মিয়ানমারে সুচি-আর্মি সখ্যতার অবসান
মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনায় আবারো প্রমাণ হলো, ফৌজি জান্তা কখনোই রাজনীতিবিদের মিত্র নয়। যে সামরিক শক্তির চরম আনুগত্য দেখিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন অং সান সুচি, সেই জান্তাই তাকে নিক্ষেপ করেছে কারাগারে। দুঃখজনক পটভূমিতে অবসান হলো সুচি-আর্মির সখ্যতা।
গণতন্ত্রের নেত্রী সুচি আর্মিকে খুশি রাখতে রোহিঙ্গা গণহত্যায় পাথরের মতো নিরব ছিলেন। পাছে আর্মি নাখোশ হয়, সেই ভয়ে রোহিঙ্গাদের জাতিগত অধিকার মানেন নি। লক্ষ লক্ষ দেশত্যাগী রোহিঙ্গা নাগরিকদের অবর্ণনীয় উদ্বাস্তু জীবনের দুর্দশার দিকে ফিরেও তাকান নি। নিজের মানবিক ইমেজে গণহত্যা কলঙ্ক নিয়েও তিনি আর্মির সঙ্গে ছিলেন।
কিন্তু মিয়ানমারের আর্মি সুচির এতো আনুগত্যের পরেও তাকে ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি। নির্বাচনে জিতেও কারাগারে বন্দি হয়েছে সুচি। রাজনৈতিক জীবনের চরম মূল্য দিয়ে তিনি সামরিক আনুগত্যের মাশুল দিলেন।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই সামরিক আঘাতে পর্যুদস্ত হন সুচির পিতা মিয়ানমারে স্বাধীনতার নায়ক অং সান। যখন তার পিতাকে হত্যা করা হয়, তখন সুচির বয়স মাত্র দু’বছর। সেই সুচি লড়াই ও আপোষের মাধ্যমে চলে এসেছিলেন আর্মির অতি-নিকটে। তথাপি তার শেষ রক্ষা হয় নি।
১৯৬২ সালে অভ্যুত্থানের সময় থেকে মিয়ানমার শাসন করছিল সেনাবাহিনী। ক্রমশ আর্মির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও শুরু হয়, যাতে সামিল ছিলেন সুচিও। কিন্তু চরম আক্রমণে নেতাকর্মীদের হত্যা ও জেলে পাঠিয়ে গণআন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করে আর্মি। সুচিকে করা হয় গৃহবন্দি। অল্প সময়ের জন্য মুক্তি পেলেও ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি অবরুদ্ধ থাকেন। এরই মাঝে গণতন্ত্রের পক্ষে আন্দোলনের জন্য ১৯৯১ সালে সুচিকে শান্তিতে নোবেল পদক দেয়া হয়, বন্দি সুচির পক্ষে গ্রহণ করেন তার বড়ছেলে আলেকজান্দার।
২০১১ সালের আগস্টে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট, সাবেক জেনারেল থেইন সেইনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ও আলোচনার পথ ধরে ২০১৫ সালে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের ইতি ঘটিয়ে ক্ষমতায় দেখা পান অং সান সুচি। এতে মিয়ানমারের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের আশা জাগে এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা খর্ব হয়। সে সময় সুচি তার পশ্চিমা মিত্রদের প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি রোহিঙ্গা মুসলিমদের দুর্দশার সমাধান করবেন, দেশে জাতিগত নিপীড়ন বন্ধ করবেন এবং গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠা করবেন। সুচি ঘোষণা করেন যে, এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য তিনি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবেন। যথারীতি ২০১৭ সালের আগস্টে কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে সমস্যা সমাধানে বেশ কিছু পরিবর্তন সুপারিশ করা হয়।
দৃশ্যত কাগজেপত্রে কিছু কাজ করলেও বাস্তবে কিছুই করতে পারেননি সুচি। ক্ষমতায় সুচিকে চলতে হয়েছে আর্মির সঙ্গে সমঝোতা করে। কারণ মিয়ানমারের সকল ঘটনাপ্রবাহ ও পরিস্থিতি ছিল আর্মির প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে। গণতন্ত্রের লড়াকু নেত্রী হয়েও তিনি যে আর্মির পুতুল ছিলেন, তা হয়তো তিনি বুঝতে পারেননি কিংবা বুঝেও স্বেচ্ছায় মেনে নিয়েছিলেন।
কারণ, নিজের প্রদত্ত ওয়াদা ও কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট পদদলিত করা হলে সুচি চুপ থাকেন। এমনকি সেনাবাহিনী বর্বর, নিষ্ঠুর ও নির্মম আক্রমণে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিলেও নিশ্চুপ থাকেন সুচি। এমনকি, গণধর্ষণ করে যুবতী, নারীদের প্রতি নৃশংসতাকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার জাতিনিধন বলে আখ্যায়িত করলেও সুচি আর্মির পক্ষে সাফাই দেন। তিনি নিজের দেশের নির্যাতিত নাগরিক রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিতেও কুণ্ঠিত হননি। হত্যা, নির্যাতনে রাখাইন যখন জ্বলছিল, সুচি তখনো ছিলেন নির্বিকার।
আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে, লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ প্রাণের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালানোর পটভূমিতে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে জাতির উদ্দেশে ভাষণে সুচি দলে দলে রোহিঙ্গাদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার ঘটনায় বিস্মিত হওয়ার ভণিতা করেন। তিনি এও বলেন যে, 'তারা কেন দেশ ছেড়ে গেছে আমাদেরকে তা জানতে হবে।' শুধু তাই নয়, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া মামলা করলে সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গান সুচি। এড়িয়ে যান গণহত্যার প্রসঙ্গ।
এতো তেল দিয়ে ও আনুগত্য করেও সুচি আর্মিকে সন্তুষ্ট করতে পারেন নি। ২০২০ সালের নভেম্বরে দেশে পার্লামেন্ট নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেও আর্মির কোপে পড়েন তিনি। সেনাবাহিনী স্পষ্ট জানায়, 'নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে। এ জন্য ‘অ্যাকশন’ নিতে হবে।' হুঁশিয়ারি দেন স্বয়ং সেনাপ্রধান হ্লাইং। যার বাস্তব রূপ দেখা যায় পহেলা ফেব্রুয়ারি ভোরে, যেদিন সংসদের অধিবেশনে বসার জন্য তৈরি নেতারা বন্দি হয়ে নিক্ষিপ্ত হন কারাগারে।
সন্দেহ নেই, মিয়ানমারের সামরিক হস্তক্ষেপের ঘটনা গণতন্ত্রের জন্য দুঃসংবাদ। তবে ঘটনাটি সুচিসহ সেদেশের সামরিক পদলেহী রাজনীতিবিদের জন্যেও চরম শিক্ষা, যাতে আবারো প্রমাণিত হয়েছে যে, ফৌজি জান্তা কখনোই রাজনীতিবিদের মিত্র নয়।