্রশ্নটা হচ্ছে এই মানুষগুলোই দেশে ভাল কিছু করার সুযোগ না পেয়ে স্বদেশ ছেড়ে বিদেশ পাড়ি জমান, এবং যেখানে বাংলাদেশ সরকারের রয়েছে বিশাল অংকের আয়। তা হলে কেন তাদেরকে এত ঝামেলা ও প্রতারণার শিকার হতে হয়। বরং বাংলাদেশ সরকারের উচিত ছিল এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ভালবাসার মালা পড়িয়ে গ্রহণ করা।
বাংলাদেশ সরকারের উদ্দেশ্যে বলব আপনারা কি জানেন মধ্যপ্রাচ্যে এই যোদ্ধারা মরুর বুকে ৪২ থেকে ৫০ ডিগ্রী তাপে সবুজ ঘাস ফলানোর কষ্ট, উঁচু উঁচু দালান তৈরি করার কষ্ট। হাড় কাঁপানো শীতে যোদ্ধারা কি ভাবে কাজ করে যায়। প্রবাসীরা নীরবে নিভৃতে স্বদেশকে ভালোবেসে বিদেশে কাজ করে যাচ্ছেন।